নাগরিকত্ব আইন পথের থেকে বেশি পথবন্ধক তৈরি করছে

শোভনলাল চক্রবর্তী
যদি প্রশ্ন করা হয়, আইন কার জন্য? তার উত্তর স্বাভাবিক ভাবেই হওয়া উচিত,নাগরিকের জন্য, তাঁরই সুবিধায়৷ কিন্ত্ত আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের কাজটি যাঁদের উপর ন্যস্ত তাঁরাই অনেক সময় এমন আচরণ করেন, যা হয়ে পডে় নাগরিকের অসুবিধার কারণ৷ সম্প্রতি সংবাদে প্রকাশ যে নবদ্বীপের এক মহিলা তাঁর সন্তানের জন্মের শংসাপত্রে পিতৃপরিচয় বদলাতে চাইলে পুরসভা তাঁর আবেদন খারিজ করে এই যুক্তিতে যে, জন্মের শংসাপত্রের আইন অনুযায়ী এক বার নথিভুক্ত তথ্য বদলানো সম্ভব নয়৷ অথচ, মহিলার এর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে এবং তিনি দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছেন, দ্বিতীয় স্বামী প্রথম পক্ষের সন্তানকে নিজের সন্তান হিসাবে গ্রহণ করেছেন, এমনকি শিশুটির জন্মের শংসাপত্রে পিতৃপরিচয় বদলের ক্ষেত্রে প্রথম স্বামীরও আপত্তি নেই৷

পুরসভা তাঁর আবেদন খারিজের পর মহিলা কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করলে মাননীয় বিচারপতি বলেছেন, আইনে তথ্য সংশোধনের উপায় বলে দেওয়া আছে, সেই অনুযায়ী জন্মের শংসাপত্রে শিশুটির পিতৃপরিচয় বদলানো সম্ভব, অবিলম্বে যেন তা করা হয়৷ এ তো গেল কাজের কথা৷ কিন্ত্ত এরই সূত্রে মাননীয় বিচারপতির বৃহত্তর পর্যবেক্ষণগুলি অতি জরুরি, কারণ তা একই সঙ্গে আইনের কড়াকডি় এবং সমাজ বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার নমনীয় হওয়ার প্রয়োজনটিও তুলে ধরে৷ জন্মের শংসাপত্র ব্যক্তি তথা নাগরিকের পরিচয় সংক্রান্ত অতি গুরুত্বপূর্ণ এক নথি, তাকে অভ্রান্ত ধরে নেওয়া হয় বলেই তার আইনটিও কড়া৷ কিন্ত্ত যে কোনও আইনই তৈরি হয় তার সময় ও সমাজের প্রেক্ষাপটে, এবং মনে রাখা দরকার, যুগ বদলের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসে সমাজের গড়নে ও মনে, নাগরিকের জীবনধারা ও মূল্যবোধেও৷

এভাবেই বিবাহের পাশাপাশি বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ এখন ঘটমান বাস্তব; কেউ চাইতেই পারেন সন্তানের জন্মের শংসাপত্রে তার পুরনো সম্পর্কের ভার বা ছাপ না থাকুক৷ আবার যে শিশু জন্মদাতাকে নয়, দ্বিতীয় কাউকে বাবা বলে চিনছে, বড় হয়ে জন্ম-নথিতে অন্য কোনও নাম আবিষ্কার তার জন্য কষ্টের ও অসম্মানের হতে পারে, সম্পর্কে তৈরি করতে পারে অস্বস্তি৷ সমাজে এই জটিলতা যাতে না হয়, সে কথা মাথায় রেখে তাই আইনকে অচল ও স্থাণু হলে চলবে না, হতে হবে সচল, যুগোপযোগী৷ সমগ্র বিষয়টিরই মূল কথা: সাধারণ মানুষ তথা নাগরিকের স্বার্থে, সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলবে আইন৷ এর মানে আইনের প্রয়োগে আপস করা নয়, সমাজের মূল্যবোধের রূপান্তরকে সহজ সত্য বলে গ্রহণ করে আইনকে সহিষ্ণু, গ্রহণশীল করে তোলা৷ আবার উল্টো দিকে এ-ও সত্য, পরিবর্তনশীল সময়ের দোহাই দিয়ে, আইনকেই প্রাচীনপন্থী ও রক্ষণশীল বলে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নাগরিক নিজের স্বার্থসিদ্ধি করবেন না৷


আইনকে যেমন নাগরিকের মনও বুঝতে হবে, নাগরিককেও তেমনই আইনের অপব্যবহার করলে চলবে না৷ আইনি কঠোরতার জেরে নাগরিকের দুর্দশা যেমন এই ভারতে সত্য, তেমনই আইনের কড়াকডি়কে কাজে লাগিয়ে সহনাগরিককে প্যাঁচে ফেলাও আজ ঘটমান বাস্তব৷ তা যাতে না ঘটে, নজর রাখতে হবে সেই দিকেও৷ শাসনব্যবস্থায় ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স’-এর ধারণাটি বহুলপরিচিত, আইনের ক্ষেত্রেও তা সমান জরুরি৷ ধরে থাকা আর ছেডে় রাখার আইনি ভারসাম্যই নাগরিকের সামাজিক স্থিতির প্রাণভ্রমরা৷ কোনও আইন যখন পথের থেকে বেশি সংখ্যায় পথবন্ধক তৈরি করে, তার পিছনে কী থাকে? আর যা-ই থাক, সামগ্রিক নাগরিক সমাজ বিষয়ে মঙ্গলভাবনা থাকে না৷ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে এই হল সার কথা৷

চার বছর পর হঠাৎ মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহটিকেই কেন নাগরিকত্বের আইন পাশ করার জন্য প্রকৃষ্টতম লগ্ন হিসাবে বেছে নেওয়া হল, কথাটা সেখান থেকেই শুরু করা যেতে পারে৷ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আইনটি পাশের আগে থেকেই গোটা দেশ জুডে় প্রবল প্রতিবাদ ও আতঙ্ক চলছিল৷ কোভিড-পর্বের অন্ধকার যবনিকা তার উপর পতিত না হলে সে আন্দোলন সরকারকে বিপন্ন বোধ করাতেই পারত৷ বিভিন্ন রাজ্য সরকারও জানিয়েছিল যে, সিএএ-তে তাদের সমর্থন নেই৷ সে সমস্ত কিছু অগ্রাহ্য করে এত দিন ফেলে রাখা, অতি-বিতর্কিত, অতি-আশঙ্কিত সিএএ পদ্ধতি নির্দেশিকা প্রকাশিত হল এই মার্চে—জাতীয় নির্বাচনের ঠিক মুখে মুখে এবং এমন এক সময়ে যখন নির্বাচনী বন্ডের স্বচ্ছতা নিয়ে মামলায় সুপ্রিম কোর্ট যে কড়া রায় দিয়েছে তাতে বিজেপি সরকারের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা বিপুল৷ কার্যকারণ সম্পর্ক বিষয়টি কেবল কথার কথা নয়, তর্কশাস্ত্র ও গণিতশাস্ত্রের অন্তর্গত৷ আসন্ন ভোট এবং সিএএ-র মধ্যে কার্যকারণ এতই স্পষ্ট যে, তা দেখতে আজ আর তীক্ষ্ণবুদ্ধির আতশকাচটি ঝেডে়মুছে বার করতে হচ্ছে না৷ কার্যকারণের পরিচয়?

মুসলমান-বিরোধিতার নতুন রাস্তা তৈরি করে ধর্ম-অসহিষ্ণু হিন্দু ভোট আকাঙ্ক্ষা৷ অন্য দেশের থেকে আগত আশ্রয়প্রার্থীকে নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য সুযোগ দেওয়া— সাধারণ ভাবে নাগরিকত্ব আইনের এটুকুই লক্ষ্য হওয়ার কথা ছিল৷ দেশভাগের পর এমনিতেই এই বিষয়টিতে জটিলতার শেষ নেই৷ কিন্ত্ত ২০১৯ সালে বিজেপি সরকার হিন্দুরাজ্যের নির্মাণকল্পে আইনটি এমন ভাবেই সংশোধন করেছে, যাতে কোনও কোনও বিশেষ ধর্মের মানুষ সেই সুযোগ না পেতে পারেন৷ নাগরিকত্বের আবেদনের ক্ষেত্রে এই ধর্মভিত্তিক ভাগাভাগি— সরাসরি ভারতীয় সংবিধানের বিরুদ্ধতা৷

বিজেপি নেতাদের মুখে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, এ বার তাঁদের দল আবারও জিতে এলে সংবিধানেও বদল আসবে৷ সেই বদল আসার আগেই অসাংবিধানিক আইন? বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের সুযোগ দেওয়াই নাকি সরকারের উদ্দেশ্য৷ কে কোন বৈষম্যের কারণে এসেছেন জানা যাবে কী করে, ধর্মীয় বৈষম্যের প্রমাণই বা হবে কী করে? কেনই বা এই তিন দেশকে বেছে নেওয়া হল? অন্য দেশ থেকে একই কারণে এলে কেন কেউ সমান সুযোগ পাবেন না? কী করে ধরে নেওয়া হল যে, মুসলমানরা মুসলমানদের উপর ধর্মীয় বৈষম্য করে না, যখন তার অজস্র প্রমাণ সামনেই মজুত? আর ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে একটি বিশেষ তারিখের আগে এলে তবেই গণ্য হবে, তার পরে এলে আর হবে না— এমনই বা কেন? কোনও মুসলমান পিতামাতা অনেক দিন আগেও যদি ভারতে এসে থাকেন, তাঁরাও নাগরিকত্ব পাবেন না, আর ভারতের মাটিতে জন্মানো তাঁদের সন্তানসন্ততিও না?

জিজ্ঞাসা এখানেই শেষ নয়৷ আবেদনের সঙ্গে যে সব নথি চাওয়া হয়েছে, তা কেউ না দিতে পারলে কী হবে? আবেদনপত্র যদি খারিজ হয়ে যায় নথির অপর্যাপ্ততা বা অযথার্থতার কারণে, তবে কি আবেদনকারী ‘রাষ্ট্রহীন’ হয়ে যাবেন— কেননা তিনি ইতিমধ্যেই নিজেকে ভিন দেশি বলে ঘোষণা করেছেন, এবং এই দেশও তাঁর আবেদন গ্রহণ করেনি? সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে যাঁদের মুখ চেয়ে হর্ষোল্লাসে মেতেছেন বিজেপি নেতারা, সেই মতুয়া সমাজ আদৌ লাভবান হবে কি? প্রশ্নগুলো কঠিন৷ কিন্ত্ত উত্তর সব জানা৷ রাজনীতিটাও জানা৷ ভারতবর্ষের অসীম দুর্ভাগ্য যে নাগরিকত্বের মতো প্রশ্নে মানুষকে নিয়ে এই ক্লেদাক্ত রাজনীতি চলছে, চলবে৷