মধুবন চক্রবর্তী
সংগীতের অনন্ত যাত্রাপথে তিনি রাগরাগিণীর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন অত্যাশ্চর্যভাবে৷ যে রাগরাগিণীকে আমরা পেয়েছি তানসেন, সদারঙ্গ, যদুভট্টের ধ্রুপদে, খেয়ালে, উচ্চাঙ্গ-সংগীতে— কঠোর অনুশাসনের বন্দীশবাঁধা, আরোহন অবরোহনের সীমানা ঘেরার মধ্যে, তারাই আবার স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে মুক্ত আকাশে বিহঙ্গ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানে৷ ঐতিহ্যের প্রথা ভেঙে এমন সব স্বরবিন্যাসের আমদানি করেছেন যা, প্রথাগতভাবে সম্ভব নয়৷ সেই মুন্সিয়ানা একমাত্র কবিগুরুই দেখাতে পেরেছিলেন সেই সময়৷ ‘সংগীতের উদ্দেশ্য’ নামক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন ‘যদি মধ্যম স্থানে পঞ্চম দিলে ভালো শোনায়, আর তাহাদের বর্ণনীয় ভাবের সহায়তা করে তবে জয়জয়ন্তী বাঁচুন বা মরুন আমি পঞ্চমকেই বহাল রাখিব না কেন?’ রাগারাগিণীর বিষয়ে আলোচনা করার সময় বলেছেন, ‘গানের কাগজে রাগরাগিণীর নাম নির্দেশ না থাকাই ভালো৷ নামের মধ্যে তর্কের হেতু থাকে৷ রূপের মধ্যে না৷ কোন রাগিণী গাওয়া হচ্ছে বলবার দরকার নেই৷ কি গাওয়া হচ্ছে সেইটাই মুখ্য কথা৷ নামের সত্যতা দশের মুখে, সেই দশের মধ্যে মনের মিল নাও থাকতে পারে৷’ অর্থাৎ রাগরাগিণীকে তিনি তাঁর সংগীতে ব্যবহার করেছেন ভাবের দ্যোতক হিসেবে৷ ভাবকেই ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছেন৷ ভাবের মধ্য দিয়েই রূপকল্প, চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন অর্থাৎ ভাব মুখ্য হয়ে উঠেছে৷ রাগ, ভাব প্রকাশের অবলম্বন হয়ে উঠেছে মাত্র৷
ভৈরবী রবীন্দ্রনাথের প্রিয় রাগগুলির মধ্যে অন্যতম৷ অসংখ্য গান রচনা করেছেন ‘ভৈরবী’ রাগে৷ গান রচনা করলেও, রাগের অন্তর্নিহিত ভাবটি ফুটলো কি না, সে বিষয়ে তিনি অধিক নজর দিয়েছিলেন বিভিন্ন সময়ে৷ কিন্ত্ত কখনও ‘ভৈরবী সংগীত’ রচনা করতে চাননি৷ তাঁর রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র গান৷
রবীন্দ্রনাথের অনুভবে ‘ভৈরবী যেন সঙ্গবিহীন অসীমের চির বিরহ বেদনা…’ অর্থাৎ ভৈরবী তাঁর কাছে এক বিশেষ অনুভূতি, শুধুমাত্র আলাপ নয়, রাগের কঠোর অনুশাসন নয়, অন্তর্নিহিত যে ভাব ও রস, তাকেই তিনি গানের মধ্যে প্রকাশ করতে চেয়েছেন৷ আর এখানেই তিনি অন্যান্য গীতিকারদের থেকে এতটাই স্বতন্ত্র৷ তাঁর এই অনুভবের নিদর্শন হিসেবে যে গানগুলির কথা বলা যায় সেগুলি হল ‘সকালবেলার আলোয় বাজে/ বিদায়ব্যথার ভৈরবী’, ‘সকরুণ বেনু বাজায়ে কে যায়’ ইত্যাদি৷ আনন্দোজ্জ্বল গানগুলির মধ্যে একটি হলো ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো৷’
আবার ‘পূরবী’ রাগ নিয়ে তাঁর অনুভূতির কথা তিনি জানিয়েছেন এভাবে— ‘পূরবী যেন শূন্যগৃহচারিণী বিধবা সন্ধ্যার অশ্রুমোচন’৷ এই অনুভূতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই দুটি গান— ‘অশ্রু নদীর সুদূর পারে’ এবং ‘সন্ধ্যা হলো গো মা’৷ এই গান দুটিতে পূরবীর সঙ্গে ইমন রাগের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন তিনি৷ এই দুটি গানে ভাবের মুখ্যতা যেরকম আছে, পাশাপাশি সুরের ক্ষেত্রেও তিনি যে যথেষ্টই স্বাধীনতা নিতেন তা সুস্পষ্ট৷ শুধুমাত্র ভৈরবী, পূরবী বা ইমন বা যে কোনো একটি রাগকে কেন্দ্র করেই তিনি যে ভাবকে পরিস্ফুট করেছেন তা কিন্ত্ত নয়, অনেক সময় দুটি রাগের মিশ্রণে বেশ কিছু গানও রচনা করেছেন৷ যেমন, ‘চরণও ধ্বনি শুনি তব নাথ’৷ সিন্ধু ও কাফি রাগে নির্মিত৷
আবার ‘ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর’ এই গানটি ভৈরোঁ ও ভৈরবীর যুগলবন্দিতে গঠিত৷ এরকমই আরও একটি গান ‘দিনশেষের রাঙা মুকুল’৷
এখানে বলা যায়, তিনি পুরাতনকে নতুন করেছেন আবার নতুনকে আরও নতুন করে দেখলেও, পুরাতনকে একেবারে বিদায় দিতে তিনি পারেননি৷ তাই প্রথা যেরকম ভেঙেছেন, আবার প্রথাকে আগলেও রেখেছেন সচেতন ভাবে৷ রাগরাগিণী তাঁর সব থেকে বড় উদাহরণ৷ নানা ভঙ্গিমায় লীলাবৈচিত্রে, নতুন চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে তাঁর সংগীতে৷ রাগরাগিণীর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন ঠিকই, তবে সেখানে নতুন হাওয়া যেমন এনেছেন, আবার ঐতিহ্যের গন্ধ ফুরিয়ে যায়নি৷
যেমন ‘পূরবী’৷ এই পূরবীর সুর শুনলে কবির মনে যে ছবি ভেসে ওঠে সে বিষয়ে ‘সংগীতের মুক্তি’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘পূরবী যেন শূন্যগৃহচারিণী বিধবা সন্ধ্যার অশ্রুমোচন৷’
কিন্ত্ত এ কথা কেন বললেন কবি? পূরবীকে সন্ধ্যার বিষণ্ণতার সঙ্গে মিলিয়ে ট্র্যাজিক পূরবীকে দেখাতে চেয়েছেন? সূর্যদেবের অস্তে যাওয়ায় যে শূন্যতার পরিবেশ তৈরি হয় তার জন্যই কি এমন অনুভুতি তাঁর? ‘ছিন্নপত্রাবলী’-তে সন্ধ্যাকে ‘পূরবী’ রাগের সঙ্গে এমন ভাবে মিলিয়েছিলেন যেন মনে হবে সন্ধ্যা যেন পূরবীর সঙ্গে এক বিকল্প সম্পর্কে বাঁধা৷ কবি বলছেন, ‘‘ইতিপূর্বে আমার মনে হচ্ছিল মানুষের জগতে এই ‘সন্ধ্যা প্রকৃতি’র তুলনা বুঝি কোথাও নেই, যেই পূরবীর তান বেজে উঠলো, অমনি অনুভব করলুম, এও এক আশ্চর্য গভীর এবং অসীম সুন্দর ব্যাপার, এও এক পরম সৃষ্টি— সমস্ত ইন্দ্রজালের সঙ্গে এই রাগিনী এমনই সহজে বিস্তীর্ণ হয়ে গেল কোথাও কিছুই ভঙ্গ হলো না— আমার সমস্ত বক্ষস্থল ভরে উঠলো৷’’
কখনও ‘পূরবী’ তাঁর কাছে বিরহী হয়ে এসেছে, আবার কখনও বা সন্ধ্যার রূপ নিয়ে৷ যদিও ‘বিধবা সন্ধ্যার অশ্রুমোচন’ এই বাক্যাংশটি কোথাও যেন খুব রূঢ় বলে মনে হলেও, পূরবী সবক্ষেত্রে যে অতি দুঃখের ভাব নিয়ে এসেছে তা মোটেই নয়, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পূরবী-গানই শিল্পসুন্দর হয়ে উঠেছে৷
সাধারণত সন্ধ্যাকালীন রাগ হিসেবেই বিবেচিত হয় পূরবী৷ যেমন ইমন, বেহাগ৷ তবে এই অনুমানের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে বলে জানা নেই৷ তবু পূরবী রাগের সঙ্গে সন্ধ্যা (সময়) এবং করুণ ভাব জডি়য়ে গেছে৷ কবিগুরু পূরবীকে বীররসের গানেও প্রয়োগ করেছেন৷ যেমন, ‘শ্রান্ত কেন ওহে পান্থ’৷ কখনও বলেছেন যে, ‘সময়ানুষঙ্গ বা ভাবানুষঙ্গ ব্যাপারটা শ্রবণাভ্যাসমাত্র৷’
‘সঙ্গীত ও ভাব’ প্রবন্ধে এই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন৷ রাগরাগিণীর ব্যাপারে ব্যাকরণের গোঁড়ামিকে উপেক্ষা করে তিনি তাঁর গানে তৈরি করেছিলেন বিমূর্ত ভাবনা৷
‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ এই গানটির বিশুদ্ধ মালকোষ রূপটিও অনেকদিন পরে স্বরলিপি করানো হয়েছে৷ বিশুদ্ধ মালকোষও রবীন্দ্রনাথের ব্যবহারে কোথাও নেই বলা যেতে পারে৷ গানটির প্রামাণ্য স্বরলিপিতে আছে মিশ্র মালকোষ৷
আবার ‘জয় তব বিচিত্র আনন্দ’ এই গানটি বৃন্দাবনী সারঙে রচিত৷ রবীন্দ্রনাথের শাস্ত্রীয় রাগ ও জ্ঞানের যে কোনও কমতি ছিল না, তা বলাই বাহুল্য৷ তিনি যদুভট্ট ও ওস্তাদদের কাছে রাগসংগীত শিক্ষা ও চর্চা করেছিলেন৷ এমনকি রাগ সংগীতের অনেক বন্দিশ ভেঙে প্রচুর গানও তিনি বাংলাগানের ভান্ডারে নিয়ে এসেছেন৷ শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুশাসন না মানলেও, সংগীতরীতিকে আয়ত্ত করেছিলেন৷
তিনিই একমাত্র দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারতেন, ‘পরম্পরাগত সংগীতরীতিকে আয়ত্ত করলে, তবেই নিয়মের ব্যত্যয় সাধনে যথার্থ অধিকার জন্মে৷’ রাগসংগীতের পরম্পরাকে কখনও অগ্রাহ্য করেননি৷ তবে পাশাপাশি এটাও ঠিক, তিনি রাগসংগীত সৃষ্টি করতে চাননি৷ চেয়েছেন গান৷ ছন্দের ক্ষেত্রেই শুধু সংগীতের মুক্তি চাননি, চেয়েছিলেন সুরের ক্ষেত্রেও৷ ইন্দিরা দেবীকে লেখা একটি পত্রে লিখেছিলেন, ‘আমার আধুনিক গানে রাগ তালের উল্লেখ না থাকাতে আক্ষেপ করেছিস৷ সাবধানের বিনাশ নেই৷ ওস্তাদরা জানেন আমার গানে রূপের দোষ আছে তারপরে যদি নামেরও ভুল হয়, তাহলে দাঁড়াবো কোথায়?’
রবীন্দ্রসংগীতে ব্যবহূত হয়েছে ভৈরব ও ভৈরবীর মিশ্র প্রকৃতির রাগ৷ এই রাগ সম্পর্কে ভি ভি ওয়াঝালওয়ার তাঁর রবীন্দ্রসংগীতের রাগ নির্ণয় প্রবন্ধে যে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা হল রবীন্দ্রনাথ যে গানগুলি ভৈরবী রাগে আরম্ভ করেছেন এবং পুনরায় ভৈরব রাগে ফিরে এসেছেন তাই এরূপ৷ গানগুলির রাগকে রবীন্দ্র-ভৈরব বলা হবে৷ রবীন্দ্র-ভৈরব রাগ নিবদ্ধ গানের মধ্যে দুটি হল, ‘আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান’ ও ‘ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশের পাখি৷’
‘যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা’ গানটির প্রথম পঙ্ক্তি বসন্ত মুখারী এবং পরবর্তী অংশ রবীন্দ্র ভৈরব রাগে৷
আবার কিছু গান আছে, যেখানে ইমন ও পূরবীর সংমিশ্রণ আছে৷ ইমনের কাঠামোয় স্থান বিশেষে পূরবীর ছোঁয়া লেগেছে৷ কোথাও ব্যবহার করেছেন শুদ্ধ ধৈবত, কোথাও বা শুদ্ধ ধৈবত যুক্ত পূরবী থেকে পূরবীর আদর্শ গডে় তুলেছেন৷ কোনও কোনও ক্ষেত্রে কোমল ধৈবত এনেছেন৷
পূরবী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে অন্তর্নিহিত ভাব ব্যাখ্যা করেছেন যা পড়লে, মন্ত্রমুগ্ধের মতন পূরবীকে দেখা যায়৷
‘কাল সন্ধ্যাবেলায় দূরের এক অদৃশ্য নৌকা থেকে বেহালা যন্ত্রে প্রথমে পূরবী এবং পরে ইমন কল্যাণে আলাপ শোনা গেল৷ সমস্ত স্থির নদী এবং স্তব্ধ আকাশ মানুষের হূদয়ে একেবারে পরিপূর্ণ হয়ে গেল৷’
পূরবীকে তিনি সর্বদাই ব্যবহার করেছেন দিনান্তের বা জীবন শেষের প্রান্তিক উদাসীনতার প্রকাশ হিসেবে৷ কাব্যসংগীত রচনাই তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল৷ মনেপ্রাণে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন ভাব ও রূপকে৷ রাগের মিশ্রণ ঘটিয়ে রাগের সৌন্দর্যকে যেরকম প্রকাশ করেছেন, একই রকম ভাবে কথা ও সুরের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকেও প্রকাশ করতে পেরেছেন নিবিড়ভাবে৷