• facebook
  • twitter
Monday, 16 September, 2024

গোটা বিশ্ব জুড়েই জোরালো দাবি উঠুক যুদ্ধের বীভৎসতা বন্ধ হোক

যেকোনও দেশের সাধারণ মানুষই যুদ্ধ চান না

বরুণ দাস

প্রতিবছর আগস্ট মাসটি এলেই আমাদের সেই ভয়ঙ্করতম দিনটির কথা স্মরণে আসে। হাড় হিম করা সেই সাবেকি স্মৃতি শুধু বিধ্বস্ত দেশটিকেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশকেও এক ভয়াবহ আতঙ্কের সামনে দাঁড় করিয়েছিল। যে ভয়াবহ আতঙ্ক গোটা বিশ্বের মানুষ আজও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আগামীদিনেও যে পারবেন তেমন সম্ভাবনাও নেই। একটি দ্বীপরাষ্ট্রকে সেদিন এক ভয়ংকর ধ্বংসলীলার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল উন্নত বিশ্বের অগ্রণী দেশ আমেরিকা। যারা আধুনিক সভ্যতা-সংস্কৃতির অন্যতম দাবিদার।
দ্বীপরাষ্ট্র জাপানকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষলগ্নে ১৯৪৫-এর ৬ আগস্ট আমেরিকা ৩ দিনের ব্যবধানে সেদেশের দুই জনবহুল শহরের ওপর শক্তিশালী আনবিক বোমা নিক্ষেপ করে। তাতে ধ্বংস হয়ে যায় জাপানের ওই দুই উন্নত শহর। ইতিহাসের ধূসর পাতা থেকে জানা যায়, ৮০ হাজার মানুষ নিমেষে প্রাণ হারান। যাঁরা প্রাণে বেঁচে যান, তাঁরা বিকলাঙ্গ হয়ে বাকি জীবন কাটান। ওই আনবিক বোমার প্রবল তেজস্ক্রিয়তায় পরবর্তী প্রজন্মও দারুণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জন্ম নেয় বহু বিকলাঙ্গ শিশু।

প্রতিবছর ৬ আগস্ট হিরোসিমা দিবস পালন করে গোটা বিশ্ব। ৯ আগস্ট পালন করে নাগাসাকি দিবস। ওইদিন জাপানের নাগাসাকি শহরেও পরমাণু বোমা ফেলেছিল আমেরিকা। মুহূর্তের মধ্যে শহরের ষাটভাগ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। নিহতের সংখ্যা ৭৫ হাজার। কিন্তু আমাদের আপসোস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও মানুষ কোনও শিক্ষাই নিতে পারেনি। ফলে আবারও তারা যুদ্ধের দিকেই এগিয়েছে। ধ্বংস করেছে উন্নত সভ্যতা-সংস্কৃতি ও নিরাপরাধ মানুষ। যাঁদের সঙ্গে যুদ্ধের কোনও যোগ ছিল না।

যেকোনও দেশের সাধারণ মানুষই যুদ্ধ চান না; তাঁরা চান স্বস্তি ও শান্তি। কিন্তু রাজনৈতিক মতবাদ নির্বিশেষে দেশের স্বৈরাচারি শাসকশ্রেণি নানা ছলে-ছুতোয় অশান্তি সৃষ্টি করে অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধে নেমে পড়ে। দুর্বলের প্রতি অকারণ অত্যাচার আর প্রভুত্ব করার নেশা বড় ভয়ঙ্কর। এই ভয়ঙ্কর নেশা যখন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে অন্য দেশের দিকে ধাবিত হয়, তখনই যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হতে বাধ্য। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ [কিংবা ছায়াযুদ্ধ] – সবকিছুর মূলেই ওই প্রভুত্ব করার আদিম ও অকৃত্রিম নেশা।

এছাড়াও আছে সাম্রাজ্য বিস্তারের সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা। নিজের দেশের নির্দিষ্ট সীমানা বা গন্ডি পেরিয়ে অন্য দেশে সাম্রাজ্য বিস্তারের সাধ। একচ্ছত্র আধিপত্য। যেখানে অন্য কেউ নয়, আমি, আমিই শেষকথা- এমন একটা আগ্রাসি বাসনা জন্ম নেয় দেশকাল নির্বিশেষে অনেক স্বৈরাচারি শাসকের মধ্যে। যেমন নিয়েছিল জার্মানের শাসক অ্যাডলফ হিটলারের মধ্যে। বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি নিজের হাতে ছিনিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তার এই খামখেয়ালিপনার চড়া মাশুল গুণতে হয়েছিল তামাম বিশ্ববাসীকে।

এছাড়া আরও নানাবিধ কারণ আছে। যেমন অন্য দেশের খনিজ সম্পদ দখলের চেষ্টা। অপরের সম্পদ ছিনিয়ে এনে নিজেদের দেশের সম্পদ বাড়ানো। নিজেদের দেশে পর্যাপ্ত সম্পদ থাকা সত্বেও। যেমন ইরাকের সঙ্গে আমেরিকার যুদ্ধ। ইরাকের অঢেল খনিজ তেল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেখানে নিজেদের তাবেদার সরকার বসানো। যদিও আমারিকার ভূগর্ভেই রয়েছে প্রচুর পরিমানে খনিজ তেল। তবুও অন্যদেশের তেলভান্ডারের দিকে হাত বাড়ানো। বাধা এলেই নানা অজুহাত দেখিয়ে ওই সরকারকে সরিয়ে দেওয়া।

এজন্য তড়িঘড়ি যুদ্ধে নেমে পড়া৷ প্রয়োজনে সেদেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে দোষী সাব্যস্ত করে চরমদন্ড দেওয়া। বিচারের নামে প্রহসন। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করার ঘটনা আমাদের সবারই জানা। সে দেশটিকে একেবারে তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। ইরাকবাসিদের জীবন দুর্বিষহ করে দিয়েছে মার্কিন-সেনা। যারা সবাই নিরপরাধ মানুষ। যুদ্ধের সঙ্গে যাদের কোনও যোগই নেই। অথচ যুদ্ধের ভয়াবহ শিকার তারাই। রাষ্ট্রনায়কদের অন্যায় প্রতিশোধ-স্পৃহায় সভ্যতার চাকা পিছনের দিকে ঘোরে।
এভাবেই উন্নত বিশ্ব সভ্যতার আড়ালে অসভ্যতাকে ডেকে আনে। রাষ্ট্রনায়কদের অনাকাঙ্ক্ষিত উন্মত্ততার বলি হয় উন্নত সভ্যতা। ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন সভ্যতা ধ্বংসলীলায় পরিণত হয়। যেমন হয়েছে ইরাকে। তিলে তিলে গড়ে ওঠা নগরসভ্যতা ধুলিসাৎ হয়।

ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় একটা গোটা দেশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র বিনষ্ট হয়। চিকিৎসাধীন মরণাপন্ন রুগিরাও রেহাই পাননা আক্রমণকারী ঘাতক দেশের রক্তাক্ত হাত থেকে। অগণ্য নিরপরাধ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় প্রতিটি যুদ্ধ। ইতিহাস নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু।

তবুও প্রতিবছর যুদ্ধবিরোধি এই দিবস পালন করা হয়। আসলে এই প্রত্যাশা নিয়ে ওই দুই দিবস উদযাপন করা হয় যাতে পরমানু শক্তির অপচয়ে উন্নত সভ্যতা, মানুষ ও সম্পদ নষ্ট না হয়। বিশ্ব হোক পরমানু-মুক্ত যেখানে মানুষ অকারণে প্রাণ দিতে বাধ্য হবেন না। প্রাণ ও সম্পদের ধ্বংসযজ্ঞ, রক্তপাত, পরিবেশের ক্ষতি সহ পরমানু অস্ত্র ব্যবহার বন্ধ করতে শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ এদিনটিতে শপথ নেন।

কিন্তু মানুষের শুভকামনা সফল হচ্ছে কোথায়? যদি সফল হতো তো হিরোসিমা-নাগাসাকির পর প্রায় আট দশক কাটতে চললো- যুদ্ধ কিন্তু বন্ধ হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক ভয়ংকর যুদ্ধেরই সাক্ষী এই বিশ্ব। অজস্র নিরপরাধ প্রাণ আর কষ্টার্জিত সম্পদের ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি বিশ্ব পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি- কী-ই না হচ্ছে গোটা বিশ্ব জুড়ে। সাম্রাজ্যবাদি নিষ্ঠুর শাসকেরা তবুও অনঢ়-অটল তাদের অমানবিক কর্মকান্ডে। সত্যিই কী আমরা শিক্ষিত কিংবা সভ্য হতে পেরেছি? আমাদের মধ্যে পশুত্বের বিনাশ ঘটেছে?

এর উত্তর অবশ্যই ‘না।’ দু’বছর হতে চললো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় দু’দেশের সম্পদ ও মানুষই বিপন্ন। দুই শাসকের অকারণ রেষারেষি -লড়াইয়ে প্রাণ দিচ্ছেন দু’দেশের অসংখ্য সাধারণ নিরীহ মানুষ। শুরুতে যে যুদ্ধ ছিল দু’দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ, আজ তার সংগে পরোক্ষভাবে জুড়ে গেছে আরও অনেক দেশ। সভ্যতার নির্বিকল্প কলঙ্ক যুদ্ধকে আমরা অন্যের ওপর প্রতিশোধ মেটানোর সেরা মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছি। মানুষ, সম্পদ আর উন্নত শহরকে নিমেষে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছি।
উল্লেখ্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলার মধ্যেই ২০২৩-এর ৭ অক্টোবর শুরু হয়েছে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধ। হামাস-এর অতর্কিত আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ইজরায়েল ঝাঁপিয়ে পড়েছে প্যালেস্তাইনের বুকে। গাজা স্ট্রিপ আর ওয়েষ্ট ব্যাঙ্কের ওপর নারকীয় আক্রমণ শানিয়ে চলেছে মার্কিন মদতপুষ্ট ইজরায়েল। সংবাদমাধ্যমে বাবা-মা হারানো রক্তাক্ত শিশুর হৃদয়-নিঙরানো হাহাকার আর কান্নাও আমাদেরকে কিছুমাত্র টলাতে পারেনা। আমরা যেন প্রস্তর-খন্ডে পরিণত হয়ে গেছি। ইরান ছাড়া মার্কিনি-জুজুতে আরব দুনিয়াও প্রায় চুপ।

হাসপাতালও বাদ যায় না ইজরায়েলি আক্রমণ থেকে। একোন সভ্যদুনিয়ায় বাস করছি আমরা? কোন ‘উন্নতি’ আমাদেরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গভীর খাদের দিকে? কোন শিক্ষা আমাদেরকে সভ্যতা-সংস্কৃতির ধ্বংস আর মানুষ মারার কৌশল শেখাচ্ছে? মনুষ্যত্ব আর মানবিকতাকে গলাটিপে হত্যা করার প্রেরণা জোগাচ্ছে? আরব ভূখন্ডে প্রায় দেড়কোটি মানুষের ছোট্ট একটি দেশ ইজরায়েল। তার স্বৈরাচারি শাসকের সীমাহীন তান্ডবে গোটা বিশ্ব ভয়ে সিটিয়ে আছে। এমন কি, খোদ রাষ্ট্রসংঘ পর্যন্ত ধ্বংসলীলা দেখেও ‘স্পিকটি নট।’

বিশ্বের বাঘা বাঘা রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে গঠিত এই গালভরা নামের সংগঠনটি যেন ঠুঁটো জগন্নাথ। নখ-দন্তহীন এই সংঘের প্রয়োজনীয়তা কোথায়- এই প্রশ্ন ওঠা দরকার। বিশ্বচিত্র দেখে আমাদের অনেকেরই মনে হয়তো ‘হীরক রাজার দেশে’ ছায়াছবির গানের কলি মনে আসে, ‘কতোই রস দেখি দুনিয়ায়/ও ভাই ভাই রে/কতোই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়…।’ উন্নত বিশ্ব তথা পশ্চিমি দুনিয়ার চেহারা-চরিত্র আমাদেরকে বিস্মিত করে। ‘আমরা অবাক বনে যাই। ‘ বিশ্ববরেণ্য চলচিত্র-ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায়ের দূরদর্শিতায় মুগ্ধ হতে হয়।

একেই কি বলে সভ্যতার ‘অগ্রগতি?’ নাকি সভ্যতার পশ্চাদপদতা? কী বলবেন আবিশ্বের সভ্য শিক্ষিত উন্নত আর সচেতন মানুষ? আমাদের জানতে বড়ো ইচ্ছে হয়। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কথা কবে আর কোনকালেই বা গুরুত্ব পেয়েছে? না সমাজতন্ত্রে? না গণতন্ত্রে? সব তন্ত্রের শাসকেরাই তো ওপর থেকে সবকিছু চাপিয়ে দেন। সাধারণ মানুষেরা বরাবর ব্রাত্যই থেকে যায়। যদিও এর ঠিক উল্টোটাই হওয়ার কথা ছিল। কথা তো ছিল বটে; কিন্তু সেকথা শুনবেনই-বা কে আর মানবেনই-বা কে?

মূল সমস্যাটা সম্ভবতঃ এখানেই। নিজেদের সমস্যা নিজেরা বুঝব না তো কী অন্যেরা বুঝবেন? বোঝার কথাও নয়। কিন্তু সেকথা বোঝাবেন কাকে? ‘সাধারণ মানুষ কিছুই বোঝে না’- গোটা বিশ্ব জুড়েই গড়পরতা এমন একটা ভাবনাচিন্তা সব মতবাদের শাসকদের মাথার মধ্যেই গেঁথে আছে। তাদের ভাবখানা এই, ‘আমি দন্ডমুন্ডের কর্তা; আমি বুঝবো না তো কে বুঝবে?’ এই কট্টর গোঁড়ামি বা মৌলবাদি চিন্তাভাবনা থেকে তাদের বের হয়ে আসার কোনও লক্ষণই নেই। তেমন কোনও চেষ্টাও নেই একথা বলাই বাহুল্য।

তাই গোটা বিশ্ব জুড়েই রাষ্ট্রপ্রধানদের অমানবিক খামখেয়ালিপনা চলতেই থাকে। একইসঙ্গে তাদের আগ্রাসি পদক্ষেপও । মারণখেলায় উন্মত্ত হয়ে ওঠেন তারা। মানুষ যেন তাদের কাছে স্রেফ কাঠ-পুতলি। এই কাঠ-পুতলিদের জন্য তাদের বিন্দুমাত্র দয়ামায়া থাকেনা। যদিও এদেরকে ‘ব্যবহার’ করেই তারা দেশে দেশে ক্ষমতায় আসেন এবং ক্ষমতায় এসেই স্বমূর্তি ধারণ করেন। গণতন্ত্রের আড়ালে অ-গণতন্ত্রিক কাজ-কারবার যাকে সরাসরি স্বৈরাচার বললেও কিছুমাত্র অত্যুক্তি করা হয়না। দাবার বোড়ে হয়েই আমাদের জীবন কেটে যায়।

যুদ্ধের এই ভয়ংকর বীভৎসতা, যুদ্ধের এই ধারাবাহিকতা হয়তো চলতেই থাকবে। যদি না গোটা বিশ্বের মানুষ এক হয়ে এর বিরুদ্ধে অবিলম্বে সরব ও সোচ্চার না হন। ‘আমার গায়ে তো আঁচ লাগেনি; তাই আমি চুপ করে থাকব’- এমনটি হলে চলবে না। থামানো যাবে না কোনও স্বৈরাচারি শাসকদেরই। সাধারণ মানুষই পারবেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় জনমত গঠন করতে। বিশ্বের যুদ্ধপ্রেমি শাসকদের নিরস্ত করাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ভূমিকা কোনওভাবেই অগ্রাহ্য করার নয়- একথা মাথায় রাখতে হবে।
এবং দেশের গন্ডি পেরিয়ে সম্মিলিতভাবে যেকোনও যুদ্ধের বিরুদ্ধেই গণ-প্রতিবাদে নিজেদেরকে শামিল করতে হবে। এছাড়া বিকল্প কোনও পথ নেই। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর নয়। আসুন যুদ্ধহীন বিশ্বের লক্ষ্যে আজই আমরা কাজে নেমে পড়ি।