বাঙালি এক কালে ছিল যোদ্ধা জাতি। দুর্ধর্ষ নির্ভীক বীর যোদ্ধা। অন্য জাতিরা এই যোদ্ধা বাঙ্গালীকে ভয় পেত। তাই খুব সহজে তারা বাংলা আক্রমণের হঠকারিতা করত না। অবশ্য তখন বাঙালির বা বাংলার নাম ছিল গঙ্গাবিডি যা বর্তমানে বাংলা।
না মশাই, এ কোন গাল গল্প নয় কিংবা আজগুবি লোক গাঁথা নয়, ইতিহাস। যাকে এক কথায় বলে সত্য। যারা মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা (INDICA) গ্রন্থ পড়েছেন তাদের কাছে বিষয়টা অজানা নয়। বিখ্যাত মেগাস্থিনিসের লেখা ইন্ডিকা গ্রন্থে আলোচ্য বিষয় আলোচিত হয়েছে। তখন বাংলা বলতে বুঝানো হতো গঙ্গাবিডিকে। তখন গঙ্গাবিডি অর্থাৎ বাঙালি ছিল শৌর্য বীর্যে পরাক্রান্ত এক দুর্ধর্ষ জাতি। তাদের সকলেই ভয় পেত, সমীহ করতো। তারা যুদ্ধে যেমন পটু ছিল অস্ত্র চালনাতেও তেমন দক্ষ বীর বিক্রমশালী! তাহলে কেন এই ব্যাপক পরিবর্তন? কেন অবশেষে ভেতো বাঙালি বদনাম! এর অনেক কারণ আছে। আর এই পরিবর্তন বা বিবর্তন এক বছর দুবছর বা কয়েক দশকেও নয়, শত শত বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে এই পরিবর্তনের অনেকগুলি কারণ এর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো আর্যদের আবির্ভাব ও প্রভাব। আর্যদের আগমনের পর থেকেই গঙ্গাবিডি জাতির মধ্যে একটা মৌলিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তাদের চলাফেরা জীবনধারণ পদ্ধতি, তাদের শিক্ষা দীক্ষা সংস্কৃতি সব কিছুরই একটা ভিন্নমুখী পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে। জানা যায় আর্যদের প্রভাবেই গঙ্গাবিডি ক্রমশ শিক্ষা সংস্কৃতি ইত্যাদি ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে পড়ে। ক্রমশ তারা তলোয়ার ত্যাগ করে কলম ধরে। ফলে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে এক বুদ্ধিজীবীসুলভ প্রকৃতির প্রকাশ ঘটে। অবশেষে তারা যোদ্ধা জাতি থেকে বুদ্ধিজীবী জাতিতে পরিণত হয়। একইসঙ্গে ধর্ম এবং ধর্মীয় আচার-আচরণ অনুষ্ঠানের প্রভাব বাড়তে থাকে যা আগে এমন ছিল না। বলাবাহুল্য, তখন নববর্ষ ছিল না, তাই নববর্ষে উৎসবের প্রশ্নও ছিল না।
শত সহস্র বছর আগে প্রাচীন ইতিহাসের কথা বাদ দিলাম। মাত্র অর্ধশতকের মধ্যেই বাঙালির নববর্ষ এবং বাংলা সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেল। যা ভাবতে অবাক লাগে! আমাদের ছোটবেলায় অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৬০-৭০ বছর আগে আমাদের দেখা নববর্ষ! আর এখন দেখা নববর্ষ, মনে হয় যেন ভিন্ন দেশে রয়েছি। যেমন ধরুন শান্তিনিকেতনের কথা আগে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকাকালীন শান্তিনিকেতনে নববর্ষ পয়লা বৈশাখেই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করা হতো। এর প্রধান কারণ ছিল ২৫ বৈশাখ আসল জন্মদিনে আশ্রমিকগণ অধিকাংশই এবং ছাত্র-ছাত্রীরা ছুটিতে বাড়ি চলে যেত, তাই পয়লা বৈশাখ রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করা হতো। পঁচিশে বৈশাখও একটা অনুষ্ঠান হতো তবে মূল অনুষ্ঠান ওই পয়লা বৈশাখেই। সেসব এখন চুকে বুকে গেছে। কয়েক বছর আগে জনৈক উপাচার্য, যিনি অমর্ত্য সেনের বাড়ি দখল করতে চেয়েছিলেন, সবচেয়ে বড় কথা যিনি রবীন্দ্রনাথকেই বলেছিলেন ‘বহিরাগত’, তার আমলেই এইসব “অনাচার” বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে শেষ জন্মউৎসব পয়লা বৈশাখে পালিত হয় ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে (১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ)। তখন কবি ছিলেন অসুস্থ। অনেকেই ভেবেছিলেন, সেদিন তিনি বোধহয় আর ঘরের বাইরে আসবেন না। কিন্তু প্রতিবারের মতো ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ তার উজ্জ্বল চকচকে পোশাক পরে উদয়নের দক্ষিণের বারান্দায় এসে বসেছিলেন। শান্ত সৌম্য উজ্জ্বল এক দেব ঋষি। প্রতিবারের মতো সেবারেও প্রথম এসে অর্ঘ্য নিবেদন করেছিলেন রানী চন্দ্র। কচি শালপাতায় মুড়ে কবির প্রিয় জুঁই ফুল তিনি অর্পণ করেছিলেন কবিকে। তারপর একে একে অনেকেই এসে তাঁকে প্রণাম করে যান।
এখন বাঙালি ধনতেরাস কিম্বা ভ্যালেন্টাইন্স ডে প্রভৃতি নিয়ে যতটা মেতে ওঠে সে তুলনায় নববর্ষে তার উৎসাহ উদ্দীপনা অনেকটাই কম চোখে পড়ে। যেটুকু হয় তা বাঙালি অবাঙালি সাহেবিয়ানার এক জগাখিচুড়ি সংমিশ্রন। অবশ্য বাঙালিয়ানা নেই বললে চলবে না। কারণ এই এক দিন অনেকেই বাঙালির ভেক ধরে, ভাড়া করা কিংবা বছরে একবার ব্যবহারের উপযুক্ত ধুতি পাঞ্জাবি পরা, একটু গান বাজনা করা, নৌকা বিহার এবং ঘটা করে পুজো করতে দেখা যায়। তবে একটা ঐতিহ্য আজও আছে তা হলো হালখাতা বা নতুন খাতা। ব্যবসা বাণিজ্যের সঙ্গে যারা যুক্ত ছোট কিংবা বড় সকলেই এই দিনে নতুন খাতার প্রবর্তন করেন যা হালখাতা নামে পরিচিত। সকলের যথাসম্ভব দেনা পাওনা মিটিয়ে নতুন করে হিসাব শুরু করেন ব্যবসাদাররা। এতে ব্যবহার করা হয় সাদা কাগজের লাল কাপড়ে মোড়া এক ধরনের খাতা যাকে খেরোর খাতা বলে। দক্ষিণেশ্বরে থাকার সুবাদে দেখেছি আগের দিন মাজ রাত থেকে দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের লাইন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যা বালি ব্রিজ অতিক্রান্ত করে। শেষ পর্যন্ত আবার অনেকেই তুলনায় ফাঁকা আদ্যাপীঠের মন্দিরে এসে লাইন লাগায়। সকলের ঝুড়িতে লক্ষ্মী গণেশের মূর্তি ও নতুন খাতা দেখা যায়। তার সঙ্গে অনেকের ঝুড়িতে শোভা পায় ল্যাপটপ।
আমাদের ছোটবেলায় নববর্ষের দিনে এমন জাঁকজমক, মাইক, ডি জে সহ নাচ গান কিংবা বাজি ফাটানোর প্রচলন ছিল না। হ্যাঁ, প্রভাতফেরি হতো শাঁখ বাজিয়ে, গান গেয়ে ছেলেরা মেয়েরা পাড়া পরিক্রমা করত। মন্দিরে মন্দিরে পুজো দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। আর যারা পারত তারা নতুন পোশাক পরতো। তবে এই দিনে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা প্রায় সব পাড়াতেই হত। স্থানীয় ক্লাব কিম্বা হঠাৎ উদ্যোগী হওয়া পাড়ার মানুষেরা এইসব খেলাধুলা, প্রতিযোগিতা, ঘরোয়া সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। যেমন আমি ছোটবেলায় যুক্ত ছিলাম বিন্ধ্যবাসিনী ব্যায়াম সমিতির সঙ্গে। আরিয়াদহে অবস্থিত এই ক্লাবটি জিমন্যাস্টিকের শো হতো প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে। লাঠি, ছুরি খেলা, ব্যায়াম প্রদর্শনী এবং আরো নানা ধরনের ক্রীড়া ও জিমন্যাস্টিক প্রদর্শিত হতো। ওই দিনে আমি নিজেই চার ধরনের জিমন্যাস্টিক খেলা দেখাতাম, তখন অবশ্য আমার প্রথম নামটি ব্যবহার করা হতো। তাছাড়া স্থানীয় অঞ্চলে নৌকাবাইজ, দৌড় প্রতিযোগিতা, ফুটবল প্রতিযোগিতা, ব্রতচারী প্রভৃতি খেলা হতো। তখন অবশ্য ক্রিকেট মোটেই জনপ্রিয় ছিল না খুব একটা দেখাও যেত না স্থানীয় অঞ্চলে।
সন্ধ্যায় প্রধান আকর্ষণ ছিল দোকানে দোকানে হালখাতার মিষ্টির প্যাকেট এবং শরবত, যা বিনি পয়সায় মিলতো। এখনো অবশ্য এই প্রথা আছে, সঙ্গে চালু হয়েছে টাকার বিনিময়ে নানা ধরনের গিফট বা উপহার দেয়া। তবে নতুন ক্যালেন্ডারের লোভ ছিল । পহেলা বৈশাখের আরেকটা আকর্ষণ ছিল নতুন পঞ্জিকা বা পাঁজি। তখন পাঁজি বলতে মূলত গুপ্তপ্রেশ পঞ্জিকাকেই বোঝানো হতো। তবে সেই সব পাঁজি নতুন বছরের মাত্র কয়েকদিন আগে বাজারে আসত, এখনকার মতন ছ মাস আগেই দোকান দখল করে নিত না।
তবে অর্ধশত বছর আগের থেকে বর্তমানের একটা পরিবর্তন অত্যন্ত লক্ষণীয়, ইতিবাচক এবং উৎসাহব্যাঞ্জক বলেই মনে করি। তা হচ্ছে কলেজ স্ট্রিটের বই পাড়া। আগেও পহেলা বৈশাখের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নতুন নববর্ষ সংখ্যা প্রকাশিত হতো এবং কিছু বই পত্র প্রকাশিত হতো। প্রকাশকগণ অনেকেই নিমন্ত্রণ জানাতেন লেখকদের, কিছু কিছু জায়গায় সাহিত্যসভা অনুষ্ঠিত হত। এখন সাহিত্য সভা তেমন না হলেও আমন্ত্রণের প্রথাটা এখনো আছে। আর যা সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হয়েছে তা হল বই প্রকাশ। বিভিন্ন ধরনের বই প্রকাশ অত্যন্ত ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দিন কয়েকশো বই কলেজ স্ট্রিটে প্রকাশিত হয় যা অবশ্যই প্রশংসনীয় এবং এখনো পুরনো ঐতিহ্য অনুসারে প্রকাশকরা অন্তত এই একটি দিনের জন্য নবীন প্রবীণ সব লেখকদেরই আমন্ত্রণ জানান তাদের দরবারে।
তবে এই একটি মাত্র দিনই আমরা বাংলা সাল তারিখ মনে রাখি, মুখে বলি। এরপরেই ভুলে যাই, এটা কোন মাস কোন তারিখ তো দূরের কথা। কোন সাল বা বঙ্গাব্দ আমরা সঠিকভাবে বলতে পারি না। অবশ্য এই বৈশাখে আর একটা তারিখও আমরা বাংলায় ব্যবহার করি তা হল পঁচিশে বৈশাখ, কিন্তু এর ব্যাপক প্রচলন আজও ঘটেনি, এটা সীমাবদ্ধ সংস্কৃতি সম্পন্ন কিছু মানুষের মধ্যেই। অর্থাৎ আমরা বাঙালি সাজি বছরে একদিন। তা ওই সাধের পয়লা বৈশাখ।বলা যায় আমরা হলাম একদিনের বাঙালি! আবার ওই দিনেই আমরা মোবাইলে টাইপ করি, ‘হ্যাপি নব বরস!’