অভিজিৎ রায়: ভারতীয় সংস্কৃতির মহীরুহ রবি ঠাকুর এমন কোনও বিষয় বা পর্যায় নিয়ে গান লেখেননি যা মানুষের ভাবনায় আসতে পারে৷ তাই ভাষা ও সময়ের গন্ডি পেরিয়ে রবীন্দ্রসংগীত চিরন্তন৷ শুধুমাত্র বাংলা ছবিতেই নয়, যুগের পর যুগ হিন্দি ছবিতেও ব্যবহূত হয়েছে রবি ঠাকুরের লেখা একাধিক গান৷ এদের অনেকগুলিই জনপ্রিয়তার সীমানা ছুঁয়েছে৷ তবে সব গানই যে হুুবহু রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ধরে ধরে গাওয়া হয়েছে, তা কিন্ত নয়৷ মন দিয়ে শুনলেই বোঝা যায়, হিন্দি গানগুলি যেন সংশ্লিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলিকে লতার মতো জডি়য়ে ধরে ধরে গীত হয়েছে৷ আর সেখানেই সেই সব সুরকারদের মুন্সিয়ানা৷ তাই সেগুলি শেষ অবধি তাঁদের গান হয়ে গিয়েছে৷ রবি ঠাকুরের গান হিন্দি ছবিতে প্রথম আনেন সুরকার ও গায়ক পঙ্কজ মল্লিক৷ ১৯৪২ সালে নির্মিত জলজলা সিনেমাতে৷ খর বায়ু বয় বেগে চারিদিক চায় মেঘে-র সুরে গান ‘পাওয়ান চালে জোর’৷ সঙ্গীত পরিচালক – পঙ্কজ মল্লিক, গায়ক কে এল সায়গাল৷
১৯৪৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দো ভাই’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় ‘রোদন ভরা এ বসন্তে’ গানটির অনুকরণে ‘মেরা সুন্দর স্বপ্না বিত গায়া’ গানটি করেছিলেন শচীন দেববর্মন৷ সুরের সঙ্গে শতভাগ মিল থাকলেও নতুন কথা নিয়ে গানটি করেছিলেন শচীন৷
ঠিক পরের বছর ১৯৫০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘অফসর’ ছবিতে শচীন দেব আবারও আশ্রয় নিলেন রবীন্দ্রনাথের৷ ওই ছবিতে ‘নায়েন দিভানি এক নাহি মানে’ গানটির সুর পুরোপুরি ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ গানের অনুকরণে করেছেন৷
‘প্যার কিয়া তো ডরনা কেয়া’র স্রষ্টা নওশাদ আলীকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বকালের অন্যতম সেরা সংগীত পরিচালক বলা হয়ে থাকে৷ বলিউডের সবচেয়ে হিট বেশকিছু ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি৷ মেলোডি সুরকার হিসেবে তিনি অতুলনীয় এ সুরকার রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন তাঁর অন্যতম আলোচিত গান ‘বাচপান কে দিন ভুলা না দেনা’ গানটিতে৷ ১৯৫১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দিদার’ ছবির এই গানটি পুরোপুরি কবিগুরুর ‘মনে রবে কিনা রবে আমারে’ গানটির অনুকরণ৷
‘১৯৫৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ ছবিতে ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’ গানটি রূপান্তর করেন ‘যায়ে তো যায়ে কাহা’ শিরোনামে৷ তালাত মাহমুদের কণ্ঠে গানটি দেব আনন্দের ঠোঁটে দেখা গেছে৷ সুরকার সেই শচীন কর্তা৷
১৯৫৪ সালের ছবি বিরাজ বহু-তে মেরে মন ভুলা ভুলা কাহে দোলে … গাইলেন হেমন্ত কুমার৷ সেটি রবীন্দ্রনাথের ওই গানের সুরেই গাওয়া৷ গেয়েছিলেন আমাদের হেমন্ত কুমার৷ গানটির কথা প্রেম ধাওয়ানের এবং ছবিটির সুরকার ছিলেন সলিল চৌধুরি৷ বিমল রায় পরিচালিত এ ছবির সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন হূষিকেষ মুখোপাধ্যায়৷
একই বছর সুরকার অনিল বিশ্বাস বিখ্যাত ‘ওয়ারিশ’ ছবিতে ‘রাহি মাতওয়ালি’ গানটি পুরোপুরি করেছেন রবীন্দ্রনাথের ‘ওরে গৃহবাসী খোল্ দ্বার খোল্’ গানের অনুকরণে৷ এ গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন দুজন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী তালাত মাহমুদ ও সুরাইয়া জামাল শেখ৷
অমিতাভ-জয়া জুটির ‘অভিমান’ ছবিটি দেখেননি, এমন সিনিয়র দর্শক খুঁজে পাওয়া কঠিন৷ এ ছবির সব কটি গানই জনপ্রিয় হয়েছিল৷ যেখান অমিতাভ ও জয়া দু’জনই সংগীতশিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন৷ এ ছবিতে জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র্যায়না’ গানটি পুরোপুরিই ‘যদি তারে নাই চিনি গো’ গানের অনুকরণে৷ গানটির সুর নিলেও নতুন কথায় বেঁধেছিলেন শচীন দেববর্মন৷ কণ্ঠ দিয়েছিলেন কিশোর কুমার ও লতা৷ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে৷
১৯৭৭ সালে মুক্তি ‘ টুটে খিলোনে’ মুক্তি পায়৷ এ ছবিতে বাপ্পি লাহড়ি রবীন্দ্রনাথের ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি’ অনুকরণে করেন ‘নানহা সা পাঞ্চি রে তু’ গানটি৷ গানে কণ্ঠ দেন কিশোর কুমার৷
‘তোমার হলো শুরু আমার হলো সারা’ গানটি বহুশ্রুত রবীন্দ্রসংগীত৷ এ গানের সুরের অনুকরণে করা ‘ছুঁ কার মেরে মান কো’ বলিউডে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহারে আরেক মাইলফলক৷ ১৯৮১ সালে রাজেশ রোশনের সংগীতায়োজনে ‘ইয়ারানা’ ছবির এই গানে কণ্ঠ দেন কিশোর কুমার৷ অমিতাভ ঠোঁট মিলিয়েছেন রোমান্টিক এ গানের সঙ্গে৷
১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া নানা পাটেকার ও মনীষা কৈরালা অভিনীত ‘যুগপুরুষ’ দারুণ হিট হয়৷ ওই ছবিতে ‘বন্ধন খুলা পানছি উড়া’ গানের সঙ্গে মনীষার নাচ বেশ লেগেছিল দর্শকের৷ রাজেশ রোশনের ‘বন্ধন খুলা পানছি উড়া’ সুর নেওয়া হয় ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ থেকে৷ মূল কথার সঙ্গে কোনো মিল না থাকলে ভিডিও দেখলে মনে রবীন্দ্রনাথের কথার সঙ্গে মিল আছে দৃশ্যায়নে৷
‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গানের ছায়ায় ‘পিয়ু বলে পিয়া বলে’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পরিণীতা’ নিয়ে প্রদীপ সরকারের চলচ্চিত্র ‘পরিণীতা’তেও আছেন রবিঠাকুর৷ ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গানের ছায়া অবলম্বনে শান্তনু মৈত্র সুর করেন ‘পিয়ু বলে পিয়া বলে’ গানটি৷ সোনু নিগাম ও শ্রেয়া ঘোষাল কণ্ঠ দিয়েছেন এ গানে৷ অভিনয় করেছেন বিদ্যা বালান ও সাইফ আলী খান৷