সেই রাজারাও নেই, আবার নেই তাদের রাজও। কিন্তু বর্ধমান মহারাজাদের শুরু করা প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের জগদ্ধাত্রী পুজো আজও হয় বর্ধমানের চ্যাটার্জি বাড়িতে। বর্ধমান শহরের কয়েক কিলোমিটার দুরে বাকলসা গ্রামে রাজ ঐতিহাসিক ওই পুজোর সমারোহে কোন ঘাটতি থাকে না। গোটা গ্রাম জুড়ে উৎসবে সকল শ্রেনীর মানুষজন সামিল হন। জেলা ও জেলার বাইরে এমনকি বিদেশ থেকে চ্যাটার্জিদের বংশধররা পুজোর কটা দিন এই গ্রামেই কাটিয়ে দেন। পারিবারিক ঐতিহ্য, পরম্পরা মেনে পুজো হলেও রাজাদের রীতি রেওয়াজ মেনে আজও এই অভিনব পুজোর প্রচলন আছে।
দুর্গা পুজোর নবমী থেকে ঠিক একমাস বাদে বাকলসা গ্রামে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। গ্রামে এই একটি মাত্র পুজো। পুরনো নিয়মে গোটা গ্রামের লোকজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এখানকার জগদ্ধাত্রী পুজোর সঙ্গে বর্ধমানের রাজাদের সম্পর্ক রয়েছে। এই গ্রামে কালীপদ চ্যাটার্জি পুজোর সূচনা করেছিলেন। তৎকালীন বর্ধমান রাজ পরিবারের অন্যতম প্রবীণ সদস্য তেজসচন্দ্র মাহাতোর উদ্যোগে এই পুজোর আয়োজন করা হয়। তিনি ছিলেন বর্ধমান মহারাজার দাদু। জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুজোর আয়োজন ঘিরে শুরু থেকেই গ্রামবাসীদের অংশগ্রহণ ছিল। চ্যাটার্জি পরিবার বর্ধমান মহারাজাদের কাছে জমিদারি লাভ করেছিলেন। পরবর্তী কালে কালীপদ চ্যাটার্জি রাজাদের সভাপন্ডিত হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই সূত্রে রাজারাই পুজোর যাবতীয় ব্যাবস্থা করে দিতেন। তারপর ওই পরিবারের ঋষিকেশ, নিরাপদ, সমরেন্দ্র চ্যাটার্জিরা পুজোর সব দায় দায়িত্ব পালন করে এসেছেন।
পুজোর আগে মহারাজারা বর্ধমান থেকে হাতির পিঠে চাপিয়ে পুজোর যাবতীয় সামগ্রী ওই গ্রামে পাঠিয়ে দিতেন। আর পুজোর দিন স্বয়ং রাজা উপস্থিত থাকতেন চ্যাটার্জি বাড়িতে। বর্তমানে রাজাদের সেই পরম্পরা মেনেই পুজো করা হয় বলে জানান ওই পরিবারের অন্যতম সদস্য শুভাশিস চ্যাটার্জি। তিনি বলেন, বর্তমানে পালা করে বংশের অনান্যরা দায়িত্ব পালন করেন। এ বছর পুজোর দায়িত্ব সামলাবেন শুভাশিস বাবু। তিনি জানান পুজোর যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়। অভিনব এই আয়োজনে রাজাদের নিয়ম মেনে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর পুজো একসঙ্গে করা হয়। পুরনো রীতি রেওয়াজ মেনে দু মন পরিমাণ চালের নৈবেদ্য সাজানো হয় থাকে। বলা ছিল আশপাশের পাঁচটা গ্রামের লোকজন খাবেন। আর পরিবারের লোকজন উপবাস থাকবেন। বংশ পরম্পরায় হোসেনপুরের দেবব্রত চ্যাটার্জি, শুভেন্দু চ্যাটার্জিরা পুরোহিত হিসাবে পুজোর দায়িত্ব পালন করেন। নিয়ম রক্ষায় সপ্তমীতে একটা,অষ্টমীতে দুটো, নবমীতে দুটো বলিদান হয়। সাত পুরুষের পুজো এ ভাবেই হয়ে আসছে। নিয়ম মেনে কালী পুজোর পর ভাইফোঁটার দিন প্রতিমার গায়ে মাটি পড়ে। আজও নবমীর পুজো শেষে অন্নভোগের আয়োজন করা হয়। ওই অন্নভোগের আয়োজনে সমস্ত ধর্মের বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণ থাকে। মহামিলনের পরিবেশ তৈরি হয়।