সুপ্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
করুণাময়ী জুয়েলার্সে হালখাতায় এবার এলাহি আয়োজন৷ কেক-মিষ্টি-রোল৷ কিন্ত্ত প্যাকেট খুলতেই এ কী! সব প্যাকেট থেকে রোল উধাও৷
প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে হালখাতায় মিষ্টি জোগাড় করাটা নন্টে, পটলা আর ঘেঁটুর মায়েদের অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেল৷ প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে সকাল সকাল খেয়ে দেয়ে তিনজনার মা বেরিয়ে পড়তেন হালখাতা করতে৷ আর সঙ্গে থাকত যে যার মায়েদের সঙ্গে নন্টে, পটলা আর ঘেঁটু৷ কোন দোকানের প্যাকেটে কী আছে, ওদের মায়েদের সব মুখস্থ৷ নন্টে, পটলা আর ঘেঁটু সকালে দুটো করে প্যাকেট নিত৷ ভালো, ভারী বাক্সের জন্য একটা ব্যাগ আর হালকা কমা বাক্সের জন্য আরেকটি ব্যাগ, সেই বাক্সেই চালান হত ফ্রুটি, লজেন্স জাতীয় বস্ত্তগুলো৷
প্রথমে দোকানে ঢুকলেই খাতির করে গায়ে দেওয়া হত এসেন্স, তারপর গ্লাসে ঠান্ডা পানীয়, সাজানো থাকত কত ধরনের বাদাম, চানাচুর, কফি, চা, পান৷ ছোটরা টপাটপ করে মুখে পুরত ট্রফি, খেয়েই গরম কফিতে দিত চুমুক৷ হুড়োহুড়ি করে খেয়েই বেরিয়ে পড়া, যেতে হবে পরের দোকানে৷ না, প্যাকেট নিতে কেউ মিস করত না৷
কিন্ত্ত ওরা জানত যে যত ভালো প্যাকেট করুক ‘করুণাময়ী জুয়েলার্সের’ মতো প্যাকেট— যেমন ভারী আর রং বাহারি— ও প্যাকেটের ইজ্জতই ছিল আলাদা৷ তাই সকলেরই লক্ষ্য অন্য দোকানগুলোয় যাওয়া হোক আর না হোক, করুণাময়ী জুয়েলার্সের হালখাতার প্যাকেট কোনওভাবেই মিস করা যাবে না৷ আর ওই দোকানের মালিক সন্দীপ কাকু, নন্টে, পটলা আর ঘেঁটুকে প্রায় চিনেই গেছে৷ দোকানে ঢুকতেই সন্দীপ কাকু বলে ওঠেন, ওরে ওরা এসে গেছে, দে দে ওদের ঠান্ডা দে, বৌদিমণিদের কফি দে, বোসো বোসো খোকাবাবুরা৷ নন্টে, পটলা, ঘেঁটু একে অপরের চোখ চাওয়াচাওয়ি করে৷ ইশারা করে প্যাকেট কী আছে দেখার ইচ্ছায়৷ সন্দীপকাকু বুঝতে পেরে বলে ওঠে, ওরে খোকাবাবুদের একবার প্যাকেটগুলো খুলে দেখিয়ে দে তো প্যাকেটে কী আছে৷ ওরা আর ওদের মায়েরা দেখে কেক, মিষ্টি, রোলে প্যাকেট ভর্তি৷ লজ্জায় গদগদ হয়ে ওদের মায়েরা বলে ওঠে, না না দাদা, প্যাকেট দেখাবেন কেন? আমরা তো জানি এই এলাকার সব দোকানের চাইতে আপনার দোকানের হালখাতার প্যাকেট সব দিক দিয়ে সেরা৷
এইভাবে হালখাতা করতে করতে নন্টে বেশ ক্লান্ত৷ সব্বাই বলল নন্টে তুই বরং একটু বোস, ব্যাগগুলো তোর কাছে থাক৷ আমরা অন্য দোকান থেকে হালখাতার প্যাকেটগুলো নিয়ে আসি৷ নন্টে ভাবে সেই ভালো৷ নন্টেকে সবাই ব্যাগগুলো দিয়ে প্যাকেট আনতে চলে যায়৷
নন্টে দেখে কিছু ছোট ছোট বাচ্চা তার কাছে এসে বলছে, দাদা তোমরা তো অনেক প্যাকেট পেয়েছ, আমাদের একটা করে মিষ্টি দাও না৷ নন্টে ভাবে, এঁ্যা, আমরা কষ্ট করে প্যাকেট জোগাড় করছি, তোদের মিষ্টি দেব? যা ভাগ৷ আবার ভাবে, আমাদের তো এত প্যাকেট, যদি এখান থেকে দুটো করে মিষ্টি দিয়েই দিই, ওরা তো একটু খেতে পাবে৷ এই ভেবে নন্টে প্রত্যেকের ব্যাগের চকচকে করুণাময়ী জুয়েলার্সের বড় প্যাকেট থেকে রোলগুলো বের করে ভিখারি ছেলেগুলোকে দিয়ে দেয়৷ ওরাও খুব আনন্দে রোলগুলো খেতে খেতে চলে যায়৷
যথা সময়ে পটলা, ঘেঁটুরা তাদের মায়েদের সঙ্গে আর নন্টের মা কয়েকটা করে প্যাকেট নিয়ে এসে যে যার প্যাকেটগুলো যে যার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল৷
এবার বাড়ি ফেরার পালা৷ মায়েরা বলল, আচ্ছা কোন প্যাকেটটা সবচেয়ে সেরা হলো দেখলে হত৷ এই বলে সবাই বলে উঠল করুণাময়ী জুয়েলার্সের প্যাকেটটাই সেরা হবে বলে মনে হয়৷ এই বলে সবাই প্যাকেট খুলে অবাক৷ সব প্যাকেট থেকে রোল উধাও৷ ওদের মায়েরা বলল, চলো সন্দীপদার কাছে যাই৷ নিশ্চয়ই ভুল করে ওই বাক্সগুলোয় রোল দিতে ভুলে গেছে৷ আমাদের রোলগুলো চেয়ে নিতে হবে৷ নন্টে, পটলা আর ঘেঁটুর মা সবে বের হতে যাবে, সেই সময় নন্টে বলে ওঠে, মা, আমি ওই বাক্সগুলো থেকে রোল বের করে ভিখারি ছেলেদের দিয়ে দিয়েছি৷ এই কথা শুনে নন্টের মা নন্টেকে এই মারে তো এই মারে৷ এমন সময় পটলা আর ঘেঁটুর মা নন্টের মায়ের হাতটা ধরে ফেলে৷ ওনারা বলেন, নন্টের মা, নন্টে আজ বছরের প্রথম দিনে সবচেয়ে ভালো কাজটা আমাদের হয়ে করে দিয়েছে৷ সেটা হল, ওই না খেতে পাওয়া বস্তির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মুখে মিষ্টি তুলে দিয়েছে৷ আজকের দিনে পয়লা বৈশাখের সুন্দর অনুষ্ঠানটা নন্টেই করল৷ নন্টের মায়ের চোখ দিয়ে পয়লা বৈশাখের আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল৷