• facebook
  • twitter
Thursday, 9 January, 2025

২০২৩-২৪-২৫: বছর যায় আসে কিন্তু আমাদের আশঙ্কা দূর হয় না

সংসদীয় গণতন্ত্র আজ মুখ থুবড়ে পড়ছে। কী রাজ্য, কী কেন্দ্র—রাজনৈতিক মতবাদ নির্বিশেষে শাসকদলের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ক্রমশঃ বাড়ছে। দেশ ও দশের স্বার্থে তাঁরা যা ‘করার নয়’ তাই করে চলেছেন আর ‘যা করা’র কথা— তা-ই তাঁরা অত্যন্ত সচেতনভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন! অথচ মুখে এদের গণতন্ত্রের খই ফোটে। আসল ট্র্যাজেডিটা বোধহয় এখানেই। অন্যদিকে দেশের নির্বাচকমণ্ডলী নানাবিধ জটিল সমস্যার জালে আটকে পড়ে শাসকদলের জনবিরোধী কাজের বিরোধিতায় পথে নেমে প্রতিকারে নিতান্তই অপারগ।

ফাইল ছবি

শোভনলাল চক্রবর্তী

২০২৩ সালের শেষ দিনটিতে একটি সর্ব-ভারতীয় ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদকীয় স্তম্ভে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল যে, ভারতীয় গণতন্ত্র কি নির্বিবাদে একাধিপত্যের কৃষ্ণগহ্বরে প্রবেশ করছে? সেই প্রশ্নে নিহিত ছিল গভীর আশঙ্কা। ভারতীয় রাষ্ট্রের শাসকদের সর্বগ্রাসী আধিপত্য বিস্তারের উৎকট অভিযান থেকে উঠে এসেছিল আশঙ্কা।২০২৪ সালে নির্ধারিত লোকসভা নির্বাচনে শাসকরা তাঁদের মেরুকরণের প্রযুক্তি ও কৌশল প্রয়োগ করে আধিপত্যের ভিত আরও মজবুত করে তুলবেন, এমন সম্ভাবনা প্রবল আকার ধারণ করেছিল সেই সময়ে। ভারতের পরম সৌভাগ্য, সেই আশঙ্কা সত্য হয়নি। এই সৌভাগ্য কোনও পড়ে-পাওয়া চোদ্দো আনা নয়, আপন শক্তিতে তাকে অর্জন করে নিয়েছে এ দেশের জনসমাজ। বহু জল্পনা, বিপুল প্রচার এবং রকমারি পূর্বাভাসকে মিথ্যা প্রমাণ করে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন আক্ষরিক অর্থেই ইতিহাস রচনা করেছিল।সেই বর্ষশেষের প্রশ্নের উত্তরে জনাদেশ সপাটে জানিয়ে দিয়েছে: না, কোনও কৃষ্ণগহ্বর তার মর্যাদাকে গ্রাস করতে পারেনি। রাজা বদলায়নি, কিন্তু জনতার রায়ে রাজশক্তি পরনির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়েছে। শাসকের আধিপত্য ভাঙেনি, কিন্তু মচকেছে। গণতন্ত্রের নিজস্ব যুক্তিতেই এই ঘটনা অ-সামান্য। ২০২৪ ছিল এই কারণেই ঐতিহাসিক।

এখন প্রশ্ন, নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনা পরম্পরায় সেই ঐতিহাসিকতা কি তার প্রাপ্য মর্যাদা পেয়েছে? শাসক এবং বিরোধী, দুই শিবিরের নায়ক নায়িকারা কি আপন আপন কর্তব্য পালন করেছেন? দুর্ভাগ্যের কথা এবং উদ্বেগের কথা এই যে, এই প্রশ্নেরও নিঃসংশয় উত্তর: না। শাসকের কাজ ছিল জনমতের অন্তর্নিহিত অনুজ্ঞাকে আন্তরিক স্বীকৃতি দিয়ে একাধিপত্যের কুপথ ছেড়ে একটি সত্যকারের উদার, সহিষ্ণু, আলোচনাভিত্তিক শাসনের নবনির্মাণে মন দেওয়া। কিন্তু তাঁদের কাছে তেমন আত্মশুদ্ধির প্রত্যাশা করা বোধ করি নিছক বাতুলতা। একাধিপত্য তাঁদের স্বর্গ, তাঁদের ধর্ম, তাঁদের পরমং তপঃ। অতএব অভ্যস্ত তৎপরতায় সংসদীয় সংখ্যার ঘাটতি পুষিয়ে নিয়ে তাঁরা অতি দ্রুত নিজমূর্তি ধারণ করেছেন, ‘এক দেশ এক ভোট’ সহ বিবিধ উদ্যোগ নিয়ে তৎপরতা বাড়ছে, কৃষ্ণগহ্বর উত্তরোত্তর প্রকট হচ্ছে। অন্য দিকে, বিরোধী মঞ্চের সংহতি দূরস্থান, সমন্বয়ের চেহারাও ক্রমশই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে চলেছে। একাধিক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে ‘অস্বাভাবিক’ বিপর্যয়েও দলনেতাদের সম্বিৎ ফেরেনি। শাসক শিবিরের কোন নেতা কখন ‘মুখ ফস্কে’ বাবাসাহেব আম্বেডকরের নাম আপত্তিকর ভঙ্গিতে উচ্চারণ করবেন, সেই ভরসায় যদি বিরোধী দলগুলি বসে থাকে, তবে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে না।

আধিপত্যবাদী শাসক এবং ছন্নছাড়া বিরোধী শিবিরের এই সমাহার বিভিন্ন রাজ্যেও প্রকট। পশ্চিমবঙ্গ তার ব্যতিক্রম নয়। দুর্নীতি এবং দুঃশাসন অনেক দিন যাবৎ এই রাজ্যের মজ্জাগত ব্যাধিতে পরিণত, সেই ব্যাধির প্রকোপ উত্তরোত্তর বাড়ছে। কেন্দ্রের শাসক দলটিই এ-রাজ্যে প্রধান বিরোধী, সুতরাং গণতন্ত্র কার্যত উভয় সঙ্কটে। এই পরিস্থিতিতেই চিকিৎসক শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক হত্যাকে কেন্দ্র করে সুদীর্ঘ সামাজিক বিক্ষোভ এক নতুন এবং কার্যত অভূতপূর্ব সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, যে সম্ভাবনার কারণে ২০২৪ সাল কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের সচেতন নাগরিকদের কাছে স্বতন্ত্র মর্যাদা দাবি করতে পারে। সেই দাবি পূরণ করতে হলে সামাজিক আন্দোলনকে আরও অনেক দূরে যেতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ এখন বহু দিক থেকেই এক ব্যর্থ, হতাশ, মধ্যমানের রাজ্যে পরিণত। নিজেকে নিয়ে তার যথার্থ গৌরববোধ নেই, সুতরাং সামাজিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক নবজাগরণের স্বপ্ন দেখতেও সে ভুলে গিয়েছে। বছরের শেষ কয়েক মাসে যে সামাজিক আলোড়ন দেখা গেল, তার গভীর থেকে সেই স্বপ্নের পুনর্জন্ম হবে কি না, ২০২৫ – এর কাছে সেই প্রশ্নই রেখে বিদায় নিয়েছে ২০২৪ সাল।

আড়াই হাজার বছর আগে গোটা উপমহাদেশ জুড়ে ছড়ানো সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন অশোক। ব্যক্তিগত ভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও অশোকের শিলালেখতে বার বারই ফুটে উঠেছে ব্রাহ্মণ এবং শ্রমণদের প্রতি সমদর্শিতার কথা। ব্রাহ্মণ এবং বৌদ্ধ শ্রমণ, ধর্মীয় দর্শনের দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি প্রান্তে অবস্থান। রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিপরিসরে বৌদ্ধ অশোক কিন্তু ভিন্নমতের অনুসারীদের প্রতি বৈর দেখাননি। তাঁর প্রায় দু’হাজার বছর আকবরও বৈরের পথে হাঁটেননি। নিজে মুসলমান হয়েও তিনি ভিন্ন মতাবলম্বীদের দূরে ঠেলে দেননি। বরং বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিদের নিয়ে বিতর্কের আহ্বানও করেছেন। রাষ্ট্রকে সব ধর্ম থেকে সমান দূরত্বে রাখার পন্থাও ছিল তাঁর।ভারতের ইতিহাসে কখনও কোনও একটা মত গোটা রাজত্বের উপরে চেপে বসেনি। ভিন্ন মতের মধ্যে বিতর্কের পরিসর তৈরি করেই ক্রমাগত সচল থেকেছে দেশ। প্রাচীন সময় থেকে চলে আসা এই বিরুদ্ধ স্বরের প্রাসঙ্গিকতা উঠে এসেছে রোমিলা থাপরের ভয়েসেস অব ডিসেন্ট বইয়েও। উপমহাদেশের মানুষ কী ভাবে বিরোধিতা করেছে এবং কী ভাবে পরস্পরবিরোধিতা থেকেও ঐকমত্যে উত্তীর্ণ হয়েছে, তা দেখিয়েছেন রোমিলা।তা হলে ভারতে কি বহু আগে থেকেই গণতন্ত্র ছিল? মোটেও না। আধুনিক গণতন্ত্রের ধারণা অনেক পরবর্তী সময়ে পাশ্চাত্য থেকে এসেছে। কিন্তু গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন নয়, বরং গণতন্ত্রের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য রাষ্ট্র এবং নাগরিকের সংলাপ। বিতর্ক, ভিন্ন মতের দ্বন্দ্ব সেই সংলাপকেই জারি রাখে।

সেই পরিসর কিন্তু ভারতের অতীতে বার বার এসেছে। শুধু রাষ্ট্রীয় আচারেই নয়, সামাজিক বা ধর্মীয় পরিসরেও ভিন্ন মতের স্বীকৃতি ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে, যা স্বাধীন ভারতের গণতান্ত্রিক রীতিতেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তাই ডান, বাম, হিন্দুত্ববাদী, নাস্তিক— সকলেই সংসদীয় ব্যবস্থায় ঢুকে পড়েছিলেন। জওহরলাল নেহরুর আমলে সংসদে হওয়া একের পর এক বিতর্ক, শাসককে বিঁধে বিরোধীদের চোখা চোখা বাক্যবাণ আজও দেশের সংসদীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল রত্নভান্ডারের অংশ। উপমহাদেশে বিরুদ্ধ মতের স্বীকৃতি এবং তর্কের পরিসরের কথা বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছেন অমর্ত্য সেন। তাঁর দি আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান বইয়ে বলেছেন যে, ভারতীয় সংস্কৃতিতে ধর্ম, পুরাণ, মহাকাব্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সেই গুরুত্বকে মুসলিম শাসকেরাও অগ্রাহ্য করেননি। আবার একই সঙ্গে সংশয়বাদী ভাবনাও ভারতীয় সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত আছে। তাই পুরাণ এবং মহাকাব্যের পাশাপাশি সংশয়বাদী দর্শনকে বাদ দিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতিকে বুঝতে চাওয়া ‘বোকামি’।অধ্যাপক সেনের সূত্র ধরেই এক বার মহাকাব্যে চোখ ফেরানো যাক। কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে যুদ্ধ শুরুর আগে অর্জুন বেঁকে বসলেন। বিপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা জ্ঞাতিভাইদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে নারাজ তিনি। সেই যুদ্ধ শুরুর আগেই পার্থ এবং তাঁর সারথির ‘বাগ্‌যুদ্ধ’ হয়ে গেল। সেই বিতর্কই সঙ্কলিত হল ‘গীতা’ হিসেবে। অথবা বৌদ্ধ ধর্মের কথাই ধরা যাক। খোদ গৌতম বুদ্ধই বার বার বিতর্কের কথা বলেছেন, দ্বন্দ্ব-বিতর্কের মাধ্যমেই নতুন পথের সন্ধান করতে বলেছেন।

গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পরে তাই সঙ্গিতীর মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্ম তার নতুন ভাবনা, নতুন রূপকে খুঁজে নিয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশই বৈদিক দর্শনের পাশাপাশি নাস্তিক্যবাদী দর্শনকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছে। তাই সংখ্যালঘু হয়েও মোগল আমলেও চার্বাক দর্শন বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। বরং আকবরের আয়োজিত বিতর্কসভায় চার্বাক দার্শনিকদের উপস্থিতির কথাও জানা যায়। প্রতিবেশী দুই দেশে মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত দেখে ভারতীয় উপমহাদেশের চরিত্র সন্ধান আরও জরুরি হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনে রাজনৈতিক ভাবে দু’টি ভিন্ন (১৯৭১ সালের পর তিনটি) রাষ্ট্র তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু সংস্কৃতিগত ভাবে ভিন্নতা তৈরি হল কেন? তার উত্তর খুঁজতে গিয়েই যে কথা সামনে আসে, তা হল, পাকিস্তান গঠন হয়েছিল মুসলিমদের রাষ্ট্র হিসেবে। অর্থাৎ যে ভারতীয় উপমহাদেশ হাজার-হাজার বছর ধরে বিবিধ ধর্ম, সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র এবং আবাসস্থল হয়ে ছিল, তার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকেই অস্বীকার করে তৈরি হয়েছিল পাকিস্তান। পরবর্তী কালে বাংলাদেশও পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুবাদের উত্তরাধিকার থেকে মুক্ত হতে পারেনি। পাকিস্তান গঠনের সময় রাষ্ট্র নিজের ধর্মীয় চরিত্র নির্ধারণ করে ফেলায় ভিন্ন মত এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের পরিসরও উবে গিয়েছিল। রাষ্ট্র এবং নাগরিকের মধ্যে অনবরত সংলাপের পরিসর না থাকায় গণতান্ত্রিক কাঠামো সে দেশে কার্যত পাটকাঠির প্রাসাদ হয়ে উঠেছে।

মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার নিয়ে তৈরি হওয়া বাংলাদেশও কিন্তু গণতন্ত্রের সুদৃঢ় ভিত্তি তৈরি করতে পারেনি। বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে আছে ভারত। এ দেশেও গণতান্ত্রিক পরিসরকে খর্ব করার চেষ্টা, সংখ্যাগুরুবাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে। ভারত ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা দেখেছে। চরম সঙ্কটেও সে কিন্তু প্রত্যুত্তর দিতে ভরসা রেখেছে গণতন্ত্রে। ১৯৭৭ সালে দেশ জুড়ে কংগ্রেসের পরাজয়ই ছিল দেশবাসীর উত্তর। বর্তমান ভারতেও যে হিন্দুত্ববাদী প্রচার চলছে, ‘এক দেশ, এক শাসন’-এর ঢক্কানিনাদ শোনা যাচ্ছে তা রুখতেও নাগরিক স্বর সরব। সেই স্বরকে রুদ্ধ করার চেষ্টা হয়নি, এমন বলা যায় না। তবে তার খেসারত লোকসভা ভোটে বহু রাজ্যেই দিতে হয়েছে দেশের শাসক দলকে।এই আকালে ভারতের ধমনীতে বয়ে চলা এই বিরুদ্ধ মতের স্বীকৃতিটুকু, শাসকের বিরুদ্ধ ভাষ্যের উপস্থিতিই আমাদের আশার আলো।