আজ মহাপথের পথিক পরমপুরুষ লোকনাথ বাবার ১৩৪তম তিরোধান দিবস

শ্রীধর মিত্র

ঈশ্বরের স্বরূপ কী, এ প্রশ্নর উত্তরে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলতেন, ঈশ্বর নামক কোনও পদার্থের সঙ্গে এ পর্যন্ত আমার এখনও পরিচয় হয়নি৷ এরপর যদি সেই বস্ত্তর অস্তিত্ব দেখতে পাই, তবে তোমারে বলতে পারবো৷
বাবা লোকনাথ ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর অগণিত ভক্তদের উদ্দেশ্যে কোনও উপদেশ দিতেন না, ভক্তদের কানে কানে মন্ত্র দিতেন না, এমন কি তাঁর পা স্পর্শ করে ভক্তরা আশীর্বাদ পেতে চাইলে তিনি বলতেন, মনে মনে নমস্কারই নমস্কার৷ দেশের আনাচে-কানাচে তাঁর অগণিত ভক্ত, আশ্রম সর্বত্রই রয়েছে৷

এমনকি ভারতবর্ষের বাইরেও৷ দীর্ঘ চল্লিশ বছর বরফের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের বহু দেশ পরিভ্রমণ করেছেন, এমনকি জ্ঞান আাহরণের জন্য তিনি গিয়েছেন মক্কা শরিফে৷ আর সমস্ত সঞ্চিত জ্ঞান বিলিয়ে দিয়েছেন তাঁর অগণিত ভক্তদের মধ্যেই৷ এই প্রজ্ঞাবান পুরুষের জন্মলগ্ন ছিল রোহিনী নক্ষত্রে জন্মাষ্টমীর দিন৷ ১১৩৭ বঙ্গাব্দের ১৮ ভাদ্র জন্ম নেন লোকনাথ৷ বাবা রামকানাই ঘোষাল এবং মা কমলাদেবী৷ লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের৷ কেউ বলেন তাঁর জন্মস্থান উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের দেগঙ্গা থানার কাছে চাকলা গ্রামে, আবার কারওর মতে, স্বরূপনগরের কাছে কচুয়ায়৷ লোকনাথ তাঁর বাবা-মা’র চতুর্থ সন্তান৷ তখনকার ব্রাহ্মণদের মধ্যে সংস্কার ছিল যে, বংশের কোনও একজন যদি ব্রহ্মচারী হন, তবে সেই কূলের চতুর্দশ পুরুষ উদ্ধার হবেন৷ তাই রামকানাই ঘোষালের ইচ্ছা ছিল, তাঁর প্রথম পুত্রকে ব্রহ্মচারী করবেন৷ কিন্ত্ত তাঁর স্ত্রী কমলাদেবী সেই প্রস্তাবে রাজি হননি৷ এরপর আরও দুই পুত্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন৷ কিন্ত্ত কমলাদেবী তাঁদেরও ব্রহ্মচারী করতে কিছুতেই রাজি হননি৷ অবশেষে চতুর্থ পুত্র৷


কমলাদেবী তাঁর স্বামীকে ডেকে জানিয়েছিলেন, ইতিপূর্বে আগের তিনটি পুত্রের একটিকেও আমি ব্রহ্মচারী করতে সম্মত হইনি, আপনি এই নবজাত পুত্রকে ব্রহ্মচারী করার জন্য নিন৷ নবজাতক এই সন্তানের নামকরণ করা হল লোকনাথ৷ এই সন্তান ভবিষ্যতে সন্ন্যাস নেবে, তাই সুরৎ মহাশয়ের পাঠশালায় শিক্ষা ছাড়াও নিকটাত্মীয়গণ সবসময় তাঁকে ধর্মোপদেশ দিতেন৷ কিন্ত্ত শৈশবে লোকনাথ ছিলেন চঞ্চল স্বভাবের৷ ১১৪৮ বঙ্গাব্দে ১১ বছর বয়সে বালক লোকনাথের উপনয়ন হয় এবং তখন থেকেই তাঁর সন্ন্যাস জীবনের সূচনা৷ সেখান থেকেই তাঁর সন্ন্যাস জীবনের পথচলা শুরু৷ সেই সময় থেকেই বিখ্যাত পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথকে সঙ্গে নিয়ে গ্রাম পরিত্যাগ করেছিলেন৷ এলেন মহাতীর্থ কালীঘাটে৷ তখন কালীঘাট এক নিবিড় বন৷ লোকনাথের স্বভাবসুলভ চাপল্য তখনও যায়নি৷ কিন্ত্ত সাধুসঙ্গ লাভ করে সে চাপল্য চলে যেতে বেশি সময় লাগল না৷ লোকনাথ বুঝতে পারলেন কালীঘাট তাঁর নিজের বাড়ির খুব কাছেই৷ লোকনাথ চাইলেন, তিনি চলে যাবেন বহুদূরে, পালন করবেন কঠোর ব্রহ্মচর্য এবং তা-ই করলেন৷ প্রথমে নির্জনে যোগাভ্যাস আরম্ভ করলেন ও এরপর কলরবের মধ্যে মনোসংযোগের অধ্যায় এবং সেই অধ্যায়ে তাঁর শিক্ষার হাল ধরে রেখেছিলেন ভগবান গাঙ্গুলি এবং শিক্ষা চলল কঠিন-কঠোরভাবে৷ সন্ন্যাস গ্রহণের পর লোকনাথ ও ভগবান গাঙ্গুলি শেষবারের মতো জন্মভূমি দর্শনের উদ্দেশ্যে কচুয়া গ্রামে গিয়েছিলেন৷

কচুয়া থেকে মোহমুক্ত হয়ে তিনি আবার বেরিয়ে পড়লেন৷ মহাপথের ডাক উপেক্ষা করা তাঁর আর সম্ভব হল না৷ ভারতবর্ষের বহুতীর্থ ভ্রমণ করলেন লোকনাথ৷ গুরু ভগবান গাঙ্গুলিকে নিয়ে তিনি সাধনা করলেন৷ দীর্ঘদিন সাধনার পর লোকনাথ সিদ্ধলাভ করলেন৷ সিদ্ধ লোকনাথ এবার এলেন কাশীতে৷ সেখানে এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল হিতলাল মিশ্র নামে জনৈক মহাপুরুষের৷ বলা হয়, এই হিতলাল মিশ্রই কাশীর ত্রৈলঙ্গস্বামী৷ লোকনাথ যেমন ঠিক চিনতে পেরেছিলেন হিতলালের মতো মহাপুরুষকে৷ তেমনই ত্রৈলঙ্গস্বামীও বুঝতে পেরেছিলেন লোকনাথ কোনও সাধারণ মানুষ নন৷ ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথকে সমর্পণ করলেন ত্রৈলঙ্গস্বামীর হাতে৷ অতএব লোকনাথের জীবনে এল এক নতুন পর্যায়৷ বলা যেতে পারে, এটা তাঁর পূর্ণজন্ম৷ লোকনাথ ও ত্রৈলঙ্গস্বামী বেরিয়ে পড়লেন মহাপথের সন্ধানে৷ শরীরকে অনাবৃত করে হিমালয়ে বরফাবৃত পথে যাত্রা শুরু করলেন ওরা দু’জন৷ তাঁদের শরীরের চামড়া খসখসে হয়ে এল৷ চলতে চলতে চোখের উপাদান তাঁদের অন্যরকম হয়ে গেল৷ চাঁদ-সূর্যের আলো না থাকলেও তাঁরা দেখতে পেতেন৷ হিমালয় শুধু নয়, তিনি পরিক্রমা করলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ৷ গিয়েছিলেন মক্কায়৷ কাবুলে থাকাকালীন তিনি কোরাণ শরিফ পাঠ শিক্ষা নিয়েছিলেন৷ তাঁর কথায়, ‘আমরা গুরু-শিষ্য মিলে কাবুলে গিয়ে মোল্লা সর্দার বাড়িতে অবস্থান করে তাঁর কাছে রীতিমতো কালেমোল্লা (কোরান) পাঠ করেছি৷’ তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা যেন আরও বেড়ে উঠল কোরাণ পাঠ করে৷ তিনি সারা এশিয়া, ইউরোপ, আফগানিস্থান, ইরান, আরব ভ্রমণ করেছিলেন৷

লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জ্ঞান এবং তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার কথা ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করেছিল অনেক আগেই৷ এরপর তাঁর ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকল সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে৷ ভক্তদের সঙ্গে তিনি কথা বলতেন, তাঁদের সমস্যার সমাধান করতেন৷ এমনকি অনেকের দুরারোগ্য অসুখেরও তিনি নিরাময় করেছিলেন৷ শোনা যায়, তিনি পশুপাখিদের কথা বুঝতে পারতেন, এমনকি তাঁর আশ্রমে একটি বাঘ নিয়মিত আসা-যাওয়া করত বলে কথিত আছে৷

লোকনাথ ব্রহ্মচারী যখন পাহাড়ে ত্রৈলঙ্গস্বামীর সঙ্গে উদয়াচলের পথে যেতে চেয়েছিলেন, তখন ত্রৈলঙ্গস্বামী বলেন, ‘নিম্নভূমে তোমার কর্ম রয়েছে৷’ এই কর্মে তিনি নিজেকে মিশিয়ে দিতেই তিনি বারদিতে এসেছিলেন৷ তখন তাঁর বয়স ১৩০ বছর৷ এখানে অর্থাৎ বারদিতে আরও ৩০ বছর ধরেছিলেন৷ এরপর ১২৯৭ সালে জ্যৈষ্ঠ মাস পড়তেই ঠিক হয় ১০ জ্যৈষ্ঠ, রবিবার ব্রহ্মচারী পরলীলা সমাপ্ত করবেন৷ ওইদিন সকাল ৯টায় মধ্যাহ্নভোজন শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ ওই নির্দেশ তিনি আশ্রমবাসীদের উদ্দেশে দিয়েছিলেন৷ সকাল ১০টার মধ্যে আহার শেষ হয়েছে কিনা খোঁজও নিয়েছিলেন লোকনাথ বাবা৷ এরপর বাবা ধ্যানযোগে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে তাঁর অমর আত্মা উত্তরায়ণে সূর্য্য ভেদ করে অমরলোকে চলে যায় বলে আশ্রমে বসবাসকারীরা ও হাজার হাজার ভক্তরা বিশ্বাস করেন৷

‘রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিও৷ আমি-ই তোমাদের রক্ষা করিব৷ — লোকনাথ বাবার অমৃত বাণী৷