চুনো বিলে কালীকে দেওয়া হয় চুনোপুঁটি মাছের ভোগ

পূর্বস্থলীতে চুনোবিলে কালী। নিজস্ব চিত্র

গ্রামীণ খাল ও বিলের জলে আপনা থেকে বেড়ে ওঠা চুনোমাছকে বাঁচাতে পূর্বস্থলী-১ ব্লকের কোবলা-গঙ্গানন্দপুর এলাকায় ফি বছরই হয় কালীর আরাধনা। পরিবেশ আর জলাভূমি রক্ষার ডাক দিয়ে এ ধরনের অভিনব কালীপুজো রাজ্যের আর কোথাও হয়না। এই কালীপুজোর সূচনা করেছিলেন এলাকার ভূমিপুত্র স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। এবার ২৪ তম বর্ষে পড়লো ‘চুনো-বিলে কালী’ নামে যথেষ্ট পরিচিত ওই পুজো। স্থায়ী মন্দিরে নিত্যপুজোর পাশাপাশি কালীপুজোর দিন জাঁকজমক করে বিশেষ পুজো হয়। আশেপাশের আট-দশটি গ্রামের মানুষ মই কাঁধে বাজনা বাজিয়ে মায়ের পুজো দিতে আসেন। এলাকার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা থাকে দেখার মতো। পুজোয় মন্দির সাজানো হয় জাল, পোলো, বিত্তি সহ মাছ ধরার নানান সামগ্রী দিয়ে।

পূর্বস্থলী-১ ব্লকের বিদ্যানগর এলাকার বাসিন্দা স্বপন দেবনাথ ২০০০ সালে উপলব্ধি করেন, গ্রামীণ বলয়ে খালবিল থেকে মাছ ধরে এক শ্রেণির মৎস্যজীবী জীবিকা অর্জন করেন। কিন্তু দিনকে দিন গ্রামীণ জলাশয় বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে। জোগান কমছে খালবিলের জলে আপনা থেকে বেড়ে ওঠা খলসে, মৌরলা, তপসে, খয়রা, ভেদা, পুঁটি,  চাঁদা  চুনো মাছের সঙ্গে কাঁকড়ার। তাই খালবিল, জলা ও  চুনো মাছকে বাঁচাতে বড় কোবলা ও গঙ্গানন্দপুর সংলগ্ন রাস্তার পাশে শুরু করেন কালী আরাধনা। মা কালীর কাছে তাঁর আর্তি ছিল খালবিল ও চুনোমাছ যাতে বাঁচে।

এতে একদিকে যেমন জলাশয় বাঁচিয়ে চাষের কাজে সেচের ব্যাবস্থা হবে, একই সঙ্গে মাছ ধরে মৎস্যজীবীরা সংসার চালাতে পারবেন। তাই সকলে কালীমায়ের নাম দেন চুনো-বিলে কালী। শুধু পুজো নয়, মানুষকে  খালবিল চুনো মাছ রক্ষার বার্তা দিতে খালবিল উৎসব শুরু করেন মন্ত্রী। স্বপনবাবুর ভক্তি নিষ্ঠায় মা তাঁকে নিরাশ করেননি। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজরে আসে স্বপন দেবনাথের এই উদ্যোগ। খালবিল উৎসবের জন্য লিখে দেন কয়েক লাইন কবিতা।  মায়ের মন্দির তৈরিতে হাত লাগান। বড় কোবলা ও গঙ্গানন্দপুরের প্রাচীন এসটিকেকে রোডের যা শের শাহের আমলে তৈরি তারই ধারে গড়ে তোলেন  মায়ের মন্দির। মাটির প্রতিমার বদলে জায়গা পায় পাথরের প্রতিমা। এবারও মায়ের মন্দিরে শুরু হয়েছে জোর প্রস্তুতি। সেজে উঠছে মায়ের মন্দির।


মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, খালবিল হলো চুনো মাছের আঁতুড়। তাই খালবিল,জলাশয় বাঁচিয়ে পরিবেশ রক্ষার ডাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন মূলত মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে এখানকার খালবিল সংস্কার করে কৃষিসেচ, মাছচাষ, সবের উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে চাঁদের বিল সংস্কার করে পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা আনা হয়। প্রাচীন সেতুর সংস্কারের কাজও শুরু হয়েছে। আর ওই বিলের বিলুপ্ত প্রায় পুঁটি,ট্যাংড়া, ল্যাটা, কুচো চিংড়ি, খলসে, মৌরলা, কই ,সোল, ডাঁরকে সহ একাধিক চুনো মাছ ধরে জীবন জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছেন মৎস্যজীবীরা। মূলত তাদের উৎসাহে এই কালী মা এর আরাধনা। মৎস্যজীবীরাই এখানে ১২ রকমের  চুনো মাছের ঝাল থেকে মাছভাজা ও কাঁকড়ার ঝোল সহ নানা রকম পদ রান্না করে কালীর কাছে ভোগ দেন।

মৎস্যজীবীদের এই পুজোর পাশেই লোকগান, লোকনৃত্যের অনুষ্ঠানের আয়োজন যেমন থাকে, তেমনি হয় যাত্রাপালা। এবার যাত্রাপালায় অভিনয় করবেন মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। কলনা মহকুমার বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রান্তিক মানুষের সমাগম ঘটে এই পুজোয়। থাকেনা জাতপাতের বেড়াজাল। এবছরই মন্দির রং করা ও পুজোর উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করেন রহমৎ ও নজরুল নামে স্থানীয় দুই বাসিন্দা। মন্ত্রীর সঙ্গে সারারাত জেগে হিন্দু মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের মানুষজন কালীপুজোয় অংশ নেন বলে জানা গেছে।

মন্ত্রী বলেন, খালবিল জলাশয় গ্রাম বাংলার অন্যতম সম্পদ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের  সহযোগিতায় আজ পূর্বস্থলী-১ ব্লকের বিস্তীর্ণ চাঁদের বিল ও বাঁশদহ বিল সংস্কার করা হয়েছে। একদিকে যেমন মাছের উৎপাদন বেড়েছে তেমনি জলাশয়ের জল ব্যবহার করে কৃষিকাজের প্রয়োজন মেটাতে পারছেন  চাষিরা। সেজন্যই  চুনো-বিলে কালী আজ এলাকার মানুষের ভক্তির কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। মানুষ এই পুজোয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে  অংশগ্রহণ করেন।