• facebook
  • twitter
Wednesday, 2 April, 2025

৫৬ ইঞ্চি ছাতি এবং ভারতের স্বাভিমান

ট্রাম্প এরপরই প্রত্যাঘাতমূলক পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন। কলম্বিয়া থেকে আমেরিকায় ঢোকা সমস্ত পণ্যের উপর ২৫% অতিরিক্ত শুল্ক চাপানো হয়।

ফাইল চিত্র

প্রবীর মজুমদার

পৃথিবীর আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অবস্থান কোথায়? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমেরিকা সফরের মাঝেই দ্বিতীয় দফার বেআইনি অভিবাসী ভারতীয় শ্রমিকদের হাতে পায়ে শিকল বেঁধে ভারতে ফিরিয়েছে মার্কিন সরকার। এই ফেরানোর প্রক্রিয়া চলবে বেশ কয়েক দফায় – এমনটাই জানা গেছে। আমেরিকা সফরে গিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের এই ঔদ্ধত্যের মুখে চুপ করেই রইলেন ভারতের ৫৬ ইঞ্চি ছাতির হিন্দু হৃদয়সম্রাট প্রধানমন্ত্রী। প্রতিবাদ তো দূরের কথা, উল্টে আমেরিকার অবস্থানকেই মোদী সমর্থন করে এলেন। বলে এলেন ‘বেআইনিভাবে বসবাস করার অধিকার কারোরই নেই।’

হাতে পায়ে শিকল বেঁধে সামরিক বিমানে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া যে একেবারেই বেআইনি এবং মানবতাবিরোধী, সেকথা কিন্তু ভুলেও বললেন না মোদীজি । এ ব্যাপারে ভারত সরকারেরও যে কিছু ভূমিকা থাকা দরকার ছিল, তাও ভুলে মেরে দিলেন তিনি। অথচ, আমেরিকা একই ব্যবহার যখন লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর নাগরিকদের সঙ্গে করতে গেছে, তখন কিন্তু সেইসব দেশের সরকারগুলোর কাছ থেকে প্রবল বাধা পেয়েছে। আমেরিকার ফ্যাসিবাদী প্রশাসনের এই ব্যবহারের বিরুদ্ধে লাতিন আমেরিকার সরকারগুলোর প্রতিক্রিয়া এবং ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ফারাক খেয়াল করার মত। ২৩ জানুয়ারি মেক্সিকো কাগজবিহীন অভিবাসীদের ফেরত নিয়ে আসা আমেরিকান এয়ারফোর্স সি-১৭ বিমান মেক্সিকোতে নামতেই দেয়নি। দ্রুত এই প্রতিরোধে যোগ দেয় কলম্বিয়াও। তিন দিনের মাথায়, অর্থাৎ ২৬ জানুয়ারি, তারাও দেশের অভিবাসীদের নিয়ে আসা মার্কিন সামরিক বিমান কলম্বিয়ায় নামতে দেয়নি। একই ঘটনা ঘটে ব্রাজিলেও। সেদেশের বামপন্থী রাষ্ট্রপতি লুলা দ্য সিলভা অভিযোগ করেন, আমেরিকা ব্রাজিলিয়দের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করছে, যা সমর্থন করা যায় না। তিনি পরিষ্কার বলে দেন, ‘আমার সহনাগরিকদের সঙ্গে এমন আচরণ করার অধিকার আমেরিকার নেই।’

ট্রাম্প এরপরই প্রত্যাঘাতমূলক পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন। কলম্বিয়া থেকে আমেরিকায় ঢোকা সমস্ত পণ্যের উপর ২৫% অতিরিক্ত শুল্ক চাপানো হয়। কলম্বিয়ার সঙ্গে আমেরিকার প্রায় ৫৪ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা বাণিজ্য চলে, যার মধ্যে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কলম্বিয়ান পণ্য আমেরিকায় ঢোকে। স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকার এই শুল্ক যুদ্ধ কলম্বিয়ার যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি করে। খুব পরিষ্কার যে, ট্রাম্প প্রশাসন সরাসরি কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের রাস্তা নিতে চাইছে। কিন্তু এই চাপের কাছেও কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো আত্মসমর্পণ করেননি। তিনি বলেন, আমেরিকা কলম্বিয়ান অভিবাসীদের সঙ্গে অপরাধীদের মত আচরণ করতে পারে না। আগে অভিবাসী ফেরানোর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন এবং রীতিনীতি মেনে চলুক, তারপর আমেরিকা থেকে অভিবাসীদের ফেরত নেওয়া হবে। লাতিন আমেরিকার আরেক বামপন্থী রাষ্ট্রপতি মেক্সিকোর ক্লদিয়া শেইনবমও আমেরিকাকে এই প্রশ্নে তীব্র আক্রমণ করেছেন এবং মেক্সিকান অভিবাসীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন মেনে আচরণ করার দাবি তুলেছেন।

যদিও আমেরিকার সঙ্গে মেক্সিকোর ব্যবসা বাণিজ্য লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় বেশি, ফলে শুল্ক যুদ্ধে তাদের ক্ষতির সম্ভাবনাও বেশি। লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রপতিরা সমবেতভাবে বলেছেন, আমেরিকার এই আচরণ লাতিন আমেরিকার অধিবাসীদের মর্যাদায় ঘা দিয়েছে, যার যোগ্য জবাব দেওয়া হবে। চীন এবং কিউবাও এই ধরণের অভিবাসী প্রত্যর্পণ মেনে নেয়নি, ভেনিজুয়েলার তো কথাই নেই। সেদেশের সরকার আমেরিকার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কও রাখে না। আসলে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের যে আত্মমর্যাদা আছে তা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নেই। দুর্ভাগ্যের হলেও এটাই সারসত্য।

মোদীজি আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের নিয়ে বরাবরই উচ্ছ্বসিত। মোদী যখনই আমেরিকায় যান, সেদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্যে এবং তাদের পরিবারের লোকেদের জন্যে উপহার নিয়ে যান। ২০২৩ সালেই তিনি আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের স্ত্রীর জিলের জন্যে প্রায় ২০,০০,০০০ টাকার হীরের আংটি নিয়ে গিয়েছিলেন। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ট্রাম্প ও তাঁর পরিবার, এমনকি ট্রাম্পঘনিষ্ঠ শিল্পপতি, ফ্যাসিবাদী চরিত্রসম্পন্ন ইলন মাস্কের পরিবারের জন্যেও দামি উপঢৌকন নিয়ে গিয়েছিলেন। এক ফ্যাসিবাদীর আরেক ফ্যাসিবাদীকে নিয়ে উচ্ছাস অবশ্য খুবই স্বাভাবিক । কিন্তু নিজের এবং গোটা দেশের মানমর্যাদা তিনি যে এভাবে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে ট্রাম্পের সব কথাতেই ঘাড় নেড়ে চলে আসবেন – এমনটা বোধহয় আমেরিকার প্রশাসন কিংবা সংবাদমাধ্যমও ভেবে উঠতে পারেনি। বাণিজ্য যুদ্ধ এবং শুল্ক যুদ্ধের অস্ত্র ট্রাম্প লাতিন আমেরিকার দেশগুলির বিরুদ্ধেও ব্যবহার করেছেন কিন্তু চাপের কাছে তাঁরা এত সহজে গুটিয়ে যায় নি। ট্রাম্পের মতে এই কাগজহীন অভিবাসীরা সবাই অপরাধী। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর ক্ষেত্রে ট্রাম্পের অভিযোগ, সেখানকার সরকারগুলোই আমেরিকায় অপরাধমূলক কাজকর্ম করার জন্যে এদের পাঠিয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে একথা বলা হয়নি, কিন্তু কাগজহীন ভারতীয় অভিবাসীদেরও ট্রাম্প প্রশাসন অপরাধী বলেই চিহ্নিত করেছে। ফলে একইভাবে এই অভিবাসীদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং বন্দি অবস্থায় তাঁদের সঙ্গে ন্যূনতম মানবিক ব্যবহারও করা হয়নি।

এদিকে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই ভারতে আমেরিকান পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক নিয়ে সরব ছিলেন। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসামাত্রই ভারতের বাজেট ঘোষণায় সমস্ত মার্কিনি পণ্যের উপর শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও ট্রাম্প সন্তুষ্ট হননি। মোদী আমেরিকায় পা দেওয়ার পরের দিনই ট্রাম্প ‘আমেরিকাকে আবার মহান করো’(MAGA) জয়ধ্বনি দিতে দিতে তিনি ভারতীয় পণ্যের উপর গাদা শুল্ক চাপিয়ে দিলেন। মোদী চুপ, একটি কথাও তাঁর গলা দিয়ে বেরলো না। শুধু ট্রাম্পকে নকল করে করে ‘ভারতকে আবার মহান করো’(MIGA) বলে আমেরিকার ‘মাগা’ আর ভারতের ‘মিগা’ মিলেমিশে একটা মেগা ব্যাপার হবে – এমন একটা বোকা বোকা কথা বলে এলেন। এই আমাদের ৫৬ ইঞ্চি চওড়া ছাতির প্রধানমন্ত্রী!

ভারত-আমেরিকা বাণিজ্যের পরিমাণ কেমন? বাণিজ্য মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, গতবছর এপ্রিল থেকে এবছর জানুয়ারি পর্যন্ত ভারত আমেরিকায় রফতানি করেছে ৬৮.৪৭ বিলিয়ন ডলারের সামগ্রী আর আমদানি করেছে ৩৭.৬২ বিলিয়ন ডলারের মালপত্র। সুতরাং ভারতের দিক থেকে ভালরকমের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে।গোটা বছরের হিসাব করলে এই ঘাটতি আরও বেশি। মোট বার্ষিক ঘাটতি ৪৫.৬ বিলিয়ন ডলারের মত। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ কমানোর জন্যে ট্রাম্প মোদীকে পাশে বসিয়ে একগাদা বাতিল অস্ত্রশস্ত্র কেনার চুক্তিতে সই করিয়ে নিলেন। মোদী হাসিমুখে তাও করে এলেন। এরপর বেআইনি অভিবাসী প্রসঙ্গেও ট্রাম্পেরই পক্ষে দাঁড়ালেন। মুখ ফুটে এটুকুও বলে আসতে পারলেন না, যে আমাদের দেশের নাগরিকদের সঙ্গে অপরাধীর মত আচরণ করা চলবে না। লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে তুলনা করলে মোদীর এই আচরণ আমাদের লজ্জিত করে। ভারতের মত একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হবার উপযুক্ত যে এই ব্যক্তি নয়, তা আমাদের কাছে এক লহমায় পরিষ্কার হয়ে যায়।

কথায় বলে, জনগণ তার উপযুক্ত শাসকই পায়। এতকিছুর পরেও ভারতবাসীর মধ্যে ক্রোধ নেই, উত্তাপ নেই। ভারতবাসী মজে আছে কুম্ভস্নানে। মলমূত্রে ভরা জলে ডুব দিয়ে রোজ কোটি কোটি মানুষ পুণ্যার্জন করছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা স্লোগান দিচ্ছেন, ‘মহাকুম্ভে পুণ্যস্নান, এক হয়েছে হিন্দুস্তান!’ এভাবেই নাকি ভারত আবার মহান হবে। মোদীর মতে তা হবে আমেরিকার হাত ধরে। তারপর সেটা নাকি একটা ‘মেগা’ ব্যাপার হবে। ভারতবর্ষের রাজনীতির মঞ্চে যেন একটা হাস্যকরুণ যাত্রাপালা চলছে। আমরা, ভারতের আম-নাগরিকরা মুগ্ধ হয়ে তাই দেখছি দেখছি।