স্বামী বিবেকানন্দের বাস্তববাদী উদারতায় সকলেই তাঁকে আপন ভাবে, বিতর্কও হয় !

স্বপনকুমার মণ্ডল

ফুটবলের জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। রাজার খেলা ক্রিকেট হলেও খেলার রাজা ফুটবল । সারা পৃথিবী জুড়ে তার বিস্তার, মননবিশ্বেও তার নিবিড় হাতছানি । ফুটবলের গোল জনজীবনের লক্ষ্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠে। সেখানে বাঙালির সেরা খেলা ফুটবলের জুড়ি মেলা ভার । জাতীয় খেলা না হলেও জাতের খেলায় তার বিপুল জনপ্রিয়তা এখনও সচল, সজীব । সেই খেলার শ্রীবৃদ্ধিতে না হোক, তার মানবৃদ্ধিতে স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা প্রবাদপ্রতিম । ছাত্রজীবন থেকেই ফুটবল খেলার আভিজাত্য ও উপকারিতা বোঝানোর জন্য স্বামীজির বাণী যেন মূর্ত হয়ে ওঠে, মূর্তি থেকে প্রতিমা গড়ে তোলে। গীতা’র মতো পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠের চেয়েও ফুটবল খেলা বেশি উপকারীর কথায় খেলো ভাবটা নিমেষেই কেটে যায়, তার গুরুত্বে বিস্ময় জেগে ওঠে । আমারও হয়েছিল । শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন তা সক্রিয় ছিল মনে । স্বামী বিবেকানন্দের মতো একজন বিশ্বজয়ী ধর্মপ্রাণ সন্ন্যাসীর বাণীতেই ফুটবলের মাহাত্ম্যকীর্তন স্বাভাবিক ভাবেই অবিশ্বাস জাগে না, বরং না-জানার অজ্ঞতায় বিস্ময় সৃষ্টি করে । মালদার গাজোল ব্লকের বাদনাগরা হাই স্কুলের দিগন্তবিস্তারী খেলার মাঠে কথাটি শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম যেমন,তেমনই কেন স্বামীজি সেকথা বলেছেন,তা নিয়ে কৌতূহলী কম হইনি। ভেবেছি অনেকবার । স্বামীজির যেসব কথা স্বকীয় বিশেষত্বে বাণী হয়ে উঠেছে ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে তার মধ্যে ফুটবল খেলার গুরুত্ব নিয়ে বিশেষ ভাবে সচল ও ব্যতিক্রমী । আবার এই ব্যতিক্রমীতার মধ্যেই বিতর্কের বীজ ছিল যা সময়ের আনুকূল্যে মহীরূহ হয়ে উঠেছে । ধর্মীয় রাজনীতির আধারে গীতা পাঠের উপযোগিতার বিরোধিতায় স্বামীজির ফুটবল খেলার উপকারিতার শ্রেয়বোধে স্বাভাবিক ভাবেই বিতর্ককে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। হীরে দিয়ে হীরে কাটার মতো স্বামীজির বাণীই সেখানে  হাতিয়ার হয়ে উঠেছে । স্বাভাবিক ভাবেই তাতে বাণীটির বিপুল জনপ্রিয়তাই  বিতর্কের আসরকে সরগরম করে তোলে । শুধু তাই নয়, বিতর্কের লক্ষ্য স্থির থাকেনি, উপলক্ষ্যও লক্ষ্য হয়ে উঠেছে । বিতর্কের জেরে ফুটবল খেলা অন্যদিকে মোড় নেয় । স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়েও সেই আসরে পক্ষপাতিত্ব সরব হয়ে ওঠে । অথচ গীতা পাঠের সঙ্গে ফুটবল খেলায় বিতর্ক নয়, সতর্কতা জরুরি । এজন্য প্রথমেই স্বামীজির বক্তব্যকে স্পষ্ট করা আবশ্যক ।

ব্যতিক্রমী কথার প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকেলে । আর তা যদি অস্বাভাবিক বৈপরীত্যে ব্যতিক্রমী হয়,তাহলে তো কথাই নাই, চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করে, দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে তার বার্তা । ঔষধি গাছন্তের মতো তার আকর্ষণ হাতছানি দেয়, মূল ছিঁড়ে করায়ত্ত করার প্রতি তার ঝোঁক চেপে বসে। তাতে গাছের প্রাণ না বাঁচলেও তা দিয়ে মান বাড়ানোর সদিচ্ছা জেগে ওঠে। স্বামী বিবেকানন্দর যেসব নতুন কথা জনমানসকে সেভাবে উদ্দীপ্ত করে তার মধ্যে গীতাপাঠের চেয়ে ফুটবল খেলা বেশি ভালো নানাভাবে ব্যতিক্রমী । খেলাধুলার ক্ষেত্রে তো বটেই, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধেও তা সমান সচল । সেক্ষেত্রে তা নিয়ে ধর্মনিরপক্ষে রাজনীতি থেকে রাজনৈতিক বিরোধিতা সবেতেই স্বাভাবিকতা লাভ করে । অথচ বিষয়টি নিয়ে যে বিভ্রান্তির অবকাশ রয়েছে, তা তার মধ্যেই অদৃশ্য থেকে যায় । মাছের পেটির প্রতি লোলুপ দৃষ্টি  আকৃষ্ট হলে স্বাভাবিক ভাবেই তার লেজামুড়োর প্রতি অন্তর্দৃষ্টি আড়ালে চলে যায়। স্বামীজির বাণীটির ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে । জনমানসে প্রচারিত কথাটি মিথ্যে নয়। স্বামীজি তাঁর মাদ্রাজে প্রদত্ত তৃতীয় বক্তৃতায় (‘ভারতীয় জীবনে বেদান্তের কার্যকারিতা’ শিরোনামে প্রকাশিত, ‘স্বামীজীর বাণী ও রচনা’, তৃতীয় খণ্ড, ২২তম পুনর্মুদ্রণ শ্রাবণ ১৪১৭, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১০৩  ) স্পষ্টই বলেছেন, ‘গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে।’ তাতে আপাতভাবে মনে হবে স্বামীজি ফুটবল খেলার পক্ষে বা গীতাপাঠের বিপক্ষে ছিলেন । অথচ তা একেবারেই নয়। দেশ থেকে গরিবি হঠাও বললে যেমন গরিবকে দেশছাড়া করা বোঝায় না, দারিদ্রদূরীকরণের লক্ষ্যের কথা বলে, তেমনই স্বামীজি গীতাকে আত্মস্থ করার জন্যই ফুটবলের প্রসঙ্গ এনেছেন ।  কথাটির অব্যবহিত পূর্বেই স্বামীজি তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে বলেছেন : ‘দুর্বল মস্তিষ্ক কিছু করিতে পারে না ; আমাদিগকে সবলমস্তিষ্ক হইতে হইবে—আমাদের যুবকগণকে প্রথমতঃ সবল হইতে হইবে, ধর্ম পরে আসিবে। হে আমার যুবক বন্ধুগণ, তোমরা সবল হও—তোমাদের নিকট ইহাই বক্তব্য ।’ তার অব্যবহিত পরেই গীতাপাঠের চেয়ে ফুটবল খেলা বেশি ভালো বিতর্কিত কথাটি জনপ্রিয়তা লাভ করে । অথচ তা যে তাঁর অভীষ্ট ছিল না, তাও স্বামীজি তার অব্যবহিত পরের বক্তব্যের অংশ সুস্পষ্ট করেছেন। এছাড়া কথাটি যে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে, সে বিষয়েও তাঁর আত্মসচেতনতা সেখানে বেরিয়ে এসেছে ।  এজন্য কৈফিয়তের জবাব দেওয়ার মতো করেই শুধু বলা হয়নি , তাতে তাঁর অভিপ্রেত লক্ষ্যও বেরিয়ে আসে । স্বামীজির কথায় : ‘আমাকে অতি সাহসপূর্বক এই কথাগুলি বলিতে হইতেছে; কিন্তু না বলিলেই নয়। আমি তোমাদিগকে ভালবাসি। আমি জানি, সমস্যা কি—কাঁটা কোথায় বিঁধিতেছে। আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে। তোমাদের বলি, তোমাদের শরীর একটু শক্ত হইলে তোমরা গীতা আরও ভাল বুঝিবে।’ গীতাপাঠের চেয়ে ফুটবল খেলার গুরুত্বে যে ভুল বোঝাবুঝির প্রবল সম্ভাবনা বর্তমান, স্বামীজির ‘সাহসপূর্বক এই কথাগুলি’ বলার মধ্যেই প্রতীয়মান । শুধু তাই নয়, তাঁর লক্ষ্য যে ফুটবল খেলার শ্রীবৃদ্ধিতে নেই, গীতাকে আত্মস্থ করায় সক্রিয় ছিল, তাও স্পষ্ট । অথচ দৃষ্টির আচ্ছন্নতায় অন্তর্দৃষ্টির অভাববোধে তা নিয়ে অসুস্থ বিতর্কের আমদানিতে রাজনৈতিক পরিসরে স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়েও টানাটানি, বিভ্রান্তিকর  পক্ষপাতিত্ব তিক্ত অভিজ্ঞতা জন্ম দিয়ে চলে!


আসলে মানুষ তার সুবিধা মতো কোনো কথাকে গ্রহণ করে, বরণ করে নেয়, স্মরণীয়  মনে করে। সুযোগ বুঝে তার ব্যবহারও করে। জনপ্রিয় কথাতেও তার প্রকট পরিচয় মেলে । আমজনতার মধ্যে ইচ্ছে মতো সম্পাদনা হতে হতে তার অস্তিত্ব বটগাছের ঝটের মতো আসল শেকড়টিই তার চেনা দায় হয়ে ওঠে । সেক্ষেত্রে উদাহরণের সহজতায় ব্যাখ্যা অন্তর্হিত হয়, আবার ব্যাখ্যার বিস্তৃতির চেয়ে উদাহরণই মনে ধরে। অথচ  তাতে যে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে,তা ভেবে দেখার সদিচ্ছা জাগে না। উল্টে সেই সেই জনপ্রিয় কথাটি গ্রহণযোগ্যতায় প্রবাদপ্রতিম বিশ্বস্ততা লাভ করে। স্বামীজির বাণীটির তাই ঘটেছে। উদাহরণটিই বাণীতে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ফুটবল খেলার মাধ্যমে স্বর্গের কাছাকাছি যাওয়ার মধ্যেই যে তাঁর বক্তব্যের ফাঁক রয়েছে, তাও আমরা খেয়াল করি না। খেলায় জিতে স্বর্গীয় আনন্দ কেউ পেতেই পারেন, কিন্তু তার অস্তিত্ব বাস্তবে স্বীকার করা মানেই হারলে মনে নরক জেগে ওঠে । সেদিক থেকে স্বর্ণ-নরকের ধারণা আধ্যাত্মিক চেতনাপ্রসূত যা গীতাপাঠের সঙ্গে নিবিড় ভাবে বিজড়িত । অথচ বাণীটির মাধ্যমে গীতাপাঠকেই উপেক্ষা করে ফুটবল খেলাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে । অন্যদিকে সাধারণের কাছে যেখানে খেলা বিনোদনে খেলো হয়ে ওঠে, সেখানে স্বামী বিবেকানন্দের কথায় মহার্ঘ আভিজাত্য লাভ করায় স্বাভাবিক ভাবেই ধর্মীয় পরিসরের বাইরে তার গ্রহণযোগ্যতা জনপ্রিয়তায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাতে সেই বাণীতে যে খেলাধুলার উন্নতি বা তার চেতনা বিস্তার হয়নি, তার মাঠের অভাবে তা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে । উল্টে তা যে সময়ান্তরে গীতাপাঠের বিরোধিতায় ব্রহ্মাস্ত্র হয়ে উঠতে পারে, বর্তমান অস্থির রাজনৈতিক পরিসরে তাও প্রতীয়মান । অথচ স্বামীজির বাণীর লক্ষ্যে ফুটবল নয়, ছিল গীতাই। আসলে পরাধীন ভারতের মুক্তিকামী যুবকদের পথপ্রদর্শক হিসেবে স্বামীজির ভূমিকা কত বাস্তবসম্মত ও আদর্শনিষ্ঠ ছিল,তা তাঁর বক্তব্যেই স্পষ্ট । তিনি শারীরিক ভাবে দুর্বল হলে মানসিক ভাবে সবল না হওয়ার কথা নানাভাবে বলার চেষ্টা করেছেন । এজন্য শরীর গঠনের দিকে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি প্রসারিত হয় এবং সেকথা নানাভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক করে তোলেন । অথচ তাঁর কথাটি নতুন বা অভিনব নয়। মুণ্ডক উপনিষদের বহুচর্চিত ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য’ তথা বলহীনে আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে বিবেকানন্দ নতুন কথা না বললেও নতুন ভাবে বলেছেন । সহজ উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টিকে তুলে ধরতে গিয়ে স্বামীজি ফুটবল খেলার সোপানে গীতাপাঠ পৌঁছাতে চেয়েছেন। অথচ তাতে গীতাপাঠকেই খেলো করে ফুটবল খেলার আভিজাত্য লাভ  করার অস্থির বিতর্ক আজ রাজনৈতিক পরিসরে বিভ্রান্তির অবকাশ তৈরি হয়েছে, ভাবা যায়! আংশিক সত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, সত্যকেই শুষে নিয়ে বিপথে চালিত করে জনমতকেই বিভ্রান্ত করে দেয় । অবশ্য সত্যের তাতে পরাজয় ঘটে না। সূর্যের মতোই তার প্রকাশ আকাশ হয়ে ওঠে । সময়ান্তরে মেঘ কেটে যায়, সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ে। সেই মুণ্ডক উপনিষদেই বলা হয়েছে ‘সত্যমেব জয়তে’। সেই সত্য যে চির ভাস্বর, অনির্বাণ তার দীপশিখা । সেই সত্যের প্রকাশে কলকাতার প্রতিবাদ দিঘায় সমর্থন লাভ করে, ভাবা যায়! আসলে স্বামী বিবেকানন্দের বাস্তববাদী উদারতায় সকলেই তাঁকে আপন ভাবে, আবার এজন্য বিতর্কও হয় । আর তাঁকে ভালো করে জানার মধ্যেই রয়েছে তার বিশল্যকরণী ।