ভাঙা হচ্ছে না মন্দারমণির ১৪৪টি চিহ্নিত হোটেল-রিসর্ট। চলবে না বুলডোজার। গত মঙ্গলবার এমনটাই আশ্বাস দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। এই ব্যাপারে তাঁরা মন্দারমণির হোটেল মালিকদের অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে কথাও বলেন। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তে চরম উষ্মা প্রকাশ করে মমতা বলেন, ‘বুলডোজার কোনও সমাধানের পথ নয়। কোনওরকম বুলডোজার চলবে না।’
তারই মধ্যে এই ঘটনায় আদালতের দ্বারস্থ হলেন হোটেলমালিকেরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘এই হোটেল ব্যবসা থেকে আমাদের আয় হয়। এই উপার্জনেই সংসার চলে। এই ব্যবসার সঙ্গে কয়েক হাজার পবিবার যুক্ত। তাঁরা এই হোটেল চালু করার আগে প্রশাসনের সব রকম অনুমতি নিয়েছে। তাই এখন অবৈধ ঘোষণা সঠিক পদক্ষেপ নয়।’ বুধবার কলকাতা হাইকোর্টে ওঠে মামলাটি। আগামী শুক্রবার বিচারপতি অমৃতা সিংহের এজলাসে এই মামলাটি ফের উঠবে। ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে করা এই মামলাটির চূড়ান্ত শুনানি সেদিনই হওয়ার কথা। অন্যদিকে, ২০-২২ নভেম্বর, এই ৩ দিন প্রয়োজনীয় কাগজ নিয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজির দপ্তরে দেখা করতে বলা হয়েছে হোটেল মালিকদের। এই প্রসঙ্গে মন্দারমণি হোটেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস-চেয়ারম্যান দেবরাজ দাসের বক্তব্য, ‘হিয়ারিংয়ের নোটিশ পেয়ে আমরা জেলাশাসকের দপ্তরের যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। ২০ শে নভেম্বর থেকে ২২ শে নভেম্বর পর্যন্ত টানা তিনদিন ধরে এর দিন ধার্য্য হলেও তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত থাকার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তাই আমরা এখন হাইকোর্ট-এর রায়ের দিকেই তাকিয়ে রয়েছি।’
রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মহলে যদিও পূর্ব মেদিনীপুর এবং নবান্নের এই সিদ্ধান্তের দ্বৈরথ নিয়ে বিস্তর কাটাছেঁড়া হয়েছে। সূত্র মোতাবেক খবর, এই দ্বৈরথের কারণ দ্বিবিধ। প্রশাসনিক দিক থেকে দেখতে গেলে, যে যার দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ যদি পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক না মানতেন, তবে তা আইনি অবমাননা হত। অতএব, তিনি জেলার প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে তাঁর কাজ করেছেন। অন্যদিকে, জনপ্রতিনিধি এবং রাজ্যের কার্যকরী প্রধান হিসেবে মমতা তাঁর কাজ করেছেন। ওই হোটেলগুলোর সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান, জীবিকার সমস্যাটি তিনি অভিভাবকের গুরুত্ব নিয়ে দেখেছেন। এর ফলে, না সাপ মরল, না লাঠি ভাঙল। যে যার জায়গায় ঠিক থাকলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিকের বক্তব্য, ‘এটাকে পূর্ব মেদিনীপুর বনাম নবান্নের সংঘাত হিসাবে দেখলে হবে না। বরং ‘বোঝাপড়া’ হিসাবেই দেখা উচিত।’
অপরপক্ষে, এর একটা রাজনৈতিক দিক রয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকেই। জেলা প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তে পেটে হাত পড়ত ৪ লক্ষাধিক মানুষের, এমনটাই খবর। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মত, এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী হলে ২০২৬ বিধানসভা ভোটের আগে এই ঘটনাকে নিয়ে নির্বাচনী ফায়দা লোটার তালে থাকত রাজ্য বিজেপি। বিশেষ করে, বিজেপি নেতা এবং রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তাঁর নিজের জেলায় হওয়া এই ঘটনাকে কখনোই সহজে ছেড়ে দিতেন না। তারমধ্যে মন্দারমণি যে লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে, সেই কাঁথি লোকসভার সাংসদ হলেন বিজেপি নেতা এবং শুভেন্দুর ভাই সৌমেন্দু অধিকারী। তৃণমূল কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা জানান, ‘মন্দারমণিতে এই কাণ্ড যদি হত, তা হলে তার সরাসরি রাজনৈতিক ফায়দা তুলত বিজেপি। আরও ভাল করে বললে, ফায়দা তুলতেন শুভেন্দু অধিকারী। বিধানসভা ভোটের দেড় বছর আগে সেই ঝুঁকি কেন নিতে যাব?’
এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ‘ব্লু-প্রিন্ট’ তৈরি করার কথা ভাবছে। প্রশাসনিক স্তরে এই নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক বলেন, ‘বাম আমলে যাঁরা পাট্টা পেয়েছিলেন, সেই পাট্টাদারেরাও লিখিত-পড়িত করে হোটেল মালিকদের জমি দিয়েছেন। কিন্তু পাট্টার জমি ও ভাবে বিক্রি করা যায় না।’ এই আইনি সমস্যার থেকেই রেহাইয়ের পথ খুঁজছে জেলা প্রশাসন। অপেক্ষায় হোটেল মালিকদের অ্যাসোসিয়েশনও। আপাতত সবার চোখ শুক্রবার কলকাতা হাই কোর্টের শুনানিতে কী হয়, তার দিকে।