স্নেহাশিস চক্রবর্তী, পরিবহণমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
প্রতিবছর ২১ জুলাই, উত্তাল জনসমাগমের সাক্ষী এই শহর কলকাতা৷ শুধু তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী নয়, বাংলার আপামর গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের আবেগ মিশে থাকে ২১শে জুলাইয়ের শহিদ স্মরণসভাকে ঘিরে৷ সেই আন্দোলনই গণ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়, যা আমজনতার স্বার্থে পরিচালিত হয়৷ আবার সেই গণ আন্দোলনের রেশ যুগের পর যুগ সমাজে অণুরণন সৃষ্টি করতে পারে, যার ফল সামাজিক কোনও মৌলিক পরিবর্তনের সহায়ক হয়৷ আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক দেশ৷ স্বাধীনতার পর আমাদের দেশের সংবিধান রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে এই নীতিকেই গ্রহণ করেছিল৷ সাধারণ মানুষই থাকবে সরকার গঠনের নির্ণায়ক শক্তি৷ ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও কতগুলি দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল৷ কিন্ত্ত ওই সকল দেশের কর্ণধাররা মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার কথা ভাবেনি৷ ফলে ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আয়ুব খান বন্দুকের নল দেখিয়ে পাকিস্তান দখল করে নিয়েছিলেন৷ সামরিক অভু্যত্থান ঘটল পাকিস্তানে৷
১৯৬২ সালে ইন্দোনেশিয়ায় মিলিটারির বুটের তলায় মানুষের মৌলিক অধিকার বিসর্জিত হল৷ তারপর একে একে শ্রীলঙ্কা, ব্রহ্মদেশ, আফগনিস্তান এমনকি ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশেও গণতন্ত্র টেকেনি৷ কিন্ত্ত একমাত্র ভারতবর্ষে কিছু কিছু দুর্বলতা নিয়েও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতবর্ষ এটা আমাদের আত্মশ্লাঘা৷ তবুও আমাদের দেশে কখনও কখনও কোথাও কোথাও বাক্স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মৌলিক অধিকারগুলি ক্ষুণ্ণ হওয়ার ঘটনা ঘটে৷ সাধারণ মানুষকে লড়তে হয় এগুলির বিরুদ্ধে৷
দীর্ঘ ৩৪ বছর বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন অবস্থায় একদলীয় শাসন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপ অনুভব করেছে বাংলার মানুষ৷ একদিকে অনুন্নয়ন আর একদিকে সিপিএমের অত্যাচার বিরোধী মতাবলম্বী মানুষের ওপর অতিষ্ঠ করে তুলেছিল বাংলার মানুষকে৷ কিন্ত্ত প্রতিটি নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে ক্ষমতায় চলে আসার কৌশল সিপিএম শিল্পে পরিণত করেছিল৷ বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেস নেতৃত্বের গা বাঁচিয়ে চলার নীতি, কোথাও আবার সিপিএমের সঙ্গে বোঝাপড়া নীতিতে বিচারের পথ খুঁজে পাচ্ছিল না বাংলার মানুষ৷ কংগ্রেস রাজনীতির সেই ভঙ্গুর ভূমি থেকে জ্বলন্ত লাভা উদগিরণের মতো ছিটকে বেরিয়ে এলেন এক নেত্রী৷ অসহায়, অত্যাচারিত মানুষের সহায়সম্বল হয়ে দাঁড়ালেন— তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ পথ খুঁজে বের করলেন কীভবে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়৷ অচিরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও আন্দোলন সমার্থক হয়ে উঠল৷ যেখানেই মানুষ অত্যাচারিত, সেখানেই ছুটে গেলেন তিনি৷ বুঝতে অসুবিধা হল না, তাঁর বামফ্রন্টের ভোটে জেতার কৌশল৷ শুধু বাংলা নয়, আরও কিছু প্রতিবেশী রাজ্যেও ভোট পরিণত হয় প্রহসনে৷ তিনি দাবি করলেন, প্রতিটি ভোটারের হাতে একটি সচিত্র পরিচয়পত্র থাকা আবশ্যক৷ একজনের ভোট আর একজন দিয়ে দেওয়ার কৌশল ব্যর্থ হবে তাতেই৷
১৯৯৩ সালের ২১শে জুলাই মহাকরণের চারপাশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জমা হলেন লাখো লাখো মানুষ৷ মহাকরণের ভেতরে তখন নির্বাচন কমিশনের অফিস৷ সচিত্র পরিচয়পত্রের দাবিতে, এক শান্তিপূর্ণ জমায়েত৷ ভারতবর্ষের গণতন্ত্রকে মজবুত করার সেটা ছিল ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ৷ মহাকরণের ভেতরে সেইদিন ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু৷ শান্তিপূর্ণ সেই জমায়েতগুলিতে সেই সময় চলছিল নেতৃত্বের বক্তৃতা৷ কর্মীদের হাতে ছিল দলীয় পতাকা৷ বামফ্রন্টের পুলিশের গুলি চলল সেই শান্ত, নিরীহ জমায়েতের উপর৷ পুলিশি অত্যাচার নেমে এল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপরও৷ কতজন তরতাজা যুবক সেদিন প্রাণ হারালেন পুলিশের গুলিতে৷ এ ইতিহাস আমরা সকলেই জানি৷ ১৩ জন শহিদের রক্ত মিশেছিল কলকাতার মাটিতে৷ গঙ্গা নদীর জল চুয়ে সেই রক্ত পৌঁছলো সমগ্র বাংলায়৷ জন্ম দিল হাজার হাজার মিছিলের৷
সেই ১৩ জন শহিদের জীবন দেওয়া ব্যর্থ হয়নি৷ সেই আন্দোলনের জেরেই সারা ভারতবর্ষের ভোটাররা পেল সচিত্র পরিচয়পত্র৷ ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করার প্রাথমিক সোপান হিসেবে ২১ জুলাই দিনটি চিহ্নিত হয়ে থাকবে৷ তাই প্রতিবছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢেউ আছড়ে পড়ে কলকাতায় ২১শে জুলাইয়ের শহিদ স্মরণসভায়৷
১৩ জন শহিদের জীবন দেওয়া ব্যর্থ হয়নি, কারণ বাংলা আজ সিপিএম মুক্ত৷ কথা বলার অধিকার পেয়েছে বাংলার মানুষ৷ ১৩ জন শহিদের জীবন দেওয়া ব্যর্থ হয়নি, কারণ আজ বাংলার সর্বস্তরের, সর্বশ্রেমির মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে উন্নয়নের ফসল৷ বাংলা আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে৷ একদিকে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন ঘটেছে, তেমনই আর একদিকে অজস্র সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকতে গেলে যেসব প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তা (প্রাইমারি নিডস) লাগে, তা পূরণ করছে আমাদের সরকার৷
তিনটি কারণে ভারতবর্ষের যে কোনও সরকারের থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার স্বতন্ত্রতা দাবি করতে পারে৷ এক, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা— দিদি ২০১১ সালের নির্বাচনের আগে দলগতভবে ইস্তেহার আকারে যেসকল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সবকটি বাস্তবে রূপ পেয়েছে৷ ২০১৬ ও ২০২১-এর আগে দিদি যা বলেছিলেন, সবগুলিই তিনি রূপায়িত করেছেন৷
দুই, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিকে সার্বজনীন করা— বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আমাদের সকলের দিদি যাকিছু করেন, সকলের জন্য করেন৷ মুখ দেখে কাউকে পাইয়ে দেওয়াও যায় না৷ কিংবা বঞ্চিত করাও যায় না৷ সরকারি প্রকল্প জাতি, ধর্ম, বর্ণ, রাজনীতি নির্বিশেষে সবার জন্য৷
তিন, প্রকল্পের সুবিধা যাতে প্রতিটি মানুষ পায়, যেন কেউ বঞ্চিত না থাকে, তা ‘দুয়ারে সরকার’-এর মতো একটি অভিনব সরকারি কর্মসূচি দ্বারা নিশ্চিত করা হচ্ছে৷ বিভিন্ন জাতি, উপজাতি, জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান তাই উন্নত হচ্ছে৷
আজও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমানভাবে লড়াই চালাচ্ছেন এক অন্য আঙ্গিকে৷ আজ দিদির লড়াই সমাজ থেকে দারিদ্রতা-অপুষ্টি দূর করার লড়াই৷ লড়াই অশিক্ষা দূর করা, চিকিৎসাহীনতা দূর করা৷ তাই ১৩ জন শহিদের জীবন দেওয়া ব্যর্থ হয়নি৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুযোগ্য নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বহু উন্নয়ন প্রকল্প জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে৷ উন্নয়নের সাথে যুক্ত করতে পেরেছেন বাংলার আমজনতাকে৷ তাই প্রতিটি নির্বাচনে দিদির প্রতি জনসমর্থন বাড়ছে ক্রমশ৷ আজ প্রমামিত হয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু এক আন্দোলনের নেত্রী নন, তিনি দক্ষ প্রকাশকও বটে৷
যতদিন ভারতে গণতন্ত্র থাকবে, ততদিন ২১শে জুলাইয়ের জীবনদানের কথা স্মরণ করবে মানুষ৷