• facebook
  • twitter
Thursday, 21 November, 2024

পুরাণের কালীই কি ফিনল্যান্ডের কালমা

কেউ বলবেন দীপাবলী, কেউ দেওয়ালি, কিন্তু গোদা বাংলায় কালীপুজো। এদিনটিকে বলা হচ্ছে, আলোর উৎসব। লিখলেন চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য।

কেউ বলবেন দীপাবলী, কেউ দেওয়ালি, কিন্তু গোদা বাংলায় কালীপুজো। এদিনটিকে বলা হচ্ছে, আলোর উৎসব। ঘোর অমাবস্যায় এই আলোর রোশনাই মানুষের মনের অন্ধকার দূর করতে পারলে ভাল হতো, কিন্তু হয়নি। হয় না। উত্তর ও পশ্চিম ভারতের অনেক প্রদেশের পাশাপাশি এই রাজ্যেও অনেকের কাছে আবার লক্ষ্মীপুজো। আগের দিন ভুত চতুর্দশীতে অলক্ষ্মীকে বিদায় করে লক্ষ্মীর পুজো হয়। শুধু অনেকের বাড়িতেই বা কেন, কলকাতার সর্বজনস্বীকৃত কালীক্ষেত্র কালীঘাটের মন্দিরে এইদিন মহালক্ষ্মীর পুজো হয়। আর বীরভূমের আকালীপুরে মহারাজ নন্দকুমার প্রতিষ্ঠিত গুহ্যকালীর মন্দিরে মূল পুজো হয় আশ্বিনের পূর্ণিমায়, যেদিন বাংলায় হয় কোজাগরী লক্ষ্মীর আরাধনা। কীভাবে যেন লক্ষ্মী আর কালী মাঝে মাঝেই একে অপরের জীবন যাপনে জড়িয়ে গেছেন। হিমাচলের বশৌলির একটি প্রাচীন চিত্রকলায় দেখা যায়, কালীর হাত থেকে ভরা পাত্র মদ পান করছেন লক্ষ্মীদেবী। ভারতের হিন্দু মতের দেবীরা এমন ভাবেই একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে, মনে করা হয়, দুর্গাই মহালক্ষ্মী, আবার দুর্গাই কালী। কালী যিনি, তিনিই দুর্গা আর দুর্গা যিনি, তিনিই লক্ষ্মী।

তবে একেক দেবীর একেক রকম কাজের ক্ষেত্র। দুর্গার যদি হয় অসুরবিনাশ, লক্ষ্মীর কাজ ধনসম্পদের বরদান। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, মহিষাসুরকে বধ করার জন্য সমস্ত দেবতাদের রোষানল থেকে জন্ম নিয়েছিলেন অপরূপা সুন্দরী এক নারী তিনিই দুর্গা। অর্থাৎ, তিনি মাতৃগর্ভজাতা নন। বিশেষ প্রয়োজনে দেবতারা তাঁকে সৃষ্টি করেছেন। আবার সেই দুর্গাই শুম্ভ নিশুম্ভকে বধ করার সময় অসহায় হয়ে কালীর সাহায্য প্রার্থনা করছেন। বিশিষ্ট গবেষক সুকুমার সেন মার্কণ্ডেয় পুরাণ বর্ণিত সেই দেবীর বর্ণনা দিয়েছেন। “শুম্ভনিশুম্ভের সেনাপতিদ্বয় চণ্ড ও মুণ্ড যখন দেবীর বাহিনীকে হারিয়ে দিচ্ছিল তখন দেবীর ক্রোধ যেন কালীর বীভৎস মূর্তি ধরে বেরিয়ে আসে ও চণ্ড-মুণ্ডকে হত্যা করে। … তার মুখ ভয়ঙ্কর। তলোয়ার ও ফাঁস নিয়ে, বিচিত্র ঢাল ধরে। মানুষ (অর্থাৎ মানুষের মুণ্ড বা অঙ্গ) মালা করে পরে, বাঘের ছাল জড়িয়ে। গায়ের মাংস শুকিয়ে গেছে। অত্যন্ত ভয়ঙ্কর দেখতে। মুখে প্রকাণ্ড হাঁ। জিব ভয়ঙ্করভাবে লক্‌লক করছে। বসে গেছে লাল চোখ। ডাকে চারদিক মুখরিত”।

আবার, ‘শ্রেষ্ট হিন্দু কবি’ কালীদাস তার কুমারসম্ভব কাব্যে লিখেছেন, কার্তিকের জন্মের প্রয়োজনে ঊমাকে বিয়ে করতে মহাদেব যখন কৈলাশ থেকে বরযাত্রীদের নিয়ে উমার বাপের বাড়ি যাচ্ছেন, তখন সেই বরযাত্রী দলের মধ্যে নাচতে নাচতে চলেছেন ‘নরাস্থি -অলঙ্কার পরা কালী’। তিনি নগ্না, নরকরোটির মালা গলায়। কিন্তু কালীদাস কালীকে শিবের সহচরী হিসেবে দেখালেও তার স্ত্রী, একথা বলেননি।
পুরাণ ও সাহিত্যে কালীর প্রাচীনত্বের খোঁজ করেছেন অনেকেই, যার মধ্যে অন্যতম সুকুমার সেন। তার মতে, ঊষা ও নিশার উপাসনা অত্যন্ত প্রাচীন। এই নিশা বা রাত্রি থেকে কালীর উত্থান ঘটেছে মনে করেছেন তিনি। তিনি যে তিনটি রূপকল্প নিয়ে আলোচনা করেছেন, তার প্রথমটি ‘ঋগ্‌বেদের নক্‌ৎ-কৃষ্ণী, যিনি পৌরাণিক মহাদেবীর খোলসের মতো’। এর পরে, তৃতীয় শতকে চোল রাজার ভাই ইলাঙ্গো অডিগালের লেখা তামিল মহাকাব্য ‘শিলপদ্দিকারম’-এ এক দেবীর বর্ণনা পাই। গভীর জঙ্গলে আদিম শবর, মারবার জনগোষ্ঠীর যোদ্ধারা তার আরাধনা করছে যুদ্ধে জয়লাভের আশায়। তারা নিজের শরীর কেটে রক্ত সমর্পন করছেন দেবীর কৃপালাভের আশায়। সেই দেবী কৃষ্ণাঙ্গী, ভিষণদর্শনা, করালবদনী, পিনোন্নতপয়োধরা। উলঙ্গ এই দেবীর দুটি মাত্র হাত। তিনি একটি মোষের মাথার উপরে দণ্ডায়মান। আরও তিন চার শকর পরে এই মূর্তি স্থাপিত হয় তামিলনাড়ুর ব্রহ্মপুরীশ্বর মন্দিরে।

উল্লেখ্য, মহাভারতের পরিশিষ্ট অংশ, যা আবশ্যিক ভাবেই অনেক পরের সংযোজন বলে মনে করা হয়, তাতে বিন্ধ্যবাসিনী বলে এক দেবীর বর্ণনা রয়েছে। পরিশিষ্টের হরিবংশ পর্বে বলা হয়েছে, ‘হে দেবী, তুমি গভীর জঙ্গলে, শ্মশানে, গিরিগুহায় অবস্থান করো। তোমাকে ঘিরে থাকে হিংস্র শ্বাপদ (আজকের কালী মূর্তির সঙ্গে আমরা যেমন রক্তপিপাসু শিয়াল রাখি)। বজ্রপাত ও মেঘের ঘণ্টাধ্বনীতে তোমার আরাধনা হয়। হে বিন্দ্যবাসিনী দেবী, তুমি আমাদের আশীর্বাদ করো’।

আমাদের চেনা কালী মূর্তির রূপকার বলা হয় নবদ্বীপের কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে। তা নিয়ে অনেক কল্পকথা ও গল্পকথাও প্রচলিত আছে। হ্যাঁ, স্মিত হাস্যময়ী বাঙালি কালীর তিনিই রূপকার, মানতে অসুবিধাও নেই। কিন্তু, তাঁর সেই রূপকল্পনা তিনি অনেকটাই নিয়েছিলেন তৃতীয় শতকের দ্বিতীয় ভাগে রচিত বৃহদ্ধর্মপুরাণ থেকে। বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুযায়ী, কালী “স্বাস্থ্যবতী, শ্যামবর্ণা, দিগম্বরী, মুক্তকেশী। শবরূপ মহাদেবের উপরে আসীন। তাঁর জিভ মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে। দুই বাম হাতে অসি ও মানুষের মাথা, সংহারকালের মত সংহারী মূর্তিতেও কোটির পাপ বিনাশ করছেন। আবার তাঁর দেহে নানা অলংকার, মুখে হাসি, ডান দুই হাতে অভয় ও বরদানের মুদ্রা।”

কালীক্ষেত্র আন্দোলনের পুরোধা ড. তমাল দাশগুপ্ত মাতৃকাধর্মের ইতিহাসবিদ অশোক রায়কে উল্লেখ করেছেন তাঁর একটি নিবন্ধে। গবেষক রায় লিখেছেন, “কালী, দুর্গা, চামুণ্ডা ও অম্বিকা একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় একের বৈশিষ্ট্য অন্যের মধ্যেও সঞ্চারিত হল দশম একাদশ শতাব্দীর রচনায়, পাল ও সেন যুগের মূর্তিশিল্পে। এই সব মূর্তিতে দেবীর মুখ হাসি হাসি, চার হাতের তিন হাতেই কপাল, মাথার খুলি লাগানো খট্বাঙ্গ ও মাথা নিচের দিকে করে ঝুলন্ত শিশুর দেহ। মূর্তিতে দুর্গা, কালী ও চামুণ্ডার বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটেছে। আরেক মূর্তিতে ললিতাসনা দেবীর গলায় মুণ্ডমালা, শুষ্কদেহ, অভুক্ত পেট গর্তে ঢুকে গিয়েছে। খিদের জ্বালা বোঝাতে বিছের ছবি। চার হাতের দুই হাতে কর্তরী ও কপাল, এক বাহুতে ত্রিশুল। দেবীর ডান পা এক নগ্ন পুরুষের দেহের উপর। পুরুষটি জীবিত না মৃত বোঝা যায় না।

চামুণ্ডার আসনে শবের সংযোজন অনেক পরে, ক্রমে যা শব থেকে শিবে পরিণত হয়েছে। একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর মন্দির গাত্রের ভাস্কর্যে দেখা যায়, দেবী নৃত্যরতা; শুষ্কদেহ, গর্তে ঢোকা পেট, গলায় মুণ্ডমালা। কোথাও দেবীর ছয় হাত। ডানদিকের হাতগুলোতে কপাল, কর্তরী ও ঢাল সমেত শূলবিদ্ধ এক মানবদেহ। আর বাঁদিকের হাতগুলোতে ত্রিশূল, ঘণ্টা ও মানুষের মাথা। ত্রিশূলের পিছন দিক দিয়ে বিদ্ধ এক মনুষ্যদেহ থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত শিয়াল খাচ্ছে। দেবীর কানে শিশু-শবের কুণ্ডল। পায়ের কাছে মনুষ্যদেহ, সম্ভবত জীবন্ত। এছাড়া মন্দির ভাস্কর্যের কুলুঙ্গিতে শিবলিঙ্গ; যা চামুণ্ডাকালীর সঙ্গে শিবের সংযোগের আদি রূপকল্পনা সূচিত করে।

একটা বিষয় স্পষ্ট, দেবী কৃষ্ণাঙ্গী এবং সমাজের সবচেয়ে নিম্নবর্গের মানুষদের আরাধ্যা ছিলেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবীকে বলা হয়েছে ‘সর্বশবরানাং ভগবতী’। সব শবরদের দেবী। শবরদের দুটি ভাগ – নগ্নশবর ও পর্ণশবর। নগ্নশবরদের উলঙ্গিনী দেবী, যাকে কালীদাস শুদ্ধ শব্দে ‘অপর্ণা’ বলেছেন, যখন পর্ণশবরদের জয়ে করে তাদেরও নেত্রী হয়ে গেলেন, তিনি হলেন ‘সর্বশবরানাং ভগবতী’। পর্ণশবররা তাঁকে পাতার পোশাকে সাজালেন। আরও পরে আর্যরা যখন তাঁকে দেবী মানলেন, তখন তার জন্য জুটল শাড়ি, তিনি হলেন ভদ্রকালী।

কালীকে মৃত্যুর সঙ্গে জুড়ে দেখানো হয়েছে পুরাণগুলিতে। মাটির নিচে পাতালের দেবী বলা হয়েছে, নাম হয়েছে পাতালভৈরবী। তিনি কৃষ্ণবর্ণা, আঠারোটি হাত তার। ঠিক তেমনই, ভারত থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে আরেক কৃষ্ণবর্ণা দেবীর দেখা পাওয়া যায়, যার নাম কালমা। তাঁকে পাওয়া যায় উত্তর মহাসাগরের কোলঘেঁষা ফিনল্যান্ডে। বীভৎস তাঁর রূপ। গায়ের রঙ কালো। হাতে বিরাট একটা বল্লম। তিনি স্বয়ং মৃত্যুরূপী দেবী। সেই শ্রীমতী ভয়ঙ্করীর বসবাস বনে জঙ্গলে, ঘোরেন ফেরেন শ্মশানে-মশানে, কবরখানায়। তাঁর সারা শরীরে হাড় ও করোটির মালা ঝুলছে। গায়ে শবের দুর্গন্ধ। তাঁর কালমা নামটা এসেছে ফিনিস শব্দ ‘কালমিস্টো’ থেকে, যার অর্থ কবরখানা বা শ্মশান। তার বাহন হল ধোয়ার আস্তরণের চাকা।

ফারাকও আছে অবশ্যই। আমাদের মা কালীর বাবা, মায়ের খোঁজ দিতে পারেননি কোনও ঋষি, মুণি, পুরাণকার, স্মৃতি-শ্রুতি-উপনিষদ-বেদের রচয়িতারা। ফিনল্যান্ডের কালমা-র কিন্তু বংশ পাওয়া যায়। কালমা-র মায়ের নাম টোউনেটার, বাবার নাম টোউনি। কালমার বোনেদের নাম কিপু-টিট্টো, কিভুটার, লোভিয়াটার, বাম্মাতার ইত্যাদি। এঁরা সবাই মৃত্যুরূপী কালমার সাথী, ঠিক যেমন আমাদের ডাকিনী-যোগিনী। কালমার রক্ষক হলেন ‘সুরমা’। ফিনিস মহাকাব্য ‘কালেভালা’ অনুযায়ী, সুরমা নামের অর্থও মহামৃত্যু। মহামরণ।

কেবল ফিনল্যান্ডেই নয়, মৃত্যুরূপী দেবীর উপস্থিতি আছে আরও বহু দেশে, বিশেষত প্রাচীন সভ্যতার দেশগুলিতে। আছে গ্রিসে, আজটেকে, পারস্যেও। সে সব না হয় আরেক পর্বে বলা যাবে।