শোভনলাল চক্রবর্তী
কবি সেই কবেই লিখে গেছেন “লিখন তোমার, ধুলায় হয়েছে ধুলি”, আজ কবির সেই লেখা এক অন্য মাত্রা নিয়ে ফেরত এসেছে আমাদের মধ্যে। একবার ব্রিটেনে জর্জ বার্নার্ড শ একটি সভায় বক্তৃতা দেওয়ার পরে চায়ের আসরে এক অতিথি তাঁকে বলেছিলেন: আপনার বক্তৃতা ভাল, তবে আপনার লেখা আরও অনেক ভাল। তিনি হেসে জবাব দিয়েছিলেন: আসলে লেখার পিছনে যত সময় দিই, লেখা ভাল করার জন্য যত পরিশ্রম করি, বলার জন্য তো তা করি না, করলে হয়তো আর একটু ভাল বলতে পারতাম। কথাটি মূল্যবান। অনেক কাজের মতোই লেখার কাজটিও অনুশীলন দাবি করে। করারই কথা। ভাষা ভাব প্রকাশের বাহন, সুতরাং তাকে যথাযথ চালনার জন্য দক্ষতা আবশ্যক; সেই দক্ষতা আকাশ থেকে পড়ে না, তা অর্জন করতে হয়।
সুলেখক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ‘সহজাত’ বা ‘স্বাভাবিক’ স্বাচ্ছন্দ্যের গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু দু’টি বিষয়ে সতর্ক না হলে স্বাভাবিকতাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। প্রথমত ‘স্বভাব’ স্বয়ম্ভু নয়, তার পিছনেও অনুশীলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য— প্রথম সারির লেখকদের অধিকাংশের জীবনবৃত্তান্তে উঁকি দিলেই দেখা যাবে, লেখার কাজটিতে তাঁরা কতখানি পরিশ্রমী ছিলেন। দ্বিতীয়ত, যার যে স্বাভাবিক সামর্থ্যই থাকুক, তাকে প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই।এই সত্যটিই অন্যভাবে— বিপরীত দিক থেকে— প্রকট হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায় যে অনুশীলনের অভাবে বা ভুল অনুশীলনের পরিণামে কী ভাবে সুলেখকের বদলে কুলেখক তৈরি হতে পারে। এক জন দু’জন নয়, বর্ষে বর্ষে দলে দলে।
সম্প্রতি কলকাতার একাধিক স্কুলের বেশ কয়েক জন অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল শিক্ষকের কথায় এই সমস্যার রূপ ধরা পড়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, ছাত্রছাত্রীদের লেখার অভ্যাস ভয়ানক ভাবে নষ্ট হচ্ছে। এবং তার একটি বড় কারণ তাদের দৈনন্দিন জীবনে ডিজিটাল মাধ্যমের প্রবল প্রভাব। স্কুলের পড়াশোনার বাইরে, অংশত তার মধ্যেও, পড়া এবং লেখা বলতে যা কিছু তার প্রায় সবটাই এখন মোবাইল-বাহিত। তাদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ কার্যত ষোলো আনাই নানা ধরনের সংক্ষিপ্ত বার্তা লেনদেনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়ে চলে। কোনও বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে বিশদভাবে কিছু লেখা বা পড়ার অবকাশ নেই, প্রয়োজনও নেই, সবাই অতি দ্রুত সওয়াল-জবাব চালাতে আগ্রহী, কথোপকথন হয়ে দাঁড়িয়েছে টেবিল টেনিসের অনুরূপ।
সমাজমাধ্যমের যে পরিসরগুলি অল্পবয়সিদের পছন্দসই, সেখানে ‘গুছিয়ে লেখা’র কোনও প্রশ্নই ওঠে না। শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, এই অভ্যাসের সুস্পষ্ট ছাপ পড়ছে শিক্ষার্থীদের লেখায়। যারা ‘ভাল ছাত্রছাত্রী’ বলে পরিচিত ও প্রশংসিত তাদেরও একটি বড় অংশ সুচারু ও সুশৃঙ্খল ভাবে কোনও লেখা লিখতে পারে না, এমনকি আনুষ্ঠানিক বা পোশাকি চিঠিপত্র অবধি লেখার দক্ষতাও তাদের অনায়ত্ত। লেখা তাদের কাছে সচরাচর একটি দায়সারা কাজমাত্র, কোনও ক্রমে সেই দায় সেরে ফেলেই তারা সন্তুষ্ট। বলা বাহুল্য, এই সমস্যা ওই কয়েকটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নয়, দুনিয়া জুড়ে সমস্ত বয়সের নাগরিকদের মধ্যেই তার প্রকোপ ভয়াবহ আকার নিয়েছে। তবে সঙ্গত কারণেই অল্পবয়সিদের নিয়ে উদ্বেগ সর্বাধিক, বিভিন্ন দেশেই শিক্ষাবিদরা সেই উদ্বেগ জানিয়ে চলেছেন। ডিজিটাল মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার এই সমস্যার একটি বড় কারণ, তবে তার পাশাপাশি বিদ্যাচর্চার গোটা ব্যবস্থাটির দায়ও কম নয়। কোনও বিষয়ে সুষ্ঠু ধারণা অর্জন করা এবং যুক্তি সহকারে চিন্তা করতে শেখা— শিক্ষার এই প্রাথমিক লক্ষ্যগুলিই অধুনা দূর থেকে আরও দূরে বিলীয়মান। বাঁধাধরা পাঠ্যসূচি এবং তার ভিত্তিতে প্রদত্ত ক্লাস-নোট গলাধঃকরণ করে ‘এক কথায়, প্রায়শই ‘এক শব্দে’, প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার রীতি বহুলপ্রচলিত, যা উত্তরোত্তর পর্যবসিত হচ্ছে একাধিক সম্ভাব্য উত্তরের মধ্যে থেকে ঠিক উত্তর বেছে নেওয়ার পরীক্ষায়। এই পদ্ধতি সুশৃঙ্খল চিন্তা ও যুক্তিপ্রয়োগে সাহায্য করা দূরে থাকুক, তার সমস্ত সামর্থ্য ধ্বংস করে চলে। তার ফলে দেখা যায়, বহু ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় ভাল ফল করেছে, কিন্তু অধীত বিষয়ে অথবা চার পাশের জগৎ ও জীবন নিয়ে সাধারণ ধারণার ভিত্তিতে গুছিয়ে কথা বলতে বা লিখতে অপারগ। অর্থাৎ, ব্যাধি শিক্ষার মূলে।
সচেতন শিক্ষক ও অভিভাবকদের সমবেত উদ্যোগ ছাড়া নিরাময়ের আশা নেই। এ দেশে, বিশেষত এই রাজ্যে, সেই উদ্যোগের কোনও বিকল্প নেই, কারণ সরকারি নীতিকার তথা রাজনীতির নায়কনায়িকারা এই সব বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন। নাগরিকদের সুশৃঙ্খল চিন্তাভাবনার অভ্যাস না থাকলেই বোধ করি তাঁদের পোয়া বারো। শিক্ষাতত্ত্বের গুরুগম্ভীর আলোচনায় আমরা প্রায়শই সর্বাত্মক মূল্যায়নের কথা বলি। এই বহুমাত্রিক মূল্যায়নের মূল কথা হল, যৌক্তিক ধারণার বিকাশ, বিচার করার ক্ষমতা, কল্পনাশক্তি, বিশ্লেষণের দক্ষতা। রচনাত্মক প্রশ্নোত্তর ছাড়া এই দক্ষতাগুলির একটিও অর্জন করা সম্ভব নয়। এক জন শিক্ষার্থী স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে পারবে না, বরং কতকগুলো নির্দেশ পালনে দক্ষ হবে, এই শিক্ষাব্যবস্থার দাবি আজ এটাই। দিন কয়েক আগে স্নাতকোত্তর ও স্নাতক স্তরের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষার ইংরেজি প্রশ্নপত্র নজরে এল। শতাধিক প্রশ্ন যাতে শিক্ষার্থীর সাহিত্যবোধ, কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতাকে বোঝার চেষ্টা নেই, আছে কেবল তথ্যের নির্ণয়। সমস্যাটা শুধু সাহিত্য বা সমাজ বিজ্ঞানের নয়,বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও বিষয় জ্ঞান বোঝার জন্য ‘স্টেপ মার্কিং’-এর ব্যবস্থা ছিল, যা এই মডেলে দরকারই পড়ে না। আশার কথা হল, দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি এন্ট্রান্স টেস্টের নতুন পরীক্ষাপদ্ধতির বিরোধিতায় সরব হয়েছেন।
বোঝা যায়, এই মডেলে শিক্ষার্থীরা ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর পাবে, পাশের হার বাড়ার ফলে শিক্ষাকর্তাদের দুশ্চিন্তা কমবে, কিন্তু তৈরি হবে বিষয়ের গভীরতাহীন, যৌক্তিক ভাবনাহীন এক নতুন প্রজন্ম। যে যত মুখস্থ করতে পারবে, সে তত সফল হবে। প্রকৃত শিক্ষা তর্ক করতে শেখায়, প্রচলিত মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করতে শেখায়, শিক্ষার্থীকে কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে অজানা আকাশে উড়তে উদ্দীপ্ত করে। প্রথাগত শিক্ষার হাজারো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেই সুযোগ কিছুটা হলেও ছিল। এমসিকিউ আসলে আজকের ভারতের জন্য অন্য তাৎপর্য বয়ে আনছে। আমরা আসলে তৈরি করতে চাইছি এক ধরনের তথ্যকেন্দ্রিক রোবট, সব কিছু যে প্রশ্নহীন আনুগত্যে মেনে নেবে, রাষ্ট্রনির্ধারিত ‘ঠিক উত্তর’টিকে চয়ন করা ছাড়া যে শিক্ষার্থীর আর কোনও কাজ অবশিষ্ট থাকবে না।মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চন (এমসিকিউ) এই মুহূর্তে শিক্ষার্থী-মূল্যায়নের সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদা যা শুরু হয়েছিল চাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রে সহজ ও নিরাপদ উপায় হিসাবে, তা আজ সর্বব্যাপ্ত। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রবেশিকা পরীক্ষা হোক বা ডাক্তার-এঞ্জিনিয়ারিং, এমসিকিউ বিনা গীত নাই।
সম্প্রতি এ রাজ্যে নতুন সিলেবাসে প্রথম ও তৃতীয় সিমেস্টারে পুরো পরীক্ষাটাই হবে সঠিক উত্তরের তলায় দাগ দেওয়ার আঙ্গিকে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ যুক্তি হল কম্পিউটার যে কোনও মূল্যায়ন সহজে ও অতি দ্রুত করতে পারে। অবশ্য একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং প্রযুক্তির বিপর্যয় এই ধরনের পরীক্ষার নিরপেক্ষতার দাবিকে অনেকাংশে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নটা জীবন্ত থাকছে, তা হল এই ভাবে শিক্ষার্থীর সঠিক মূল্যায়ন আদৌ সম্ভব কি!এই এমসিকিউ মডেলকে সর্বরোগহর বলে বিবেচনা করার ভাবনার উৎস এক কল্পিত ধারণা যা মনে করে কম্পিউটার থেকে উৎসারিত সব কিছুই পবিত্র, এবং যে মূল্যায়নে মানবমেধা যুক্ত, তা দূষিত। এই মডেল শিক্ষার্থীর কাছে দাবি করে কুইজ়ের মতো জ্ঞান, মস্তিষ্কে জমা হবে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ তথ্য একক যা শিক্ষার্থী তোতাপাখির মতো মুখস্থ করবে। শিক্ষার্থী অক্লেশে বলে দেবে কোন সালে এবং কোন তারিখে কার্ল মার্ক্সের কমিউনিস্ট ইস্তাহার প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু সেই ইস্তাহারের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তার জানার দরকার পড়বে না। অনেকে বলবেন এমসিকিউ মডেলে ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নও থাকে। মজার কথা, সেই ব্যাখ্যা বা কোনও বিবৃতি পরবর্তী একাধিক সিদ্ধান্ত আসলে প্রশ্নকর্তা নির্ধারিত সমাধানমালা, যা থেকে প্রশ্নকর্তা মনোনীত ঠিক উত্তরটিকে চয়ন করার দায়িত্ব শিক্ষার্থীর। এখানে নিজের ভাবনাকে প্রকাশ করার বা নিজের যুক্তিটিকে উপস্থিত করার কোনও সুযোগই নেই শিক্ষার্থীর। এই মডেলে তাই টেক্সট বই পড়ার কোনও উৎসাহ আর অবশিষ্ট থাকবে না। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় হাঁটলেই দেখা যাচ্ছে প্রতিটি বিষয়-পিছু হাজার হাজার এমসিকিউ সম্বলিত রংবেরঙের সহায়িকা, বিষয়ভিত্তিক টেক্সট বই সেই সহায়িকার চাপে মুখ লুকিয়েছে।