শোভনলাল চক্রবর্তী
ধর্মের নামে বিষ যে ভাবে ভারতকে আত্মহননের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তার একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র আমরা লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে দেখতে পেলাম।আমরা ভিতরে ভিতরে সাম্প্রদায়িক নিশ্চয়ই ছিলাম, এখন জল-বাতাস পেয়ে ফনফন করে বেড়ে উঠেছি। অর্থাৎ, মাটি প্রস্তুতই ছিল। সেই মাটিতে ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলো ফসল ফলিয়ে মুনাফা তুলছে। এই মাটি কী ভাবে প্রস্তুত হল, তার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তবে আমাদের দেশ পুঁজিবাদী, আর এই পুঁজিবাদ বিশ্বব্যাপী ক্ষয়িষ্ণু। এই ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ বিভেদমূলক মানসিকতার জন্ম দেয়। সাম্প্রদায়িকতা, গোষ্ঠীগত বিদ্বেষ, প্রাদেশিকতা প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মারাত্মক প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।
অপর দিকে, যে সব দেশে সমাজের গণতন্ত্রীকরণ অসম্পূর্ণ রয়েছে, সেই সব দেশে এর তীব্রতা আরও বেশি। আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব গণতন্ত্রীকরণের এই কাজটিকে অবহেলা করেছে, তাই এখানে সাম্প্রদায়িকতার মাটি উর্বর। এই মাটিকে কাজে লাগিয়েই এই ব্যবস্থার সেবক বা সেবা করতে প্রস্তুত এমন সমস্ত রাজনৈতিক দল সাম্প্রদায়িকতাকে হাতিয়ার করে তাদের স্বার্থ সিদ্ধ করতে চায়। এর বিপজ্জনক দিকগুলির কথা মাথায় রেখে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে সমাজের বুকে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী মানসিকতা গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।শাসক দল বিজেপি ভেবেছিল রামমন্দির ভোট বৈতরণি পার করে দেবে। সে কারণে শঙ্করাচার্যদের আপত্তিকে উপেক্ষা করে অসমাপ্ত রামমন্দিরের উদ্বোধন হল। কিন্তু ভোটের পালে তেমন হাওয়া ধরল কই!
সাত ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির ফলাও প্রচারও সাধারণ মানুষকে তেমন আকর্ষণ করলো না। ‘সব কা সাথ/ সব কা বিকাশ’— এমন সব স্লোগানও আমজনতার কাছে এখন তেমন আকর্ষণীয় নয়। মূল্যবৃদ্ধি, বেকার সমস্যার মতো বিষয় স্বাভাবিক কারণেই সামনে চলে এসেছে। তাই ‘মোদী কি গারন্টী’ নিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয়ে রকমারি প্রচারের হুল্লোড় বাজারে জমল না।
মানুষের দৃঢ় ধারণা ‘অচ্ছে দিন’-এর মতো এও এক সময় জুমলার বহরকে বাড়িয়ে তুলবে। এই গ্যারান্টি এ দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির সম্পদ বাড়ানোর গ্যারান্টি, যা দেশের আমজনতাকে শোষণের মধ্য দিয়েই সম্ভব। তাই তো সাম্প্রদায়িক জমির উপর ভরসা করে তাঁদের বলতে হয়, কংগ্রেস ক্ষমতা হাতে পেলে মানুষের সম্পত্তি তুলে দেবে ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ হাতে, তুলে দেবে তাদের হাতে যাদের সন্তান সংখ্যা বেশি। মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্রও নাকি বেহাত হয়ে যাবে। এমন বিদ্বেষ-বিষই বিজেপির ভোট বৈতরণি পার হওয়ার বর্তমান ভরসা।যে দেশ বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে ১১১তম স্থানে নেমে গেছে, যে দেশের ২০ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ প্রতি দিন ক্ষুধা নিয়ে বিছানায় যায়, সেখানে মন্দির নিয়ে, রামনবমী উৎসব উদ্যাপনের উন্মাদনার কারণ বুঝে নিতে হবে। এর বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে হবে সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয়, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে।
ধর্মীয়, জাতিগত ভেদাভেদ ছাড়াও সমাজে “ধনী, দরিদ্র, শাসক, বিরোধী, নিরামিষাশী, আমিষভোজী” ইত্যাকার অমানবিক ভাগাভাগির কথা আমরা আলোচনা করি। এই প্রসঙ্গে নারী-পুরুষ বিভাজনের কথাও উল্লেখ করা দরকার। বাপ-ভাই নয়, শুধুমাত্র মা-বোনেদের ইজ্জত রক্ষার কথা ভেবে মন্ত্রী, নেতা, নাগরিক সমাজ প্রায়শই যে সরব হয়ে ওঠে, এর কারণ কী? কারণ, ধরেই নেওয়া হয় যে পুরুষদেহ নয়, নারীদেহের শুচিতাই রক্ষণীয়। তাই ‘পরপুরুষ’ কোনও মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে, এই অজুহাতে রাজ্য তথা দেশ জুড়ে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দেওয়া যায়। নারীদেহ ঘিরে এই যে সংস্কার, তা নারীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। প্রশ্ন হল, শরীর ঘিরে নারী-পুরুষের মধ্যেকার এই বৈষম্যের কারণ পুরুষতন্ত্র। এ হল এক আরোপিত শুদ্ধাচার, যা নারীকে সমাজের চোখে দেবীতুল্য করে তুলতে চায়। অপর দিকে নারীকে ভোগ্যবস্তু করে রাখার যে কৌশল, তাতেও নারীকেই অবর্ণনীয় লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। জীবনানন্দ দাশের ‘সুখের শরীর’ গল্পে মেজোখুড়িমাকে বলতে শুনি:“…নিজেকে একটা রাতের জন্য শুধু কনে মনে করেছিলাম, তারপর থেকেই দাসী হয়ে আছি।” এক দিকে দেবী, অপর দিকে ভোগ্যা— নারীকে ঘিরে এই বৈপরীত্যই সমাজে বহাল। নারীর অধিকার নিয়ে বাগাড়ম্বর যাই থাক, নারী দুর্বল, পুরুষ সবল— এই অজুহাতে দেশটাকে কমবেশি পুরুষদের দেশ বানিয়ে রাখার এও এক মতলবই বটে।
“হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো”, এই কথা গলা ফুলিয়ে বলার অধিকার আমরা আজ হারিয়েছি। উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভাবনা এ রাজ্যে ক্রমশ স্থান করে নিতে পারছে। বাঙালিরাও সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টভঙ্গি অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে। আফসোস এইখানেই।কিন্তু এই পরিস্থিতি কি আকস্মিক? বঙ্গভঙ্গের চেষ্টা করে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বীজ পুঁতে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরাই। জন্ম দিয়ে গিয়েছিল মুসলিম লীগের (১৯০৬)। তারই প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হল হিন্দু মহাসভা (১৯১৫)। শুধু কি তাই? জাতীয়তাবাদী নেতাদের মননের গভীরে সুপ্ত ছিল হিন্দু চেতনা। এমনকি ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’— এমন ভাবনার অধিকারী বিপ্লবীরাও এর থেকে মুক্ত হতে পারেননি।এ ইতিহাস ভুল গেলে চলবে না। এই ধারায় ব্যতিক্রমী ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজির প্রতিষ্ঠিত আজ়াদ হিন্দ সরকারের জাতীয়তাবাদী প্রেরণার মূলে ছিল না কোনও ধর্ম। কারণ, তিনি গভীর ভাবে বিশ্বাস করতেন, ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠন হয় না। ধর্মাচরণ হোক ব্যক্তিগত জীবনচর্যায়, রাষ্ট্রীয় জীবনে তার কোনও ছায়া যেন না পড়ে, এই ছিল সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গি। ভারতে কি এমন ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা হয়েছে? সমস্ত ধর্মকে সমান উৎসাহ দানের কথা বলা হয়ে থাকে। যদিও বাস্তবে তা যে হয় না, তা কেন্দ্রে অতীতের কংগ্রেস সরকার এবং ক্ষমতাসীন বর্তমান বিজেপি সরকারকে দেখে যথার্থ বোঝা যায়। তবে এর জন্য হতাশার কারণ নেই। এখনও বাঙালি মনন থেকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শরৎ, সুভাষ, নজরুলের মতো মহাপুরুষেরা একেবারে মুছে যাননি।
বড় বড় শিল্পপতিদের স্বার্থ রক্ষাই সাধারণত শাসকদের কাজ। অতিমারি পর্বে পরিযায়ী শ্রমিকেরা রাস্তায় রাস্তায় বেঘোরে মারা গিয়েছেন। চাষিরা ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সমস্ত দ্রব্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু শিল্পপতিদের সম্পদ বৃদ্ধি অব্যাহত। আর দুর্নীতির শিখরে বসে এঁদের পৃষ্ঠপোষকরাই দেশের মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে। এই বিভ্রমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে জাতিধর্ম নির্বিশেষে আমাদের সবাইকে। কারণ আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর যারা এই কদর্য খেলার স্রষ্টা, তারা সংখ্যালঘু। এই উপলব্ধির দিন আজ উপস্থিত।