• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

পয়লা বৈশাখ কেমন করে পুরাণ থেকে আজকের দিনে

সুপ্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় পুরাণ গ্রন্থ মনুসংহিতায় পাওয়া গেছে চোখের আঠার পলকে এক কাঠা হয়, ত্রিশ কাঠায় এক কলা, ত্রিশ কলায় এক মুহূর্ত, ত্রিশ মুহূর্তে এক দিন-রাত৷ দিন মানুষের কাজ ও রাত নিদ্রার জন্য৷ শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ মিলে এক মাস, বারো মাসে এক বছর৷ মানুষের এক বছর দেবগণের এক রাত্রি ও এক দিন৷ ওই দৈব এক রাত্রিকে

সুপ্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

পুরাণ গ্রন্থ মনুসংহিতায় পাওয়া গেছে চোখের আঠার পলকে এক কাঠা হয়, ত্রিশ কাঠায় এক কলা, ত্রিশ কলায় এক মুহূর্ত, ত্রিশ মুহূর্তে এক দিন-রাত৷ দিন মানুষের কাজ ও রাত নিদ্রার জন্য৷ শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ মিলে এক মাস, বারো মাসে এক বছর৷ মানুষের এক বছর দেবগণের এক রাত্রি ও এক দিন৷ ওই দৈব এক রাত্রিকে ‘দক্ষিণায়ন’ এবং দিনকে বলা হয় ‘উত্তরায়ণ’৷ উত্তরায়ণে ছয় মাসে তিনটি ঋতু— শীত, বসন্ত ও গ্রীষ্ম৷ দক্ষিণায়ণে ছয় মাসে তিনটি ঋতু— বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত৷ বারো মাসে এক বর্ষ৷ এক সৌর বর্ষে দেবতাদের দিন-রাত এবং দৈত্যদের দিন-রাত পরস্পর বিপরীত হয় অর্থাৎ দেবতাদের যখন রাত্রি (দক্ষিণায়ন), অসুরদের তখন দিন৷ ৩৬০ সৌরবর্ষে হয় এক দিব্যবর্ষ৷ দেবতাদের এক বছর আমাদের ৩৬০ সৌরবর্ষ৷ বারো হাজার দিব্যবর্ষে চর্তযুগ৷ মাস কথার অর্থ চন্দ্র বা চাঁদ৷ যে তিথিতে মাস বা চন্দ্র পূর্ণ হত তাকে বলা হত পৌর্ণমাসী বা পূর্ণিমা৷ যে নক্ষত্রের কাছে এসে চাঁদ পূর্ণতা পায় সেই নক্ষত্রের নামে মাসের নামকরণ হয়, যেমন বিশাখা নক্ষত্রে চাঁদ পূর্ণতা পায় বলে সেই মাসের নাম বৈশাখ৷

চন্দ্রমাস দিয়ে মাসের নাম হলেও জ্যোতির্বিদ্যায় গুরুত্ব কিন্ত্ত সূর্যের৷ সূর্যকে ব্যবহার করা হয়েছে দৈর্ঘ্য মাপার কাজে৷ বরাহমিহির ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ গ্রন্থে এই মাপের হিসাবটি করেছিলেন এবং এই গ্রন্থে নতুন নতুন সংস্করণ ও ব্যবহার পাওয়া যায়৷ ভাস্করাচার্য, আর্যভট্ট, বরাহমিহিরের মতো জ্যোতির্বিদরা সচেষ্ট হয়েছিলেন বর্ষপঞ্জিকে নিযুক্ত করার প্রচেষ্টায়৷ আমাদের ভারতবর্ষে আর্যরাই বোধহয় প্রথম বর্ষ পঞ্জিকার নির্মাণ ও ব্যবহার শুরু করেন৷

ভারতের মতো একইভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় বর্ষপঞ্জিকা নিয়ে নানা তথ্য ও মতামত পাওয়া যায়৷ বিখ্যাক গ্রিক কবি হোমার বর্ষপঞ্জিকার ব্যবহার সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন৷ রোমানরা আবার বিশ্বাস করতেন যে, রোমের প্রতিষ্ঠাতা রোমুলাস ৭৫৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সর্বপ্রথম বর্ষপঞ্জিকা আবিষ্কার করেন৷ আলেকজান্দ্রিয়ার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী সসিজেনেস (Sosigenes)-এর পরামর্শে রোমান সর্বাধিনায়ক জুলিয়স সিজার তার দেশের প্রচলিত বর্ষপঞ্জিকার সংস্কার ও সংশোধন করেন৷

ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষেরা ৬২২ খ্রিস্টাব্দ প্রবর্তিত ‘হিজিরা’ বর্ষপঞ্জিকা মেনে চলতেন৷ ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হজরত মহম্মদ ও আবু বক্কর মক্কা থেকে মদিনা যাত্রা করেন, আর সেই ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই বর্ষপঞ্জিকার নির্মাণ, এটি চন্দ্রমাস অনুসারে৷ ১২ মাসে বিভক্ত হলেও বছরে মোট দিনের সংখ্যা ৩৫৪৷ বর্তমানে সৌদি আরব একমাত্র ইসলামিক দেশ যাদের জাতীয় বর্ষপঞ্জিকা এই ‘হিজিরা’৷

যতদূর জানা যায়, ছাপা পঞ্জিকার আগে আমাদের দেশে পুঁথি পঞ্জিকা ছিল৷ ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে প্রথম কালেন্ডার প্রকাশ পায়৷ ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের পুরাণ পাঁজি বা পঞ্জিকা আমাদের দেশে পাওয়া গেছে৷ দেখতে গেলে এটাই আমাদের দেশের সবচেয়ে পুরনো পঞ্জিকা৷ ১২২৭ সালে বাংলায় প্রথম পাঁজি ছাপা হয়৷ এবার দেখে নেওয়া যাক, আমাদের দেশে ১লা বৈশাখ কীভাবে এল বা কবে থেকে ১লা বৈশাখ পালিত হতে লাগল৷

১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর সিংহাসনে বসেন, সেই সময় বর্ষপঞ্জির হিসাব হত চন্দ্রমাস অনুযায়ী, যাকে হিজরি সন বলা হত৷ ২৭ দিনে চন্দ্রমাস, ফলে হিজরি সন প্রতি বছর কয়েকদিন করে এগিয়ে যেত, প্রতি মাসের অবস্থানের সঙ্গে এই সময় কৃষির অনেক কিছুই জড়িত থাকত৷ বিশেষ করে হিজরি মাস কেন্দ্রীক বর্ষ কৃষির সম্পর্কের একটি বড় দূরত্ব তৈরি করত৷ তখন প্রজারা প্রধানত চাষের ফসল বিক্রি করে রাজাকে খাজনা বা কর দিত৷ ফলে চাষিদের বা প্রজাদের খাজনা আদায়ে অনেক অসুবিধা সৃষ্টি হতে লাগল৷ সম্রাট আকবর প্রজাদের বা চাষিদের এই অসুবিধার কথা অনুভব করে স্বনামধ্যন পণ্ডিত ও জ্যোতির্বিদ ফতেউল্লাকে নির্দেশ দিলেন চন্দ্রকেন্দ্রিক হিজরি বর্ষ ও সূর্যকেন্দ্রিক বর্ষপঞ্জির সংমিশ্রণে একটি বর্ষপঞ্জি তৈরি করার৷ জ্যোতির্বিদ ফতেউল্লা সম্ভবত ১০ বা ১১ মার্চ ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে একটি কৃষিভিত্তিক বর্ষপঞ্জি তৈরি করলেন যার নাম ‘ফসলি সন’ (Fasli Son), যেটি বর্তমানের বঙ্গাব্দের হিসাব৷ ১৫৮৪ সালে ফতেউল্লা সাহেব এই বঙ্গাব্দ তৈরি করলেও যেহেতু সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে মসনদে বসেন সেইহেতু ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের সৃষ্ট ‘ফসলি সনের’ হিসাব রাজকার্যের সুবিধার্থে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ হতেই গণনা শুরু করা হয়েছিল৷ বঙ্গাব্দের প্রথম মাসের প্রথম দিনটিই হল ১লা বৈশাখ৷ মনে করা হয় সম্রাট আকবরের আমল হতেই ১লা বৈশাখ বা নববর্ষ পালন করা হয়৷

পশ্চিমবঙ্গে বর্ষবরণ উৎসবের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হয় কলকাতার রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গনে৷ এছাড়াও নানা স্থানে নানাভাবে ১লা বৈশাখ পালিত হয়৷ বাংলাদেশে ১লা বৈশাখে জাতীয় ছুটি থাকে৷ ওইদিনে যাত্রা, কবিগান, পালাগান, আলকাপ, গম্ভীরা গান, গাজিরা গান ও নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়৷ বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হয় ঢাকার রমনা পার্কে৷ রবীন্দ্রনাথের গান ‘এসো হে বৈশাখ’ দিয়ে শুরু হয় বর্ষবরণ উৎসব৷ এইভাবে বাংলাদেশে, পশ্চিমবঙ্গে, অসমে, ত্রিপুরায় ১লা বৈশাখের বর্ষবরণ উৎসব হয়ে ওঠে সুন্দর ও মধুময়৷