আজ লোকনাথ বাবার ২৯৪তম আবির্ভাব দিবস, পূর্ণ্য জন্মাষ্টমী তিথিতে চাকলাধামে দু-দিন মহোৎসব পালন

শ্রীধর মিত্র

‘‘মহাভারতে যেথা কৃষ্ণ রামায়ণে রাম

কলিতে স্মরণ করি লোকনাথ নাম।।’’’


ত্রিকালদর্শী মহাযোগী ব্রাহ্মজ্ঞ ব্রাহ্মণ পরমপুরুষ শ্রীশ্রী লোকনাথ বাবার আজ ২৯৪ আবির্ভাব তিথি সোমবার। ১৮ ভাদ্র, মঙ্গলবার, রোহিণী নক্ষত্রে, জন্মাষ্টমীর দিন তৎকালীন যশোহর চাকলা কচুয়া গ্রামে। বর্তমানে বসিরহাটের অন্তর্গত স্বরূপনগরের কাছে কাঁকড়া গ্রামে ঘোষাল বংশে পিতা রামকানাই-কূলবধূরা শঙ্খ-ধ্বনি-উলু দিয়ে বরণ করেছিল এই দেবশিশুকে।

সে সময় ব্রাহ্মণদের মধ্যে সংস্কার ছিল যে বংশের কোন ১ জন যদি নৈষ্টিক ব্রহ্মচারী হন তবে সেই কুলের চতুর্দশ পুরুষ উদ্ধার হন। তাই রামকানাই ঘোষালের ইচ্ছানুসারে, তার ১ম পুত্রকে ব্রহ্মচারী করবেন। পত্নীর অনিচ্ছা থাকায়, তাই প্রথম পুত্রকে আর ব্রহ্মচারী করা সম্ভব হয়নি। এরপরে আরও দুই পুত্র জন্মালেও কোনওভাবেই রামকানাইবাবুর ইচ্ছা পূরণ হয়নি। অবশেষে চতুর্থ সন্তান জন্মগ্রহণ হলে কমলাদেবী (মা) স্বামীকে ডেকে জানালেন ‘ইতিপূর্বে জাত তিনটি পুত্রের মধ্যে একটিকেও আমি ব্রহ্মচারী করতে মত। দিইনি, আপনি এখন এই নবজাত পুত্রকে ব্রহ্মচারী করার জন্য গ্রহণ করুণ (নিন)। অবিশ্বাস্য এই অনুরোধে রামকানাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ গাঙ্গুলিপাড়ায় তৎকালীন ষড়দর্শনের প্রবীণ পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলিকে খবর দেন। ভগবান বুঝলেন এই নবজাত সন্তান সাধারণ মানুষ নন, ইনি নিশ্চয়ই কোন মহাপুরুষ, লোকাহিতার্থে মত্যে আবির্ভুত হয়েছেন। নবজাত সন্তানের নামকরণ করা হলো ‘লোকনাথ’। এই ছেলে আগামী দিনে সন্ন্যাস নিতে চলেছে, তাই গুরুমশায়ের পাঠশালায় শিক্ষা ছাড়াও কাছের আত্মীয়-পরিজনরা ও সদ্যজাত বালককে ধর্মাপদেশ দিত। শৈশব থেকেই লোকনাথকে শাস্ত্রশিক্ষা দেবার জন্য গুরুজনদের ঐকান্তিক চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না।

শৈশবকালে দুষ্টুমি ও আত্মীয়-পরিজনদের ধর্মোপদেশ সম্পর্কে লোকনাথ বাবা জানিয়েছেন, গুরুজনেরা শৈশবে আমার কাছে জ্ঞানগর্ভে কথা উত্থাপন করতেন এবং যাতে আমার হৃদয় সেইদিকে আকৃষ্ট হয় এমন চেষ্টা করতেন। আমি একদিকে গুরুজনদের সেই সব কথা মন দিয়ে শুনতাম, অপরদিকে সমবয়সি ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে খেলা করতে-করতে বৃদ্ধদের পুজো শেষ হতে না হতেই লাঠি দিয়ে ভেঙ্গে দিতাম। এইভাবেই আমার শৈশব জীবন কেটেছে।’

১১৪৮ বঙ্গাব্দ (১৭১৪ খৃষ্টাব্দ) ১১ বছর বয়স হওয়ায় বালক লোকনাথের উপনয়ন এবং একই সঙ্গে সন্ন্যাস নেবার কথা ঠিক হয়। ওই শুভদিনে গ্রামের আরও অনেক ব্রাহ্মণ সন্তানদের উপনয়ন হচ্ছিল। লোকনাথের একদা খেলার সঙ্গী বন্দ্যোপাধ্যায় পাড়ার বলরাম বন্দোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় পুত্র বেণীমাধবেরও ওইদিন উপনয়ন ঠিক হয়। উপনয়নের দিন বেণীমাধব লোকনাথের সঙ্গে সন্ন্যাস নেবার বায়না ধরে। ছেলেমানুষি কথা বলে প্রথমে অভিভাবকগণ উড়িয়ে দিলেও বেণীমাধব কিন্তু জেদ ধরে বসে থাকে সন্ন্যাস নেবার জন্য     । বাড়ির আত্মীয় পরিজনরা ব্রতাচর্যের কঠোরতা, অরণ্যবাসের কষ্ট প্রভৃতি বলেও বেণীমাধবের ইচ্ছাকে ভাঙতে পাড়েনি। অনেক কথাবার্তার পর ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথ ও বেণীমাধবকে প্রথমে উপনয়নের দীক্ষা দিয়েছিলেন। ভগবান মনু তাঁর সংহিতায় বলেছেন—মতুরগ্রেহবিজননং দ্বিতীয়াং মৌন্জিবন্ধনে।

তৃতীয় যজ্ঞদীক্ষায়াং বিজস্য শ্রুতিচোদন্যাৎ।। ২/‌১৬৯ শ্রুতিতে কথিত আছে যে, ব্রাহ্মণ মাতা হতে প্রথম জন্মগ্রহণ করে, পরে উপনয়ন হলে তাঁর দ্বিতীয়বার জন্ম হয়: তৎপরে যজ্ঞদীক্ষা লাভ করলে তাঁর তৃতীয় জন্ম হয় না। যখন লোকনাথের তৃতীয় জন্ম হয়েছিল, তখনই তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।

সিদ্ধিলাভের উপযুক্ত নির্জন পীঠস্থান ও ভিক্ষার সুবিধার জন্য ষড়দর্শনের বিখ্যাত পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাতও বেণীমাধবকে নিয়ে পরিত্যাগ করেছিলেন। প্রথমে পছন্দ করেন সাধনপীঠ ‘‘কালীক্ষেত্র বা কালীঘাট’’। তিনি তাঁদের দুজনকে নিয়ে নিবিড় বনে আচ্ছাদিত মহাতীর্থ সতী পীঠ কালীঘটে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। এখানে এসে সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে কিরকম আচার-আচরণ এবং ব্যবহার করেছিলেন, সে সম্পর্কে বারদীতে লোকনাথ বাবা জানিয়ে ছিলেন— ‘‘আমরা যখন কালীঘাটে এসে পৌঁছাই তখন বহুসংখক দীর্ঘ জটাজুটধারী সাধু-সন্ন্যাসী যেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমি ও বেণী দু’জন ওদের দেখে শান্তি পেয়েছিলাম।

বেশ কয়েকদিন ধরে আমরা তিন জন কালীঘাটকে নিজেদের বাড়িঘর মনে করে নিলাম সাধুরা যখন ধীর-স্থির ভাবে মনসংযোগে বসে থাকতেন, তখন বালস্বভাব সুলভ চপলতাবশতঃ আমরা কারোর মাথার জটায় হাত দিতাম বা পরণের লেংটিও ধরতাম, সাধুরাও আমাদের দুজনকে কোনও কিছু বলতেন না, আমরাও প্রশ্রয় পেয়ে ওদের চুলের জটা-লেংটি ধরে দৌড়ে পালিয়ে যেতাম। সাধুরা আমাদের ওদের ওপর উপদ্রব কয়েক দিন সহ্য করে অবশেষে আমাদের গুরুদেবকে বলেছিলেন। গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলি তাঁদের বলেছিলেন ‘আমাকে বলছেন কেন? আমি তো গৃহী। এ দু’জন আপনাদের লোক, আপনারা এদের প্রস্তুত করে নিন। আমি সংসার থেকে আপনাদের দু’জনকে সঙ্গে করে এনে আপনাদের কাছে উপস্থিত করে দিয়েছি মাত্র।’ এর উত্তর শুনে শাধুরা আর ভগবান গাঙ্গুলিকে কিছু বলতে পারেননি। সাধুরা ওই স্থান থেকে উঠে চলে গেলে ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথ-বেণীমাধবকে বলেন—‘তোমরা যে সাধুদের জটা খুলে দিচ্ছ এবং লেংটি ধরে টানাটানি, বড় হলে যখন অন্যেরা তোমাদের জটা-লেংটি ধরে টানাটানি করতে থাকবে তখন কি করবে?’’

লোকনাথ চাইলেন, তিনি চলে যাবেন বহুদূরে, পালন করবেন ‘কঠর ব্রহ্মচর্য এবং তাই-ই করলেন। প্রথমে নির্জনে যোগাভ্যাস আরম্ভ করলেন, ও এরপর কলোরবের মধ্যে মনোসংযোগ ও অধ্যায় শিক্ষার হাল ধরে রেখেছিলেন। ভগবান গাঙ্গুলি এবং শিক্ষা চললো কঠিন-কঠোর ভাবে।’ সন্ন্যাস গ্রহণের পর লোকনাথ ও ভগবান গাঙ্গুলি শেষ বারের জন্য জন্মভূমি দর্শনের উদ্দেশ্যে কচুয়াগ্রামে পৌঁছেছিলেন। কচুয়া থেকে মোহমুক্ত হয়ে তিনি আবার বেড়িয়ে পড়েছিলেন। মহাশয়ের ডাক উপেক্ষা করা তাঁর সম্ভব হল না।

আজ লোকনাথ বাবার ২৯৪ তম আবির্ভাব তিথি (সোমবার) সর্বত্রই মহা ধূমধাম সহকারে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে। এ বছর উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাতের দেগঙ্গায় চাকলায় শ্রীশ্রী লোকনাথ মন্দিরে প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও লোকনাথ সেবাশ্রম সংঘ আয়োজিত দু-দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানে জন্মাষ্টমীর দিনে লক্ষাধিক ভক্ত সমাগম হয়ে থাকে। হাজার হাজার ভক্ত মনস্কামনা পূর্ণের জন্য যশোর রোড-বেড়াচাঁপা টাকি রোড ধরে মাটি কুমেড়া পথ ধরে কলকাতার বাগবাজার ঘাট, ব্যারাক পুকুরের মণিরামপুর ঘাট, দাসপুর ঘাট, ত্রিবেণীর সপ্তীর ঘাট, নৈহাটি-বসিরহাট ঘাট থেকে পূর্ণ গঙ্গার জলে স্থান করে বাঁক কাঁধে জল নিয়ে পায়ে হেঁটে চাকলায় বাবার মান্দিরে আসেন স্নান করানোর জন্য। কথিত আছে এতে মনবাসনা পূর্ণ হয় ভক্ত-সাধারণ মানুষজদের। ভক্তদের নিরাপত্তা গাড়ি রাখার ব্যবস্থা সহ অন্যান্য ব্যবস্থার জন্য জেলা পুলিশ প্রশাসন চাকলা লোকনাথ সেবাশ্রম সংঘের সঙ্গে আগেভাগেই বৈঠক সেরেছেন। জেলাশাসক শরদ কুমার দ্বিবেদী, বারাসত পুলিশ জেলার সুপার প্রতীক্ষা ঝাড়খড়িয়া, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, মহুকুমা শাসক সোমা দাস, স্থানীয় বিধায়ক রহিমা মম্ডল এবং লোকনাথ সেবা সংঘের সভাপতি সমীর রায়, সহ: সভাপতি অশোক কুণ্ডু, সম্পাদক সুব্রত হাজরা ও স্বপন সেন সহ অন্যান্যদের সঙ্গে সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা সেরেছেন বলে প্রতিবেদককে জানালেন প্রবীণ অন্যতম কর্মকর্তা অশোক কুণ্ডু মহাশয়। রবিবার-সোমবার (২৫-২৬) আগস্ট দু-দিন যশোর রোড টাকি রোডে যানজট সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশ-নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীদের। মন্দিরে প্রবেশ ও প্রস্থান স্থানে ৩টি পথে ও মন্দির সংলগ্ন স্থান সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা এবং মেটাল ডিটেক্টর বসানো হয়েছে। পর্যাপ্ত পানীয় জল, মেডিকেল টিম-অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে। পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝাড়খড়িয়া প্রতিবেদককে জানিয়েছেন যে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে এই দু-দিন মন্দির সংলগ্ন ও বাইরে পর্যাপ্ত পুলিশ ব্যবস্থা থাকছে, কোথাও কোনও সমস্যা দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ পুলিশ পৌঁছে যাবে।