ঝড়-জলে দেড়শো বছর

ফাইল চিত্র

ইন্ডিয়ান মেটিওরোজলিক্যাল ডিপার্টমেন্ট (আইএমডি) দেড়শো বছরে পা রাখল ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫। ভারতের আবহাওয়া দপ্তরের এই গৌরবোজ্জ্বল দেড়শো বছর পূর্তিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে কেন্দ্রীয় সরকার।

১৮৬৪ সালে বিধ্বংসী এক ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল কলকাতা ও তার আশপাশে। প্রাণ গিয়েছিল প্রায় ৬০ হাজার মানুষের। এরপর বছর খানেকের মধ্যে ১৮৬৬ সালে ওড়িশায় আর ১৮৭৩-এ বিহারে ভয়ানক দু’টি আকাল লেগেছিল। ইতিহাস বলে, সেই জোড়া দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারান প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ। পরের পর এমন বিপর্যয়ে ভাবতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশরা। ঝড়-ঝাপটা নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজগুলিকে আগাম সজাগ করার ভাবনা থেকেই খান কয়েক গেজ নিয়ে ১৮৭৫ সালের মাঝামাঝি এসপ্ল্যানেড রো-র একটি বাড়ি থেকে শুরু হলো বৃষ্টি মাপার কাজ। সেই হিসেবের রিপোর্ট বড়লাটকে নিয়মিত পাঠাতেন হেনরি ক্ল্যানফোর্ড। তিনিই ভারত সরকারের প্রথম মোটিওরোলজিক্যাল রিপোর্টার। তখনই সূচনা হয় ‘ইন্ডিয়ান মোটিওরোজলিক্যাল ডিপার্টমেন্ট’ (আইএমডি)। কলকাতার জিওলজিক্যাল সার্ভের কিছু ফেলে দেওয়া যন্ত্র নিয়েই ব্ল্যানফোর্ড বানিয়ে ফেলেন গোটা ভারতের বৃষ্টিপাতের এক পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র। ৭৭টি রেইন গজের ডেটা ব্যবহার করে আঁকা হয়েছিল বার্মা থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত ভারতের রেইনফল ম্যাপ। সেই সূত্রপাত। তারপর আড়ে-বহরে সংস্থাটি প্রসারিত হয়ে ধীরে ধীরে আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে আরও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। গোটা বিশ্বকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া শেখালো যে প্রতিষ্ঠান, আজ দেড়শো বছরে পড়বে তা। এই বছরগুলিতে সেদিনের সেই ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে ভালো আবহাওয়া সংস্থা।

২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুসারে, ৩৯টি ডপলার র্যাডার অপারেট করে আইএমডি। ইনস্যাট ৩ডি/৩ডিআর-এর সাহায্যে ১৫ মিনিটের মধ্যে মেঘ সংক্রান্ত খবরাখবর দিতে পারে আইএমডি। এছাড়া আইএমডি-র হাতে রয়েছে ৮০৬টি অটোমেটিক ওয়েদার স্টেশনের একটা জোরদার নেটওয়ার্ক, ২০০ অ্যাগ্রো এডব্লিউএস, ৫৮৯৬টি রেইন মনিটরিং স্টেশন, ৮৩টি লাইটনিং সেন্সর ও ৬৩টি পাইলট বেলুন স্টেশন। শুধু এটাই নয়, ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর উপগ্রহ ছবির মাধ্যমে ৬ মিনিটের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত অনুমান করে ফেলতে পারে। এত সব গুণাবলী নিয়েই দেড়শো বছরে পা রাখলো আইএমডি।


এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৮৫ সালে কলকাতা ও মাদ্রাজে আবহাওয়া কেন্দ্র তৈরি করে। পরে এশিয়াটিক সোসাইটির দৌলতে ভারতীয় উপমহাদেশের আবহাওয়া নিয়ে নানা রকম গবেষণাও শুরু হয়। তখন যদিও ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজগুলিকে সতর্ক করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। পরে যদিও জরিপ, কৃষি খাতে রাজস্ব আদায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিস্তার, সামরিক অভিযান এবং পরপর বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় ও আকালে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুতে আবহাওয়া নিয়ে ব্রিটিশদের গবেষণার অভিমুখ ও উদ্দেশ্য খানিকটা পাল্টাতে হয়।

ব্ল্যানফোর্ড সাহেবের কয়েক বছর পর, ১৮৮৯ সালে ভারতের আবহাওয়া দপ্তরের প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পান স্যারজন এলিয়ট। তাঁর উদ্যোগে কলকাতা সহ সিমলা, পুণে এবং সব শেষে দিল্লিতে আবহাওয়া দপ্তরের বিশেষ নজরদারি শাখা তৈরি করা হয়। সেই টেলিগ্রাফের যুগেই ভারতের আবহাওয়া দপ্তরে এশিয়ার মধ্যে সব থেকে উন্নত মানের প্রযুক্তি মোতায়েন করা হয়। এছাড়াও বিশ্বের সব থেকে সক্রিয় ‘আবহাওয়া সতর্কতা পরিকাঠামো’ এখানেই ব্যবহার করা শুরু হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘নতুন ভারত’ নির্মাণে যে কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, আইএমডি তার মধ্যে অন্যতম। স্বনির্ভরতার প্রথম কয়েক দশকে ভারতের আবহাওয়া দপ্তরের প্রুযুক্তিগত উন্নয়নের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে বিশেষ সহযোগিতা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ‘রেডিয়োসোন্ড’ এবং ‘ওয়েদার রাডারের’ মতো উন্নতমানের প্রযুক্তি দেওয়া থেকে শুরু করে ‘মিটিওর’ সংক্রান্ত নানা তথ্য নিয়মিত জানিয়ে সোভিয়েত আবহাওয়া দপ্তর আইএমডি-কে সাহায্য করে এসেছে। এছাড়াও ১৯৭৫ সালে দেশের প্রথম উপগ্রহ ‘আর্যভট্ট’ এবং পরে ভাস্কর-১ ও ভাস্কর-২ মহাকাশে সফলভাবে নিক্ষেপ করার ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা বিশেষভাবে স্মরণীয়।

বিপর্যয় মোকাবিলা, কৃষি উন্নয়ন, বৃষ্টি কিংবা খরার পূর্বাভাস, এমন যাবতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা নিয়েসার্বিক সময়ে প্রয়োজনীয় তথ্য জানিয়ে দেশের কৃষক, মৎস্যজীবী, মাঝিমাল্লা ও অন্যান্য খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশীদার হয়ে ওঠে আবহাওয়া দপ্তর। কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের প্রতি নির্ভরতা কমে গিয়ে বাস্তবতার সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপর্যয় মোকাবিলায় মানুষের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। নতুন ও আধুনিক ভারত গড়ে তুলতে তাই আইএমডি-র ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না।