• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

অতিকায় সহস্রভূজার মাহাত্ম্য আজও অটুট

হাওড়া শিবপুরের ওলাবিবিতলার হাজার হাত কালী মন্দির তীর্থস্থান হিসেবে একটি উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নিয়েছে, লিখছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়।

সমস্ত বাংলা জুড়ে জাগ্রত দেবদেবীর মন্দিরের সংখ্যা অগণিত। চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে তাদের মাহাত্ম্য। কালীঘাটের মন্দির থেকে শুরু করে তারাপীঠের মন্দির ও বিভিন্ন তীর্থস্থান রয়েছে আমাদের এই রাজ্যে। এদের মধ্যে হাওড়া শিবপুরের ওলাবিবিতলার হাজার হাত কালী মন্দির তীর্থস্থান হিসেবে একটি উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নিয়েছে। পুরান অনুসারে অসুর দলনের সময় মা দুর্গা, নানান সময় নানাবিধ রূপ ধারণ করেছিলেন। মার্কেন্ডিয় চণ্ডীর ৩৯ নম্বর শ্লোকে কথিত আছে মা দুর্গা ধারণ করেছিলেন অতিকায় সহস্রভূজা বীভৎস রূপ যে রূপ দেখে স্বয়ং মহিষাসুর স্তম্ভিত হয়েছিলেন এবং পরে তার হাতে বধও হয়েছিলেন। মায়ের এই রূপটি হাজার হাত কালী নামে পরিচিত। প্রায় ১০০ বছর ধরে মায়ের এই রূপের পূজো হয়ে আসছে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া শিবপুরের ওলাবিবিতলার হাজার হাত কালী মায়ের মন্দিরে।

জানা যায় ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে শিবপুর ওলাবিবিতলার সম্ভ্রান্ত মুখোপাধ্যায় বংশের ছেলে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এক রাতে পেয়েছিলেন দেবী চণ্ডীর স্বপ্নাদেশ যেখানে তিনি দর্শন পেয়েছিলেন মা কালীর এই রুপটির এবং সেই স্বপ্নাদেশেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন হাজার হাত কালী মায়ের মূর্তি এবং মন্দিরটি। সেই সময় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অর্থনৈতিক সামর্থ্য খুব একটা বেশি ছিল না। তাই স্বপ্নাদেশের কথা তিনি ওলাবিবিতলার বিত্তশালী হালদার পরিবারকে জানান এবং হালদার পরিবার তাকে সহযোগিতা করে।অবশেষে দুই পরিবারের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে মায়ের এই মন্দির। মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন।এই মূর্তির সামনের দিকে দুটো হাত এবং চারিদিকে ছড়িয়ে আছে ৯৯৮ টি হাত। মূর্তির এই এতগুলো হাত নাকি কখনো কেউ কোনদিন গুনতে পারেনি। গোনাও নাকি নিষেধ। প্রথমে মূর্তিটা ছিল সম্পূর্ণ মাটির তৈরি মূর্তি এবং মূর্তির পিছনে চালায় ছিল হাজারটি হাত আঁকা।

পরবর্তীকালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যখন মন্দিরটাকে ভেঙ্গে নতুন করে মন্দির তৈরি করেন তখন চুন-সুরকি, সিমেন্ট , বালি এবং আমেরিকান প্লাস্টার দিয়ে বানানো হয় বিশাল আকার মূর্তি। মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় ১২ ফুট। সিংহের ওপর অধিষ্ঠিতা এই দেবীর গাত্র নীলবর্ণা। বিশাল আকার বাম হাতে রয়েছে খরগো এবং ডান হাতে পঞ্চশুল। দেবীর হাতে রয়েছে বলয় নাকে নথ ও কানে কানপাশা। দেবীর দুই স্কন্ধে ফনা তুলে বসে রয়েছে দুটি সাপ । দেবীর মাথায় রয়েছে রাজচ্ছত্র। যে বিষয়টি চমকপ্রদ এবং আকর্ষণীয় সেটা হল সাধারণ কালি মায়ের মূর্তির মত এই দেবী কিন্তু লাল জিহবা নয়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সর্বদা পূজা পাঠ ধ্যান ঐসব ভক্তি নিয়ে থাকতেন। তিনি একজন তন্ত্রসাধকও ছিলেন এবং তার এলাকায় আশুতোষ তর্করত্ন নামেও পরিচিত ছিলেন। মায়ের স্বপ্নাদেশ তিনি মন থেকে অবজ্ঞা করতে পারেননি তারই ফলস্বরূপ গড়ে উঠেছে এই মন্দির । তিনি প্রাণীহত্যা বা বলিদানে বিশ্বাসী ছিলেন না বলে তন্ত্র বলে মা তন্ত্র নির্দেশে পূজিত হলেও এই মন্দিরে কোন বলি হয়নি আজ পর্যন্ত। বলিদান প্রথা এখানে একেবারে বন্ধ।

এই মন্দিরের ইতিহাসের সূত্রে উঠে আসে, ৬০ বছর আগে কৃষ্ণা সুব্রহ্মণ্যম নামক এক জনৈক দক্ষিণ ভারতীয় শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের এক শুক্রবারে এই মন্দিরে আসেন। তিনি ছিলেন দৃষ্টিহীন। এই মন্দিরের পূজারী তথা সেবায়েত এর মুখে মায়ের রূপ এবং কাহিনীর বর্ণনা শুনে তিনি মনে মনে মায়ের একটি চিত্র কল্পনা করেন। মায়ের কাছে কাতর ভাবে নিজের দৃষ্টি ফিরে পাওয়ারও প্রার্থনা জানান। হঠাৎই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অলৌকিকভাবেই সেই ব্যক্তি ফিরে পান তার দৃষ্টি। তখন তিনি আবারও এই মন্দির দর্শনে আসেন এবং এসে মায়ের মূর্তি চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করে বিস্মিত হন। কারণ তার কল্পনায় তিনি মায়ের যে চিত্র অঙ্কন করেছিলেন তার সাথে বাস্তবের এই মূর্তি হুবহু এক। সেই থেকেই মনে করা হয় এই মূর্তি খুবই জাগ্রত এবং কাউকেই খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না।এরপর তিনি দক্ষিণ ভারতে গিয়ে মায়ের মাহাত্ম্য প্রচার করতে শুরু করেন। সেখান থেকেই একইভাবে দক্ষিণ ভারতেও চালু হয় দেবী হাজার হাত কালীর পূজা। জনশ্রুতি রয়েছে যে কোন এক ব্যক্তি নিষেধ সত্বেও ঠাকুরের হাত গণনা করতে গিয়েছিল এবং গণনা করার কয়েক দিনের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। মন্দিরের মাকে নিয়মিত মাছ সহযোগে আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়।

প্রতিবছরই শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের শুক্রবারে এই মন্দিরে ভক্তদের সমাগম প্রায় চোখে পড়ার মতো। বুদ্ধ পূর্ণিমায় প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে এবং কালীপুজোর দিন এই মায়ের মূর্তি বিশাল ধুমধাম ভাবে পূজা করা হয়। এই মন্দিরে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বংশধরেরাই পরপর উত্তরাধিকার সূত্রে মন্দিরের সেবায়েত হয়ে আসছেন। এই মন্দিরের এক সেবায়েত শ্রীমান মনোজিৎ মুখোপাধ্যায় জানান, হাওড়ায় এই পুজোর প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ ভারতেও এই পুজোর প্রচলনও রয়েছে। সেখানেও বিভিন্ন জায়গায় নিত্য পূজিত হন দেবী হাজার হাত কালী মা। এখানেও শ্রাবণ মাসের শুক্রবারে বহু দক্ষিণ ভারতীয়দের সমাগম হয়। মাঝেমধ্যে দক্ষিণী খাবারেও ভরে ওঠে মায়ের প্রসাদের থালা।পুজো করা হয় সেই প্রসাদ দিয়ে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতার চোর বাগানের ১৮ হাত কালী মূর্তিরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ওলা বিবি তলায় যেখানে মন্দিরটি রয়েছে শোনা যায় সেই জায়গাটিরও নাকি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তারপর ১২৫ টাকায় হালদার পরিবারের কাছ থেকে তিন কাটা জমি কিনে তৈরি করেছিলেন মায়ের এই মন্দির। মায়ের বিগ্রহটি তৈরি করেন কুমোরটুলির প্রিয়নাথ পাল। শুরুর দিকে মন্দিরের আশেপাশে জঙ্গল থাকায় অনেক ডাকাত ও দস্যুরাও মাকে পুজো দিয়ে যেতেন।

শিবপুরের এই কালীমন্দিরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শ্রাবণ মাসের শুক্ল পক্ষের শুক্রবারে মা তামিল ভোগ খান। তখন মায়ের প্রসাদ হয়ে ওঠে টক ভাত, মিষ্টি ভাত, ঝাল ভাত, সম্বর বড়া, দই বড়া ও ঝুরিভাজা। এই মন্দিরটি চাঁদনী স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত। চন্ডিপুরাণের ২২ তম অধ্যায়ে এই হাজারা হাত কালী মায়ের উল্লেখ আছে। কাত্যায়নী,মহামায়ার পর এই অসুর নিধন করতে এসেছিলেন এই হাজর হাত কালী মা। বর্তমানে এই মন্দিরের পূজা অর্চনা ও আরতির সময় সকাল ছটা, দুপুর দুটো, এবং রাত্রি আটটা। কালীপুজোর দিন এখানে এতটাই ভিড় হয় যে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়ন করা হয় এখানে। বিশেষ করে কালীপুজোর দিন মাকে খিচুড়ি পায়েস পোলাও রাইস মাছ ও মিষ্টি সহকারে ভোগ দেওয়া হয়। শিবপুর অঞ্চলের ওলা বিবি তলা থেকে একটু এগোলেই দেখা মিলবে এই মন্দিরের হাজার হাত কালী মন্দিরের দীর্ঘদিন ধরে নিত্য পূজার ফলে এই অঞ্চলের নাম হয়েছে হাজার হাত কালী তলা।লকডাউন পরিস্থিতিতে যখন অন্যান্য মন্দিরে পূজা অর্চনা কঠোর নিয়মের অনুশাসনে চলছিল তখন এই মন্দিরে লকডাউনের সমস্ত সরকারি নির্দেশ মান্য করেই বর্তমান মন্দিরের সেবায়েত প্রতাপ মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশেসামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সমস্ত দর্শনার্থী কে মন্দিরে পুজো দেওয়ার এবং দর্শন করার সুবিধা করে দেওয়া হয়েছিল। এই তীর্থস্থানের মাহাত্ম্য আজও একইভাবে অটুট রয়েছে।