সেও এক কার্তিক মাস। কালীপুজোর দিন। তারকেশ্বর থেকে চলেছি আরামবাগ যাওয়ার পথ ধরে। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দু’পাশে ধানক্ষেতে সোনালি রোদের ঢেউ।
কিন্তু মাঝে মাঝে ছন্দপতনও ঘটছে। মুণ্ডেশ্বরী নদী পেরোনোর পর মাঠময় যেন ছড়িয়ে রয়েছে সবুজের হাহাকার। কিছুদিন আগে মুণ্ডেশ্বরী দু’কূল ছাপিয়ে ভাসিয়ে নিয়েছিল মাঠঘাট। জল সরে গেলেও কাদার মধ্যে মুখ গুঁজে রয়েছে সবুজ ধানগাছগুলি। তাতে ধান ধরার আর সুযোগ ঘটেনি। হরিণখোলার পাশে বিস্তীর্ণ মাঠময় বাতাসে ভাসছে সেই হতাশ্বাস। হায়, হেমন্তলক্ষ্মী!
একসময় এলো মুথাডাঙার মোড়। ডানদিকে বেরিয়ে গেছে পিচঢালা রাস্তা। লোক-উপচানো বাস খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে গোতানের দিকে। ওই পথে খানিকটা গেলেই তেলো-ভেলোর মোড়। আসলে পাশাপাশি দু’টি গ্রাম— তেলিয়া আর ভেলিয়া। কথ্যভাষায় হয়ে গেছে তেলো-ভেলো। এই তেলো-ভেলোর মাঠের সঙ্গে জড়িয়ে আছে খুব আকর্ষণীয় এক ইতিহাস।
একসময় এখানে ছিল বিস্তীর্ণ জঙ্গল। সূর্য ডোবার পর এই পথে লোকজনের যাওয়া-আসা বন্ধ হয়ে যেত ডাকাতের ভয়ে। একবার শ্রীমা সারদাদেবী কামারপুকুর থেকে পায়ে হেঁটে কলকাতা যাচ্ছিলেন এই পথে। তখন দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে। তাই সঙ্গের নারী-পুরুষেরা দ্রুতগতিতে তেলো-ভেলোর মাঠ পেরোতে চেয়ে এগিয়ে গেছে অনেকটাই। সারদাদেবী তাঁদের সঙ্গে পা মেলাতে না পেরে পিছিয়ে পড়েছেন একা। এদিকে জঙ্গল ক্রমশই গভীর হয়ে উঠছে।
এমন সময় এক দীর্ঘদেহী পুরুষ এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর সামনে। পুরুষটির গায়ের রং যেমন কালো, তেমনি ঝাঁকড়া চুল, হাতে শক্তপোক্ত লম্বা লাঠি। বোঝাই যায়, সে একজন ডাকাত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সারদা মাকে দেখে তার মধ্যে যেন এক পরিবর্তন ঘটে গেল। সে বিনীতভাবে মাকে আশ্বস্ত করে বলে, ভয় পেও না মা, আমার সঙ্গে আমার স্ত্রীও আছে। সারদা-মা তাঁকে জানান, তিনি যাচ্ছেন দক্ষিণেশ্বরে রানী রাসমণির কালীবাড়িতে। সেখানে তাঁর স্বামী থাকেন।
সেই ডাকাত, ভীম সর্দার সারদা মাকে বলে, তুমি তো সাধারণ মানুষ নও, মা। তোমার মধ্যে আমি কালী মাকে দেখতে পেয়েছি। আসলে ওই তেলো-ভেলোর মাঠে সেই ডাকাত সর্দার সারদা মায়ের মধ্যে মায়েরই আরাধ্যা কালীকে দর্শন করেছিল। সেখানে পরে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করে সেই ডাকাত ভীম সর্দার।
আজও সেই ভেলোর কালীমন্দির রয়ে গেছে। রয়ে গেছে তার সামনে হাঁড়িকাঠ। পাশেই অদূরে রয়েছে এক পীরের আস্তানা। ওই মন্দিরে আজও কালীপুজো হয়। গত তিন দশক আগে যা দেখেছিলাম, তার চরিত্র আজ অনেক বদলে গেছে, জাঁকজমক বেড়েছে।
তেলো-ভেলোর মোড় থেকে ডানদিকে কিছুটা হাঁটা পথে গেলাম একটি গ্রামে। সেখানকার সরকার বাড়ির ছেলে কুন্তল আমার বন্ধু। কিন্তু কুন্তলকে পেলাম না। সে গিয়েছে হাওড়ায় তার দাদার বাড়ি। তখন গ্রামে-মফস্বলে টেলিফোনের তেমন প্রচলন ছিল না। কুন্তলদের বাড়ির পাশে একটি পুকুর পাড়ে খামারে মেলে দেওয়া রয়েছে ধান। সন্ধ্যার হালকা কুয়াশামাখা অন্ধকার উড়ছে চারপাশে। দু’পাশে ঘন ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ফিরে আসছি। যেন কৃষিসভ্যতার ইতিহাস ছড়িয়ে আছে অবেলার অলোয়।
রাত ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে তারকেশ্বরগামী রাস্তার দু’পাশে। মাঝে মাঝে আলোর ঝলক, ভেসে আসছে কালীপুজোর ঢাকের আওয়াজ। আবার পরমুহূর্তেই চারপাশে নিকষ অন্ধকার। অমাবস্যার ঘন কালো রাতের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ল একটি আড়ম্বরহীন কালীপুজোর দৃশ্য। খোলা আকাশের নিচে একটি ঘন কৃষ্ণবর্ণ কালীমূর্তি। তার গলায় মাটির তৈরি মুণ্ডমালা। চার হাতের একটিতে খড়্গ, অন্য তিনটি হাতেও অস্ত্র আর ঝুলছে কাটা মুণ্ড। তা থেকে যেন ঝরে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। তার নিচে বসে আছে লোলুপ শৃগাল। এত সাদামাটা অথচ এমন তাৎপর্যপূর্ণ একটি দৃশ্য আমূল নাড়িয়ে দিল আমাকে।
প্রথম তারুণ্যেই অনেকগুলো বছর বাংলার বাইরে কাটানোর জন্য এরকম নিরাভরণ দৃশ্য নিবিড়ভাবে দেখার সুযোগ হয়নি আমার। স্কুলে পড়ার সময় গোকর্ণের সহপাঠী বন্ধু শিশিরদের বাড়িতে কালীপুজোর রাতে দেখেছিলাম পাঁঠাবলির দৃশ্য। আমাদের গ্রামের রাখহরি ওরফে রাখু কামার হাঁড়িকাঠে পাঁঠার গলায় খড়্গ বসিয়ে দিয়ে সেই রক্তমাশা খড়্গ হাতে উদ্দাম নৃত্য করছিল, সঙ্গে তুমুল ঢাকের শব্দ। তারকেশ্বর ফেরার পথে মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই দৃশ্য। ততদিন ওই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ কালীমূর্তি, তার পায়ের তলায় শুয়ে থাকা নিরাসক্ত শিব— এই অসামান্য রূপকল্পের তাৎপর্য খানিকটা বুঝেছি। মনে আছে, সেই রাতেই কলকাতায় ফিরে একটি বড় কবিতা লিখেছিলাম। তার মধ্যে ছিল এরকম কয়েকটি পঙ্ক্তি—
রক্তগন্ধে উঠে এসেছে শৃগাল
উল্কার আলোর আঘাতে তুমি জেগে উঠেছো
খোলা আকাশের মণ্ডপে
চারহাতে ঝুলে আছে ছিন্নভিন্ন প্রত্যঙ্গ আমারই
বলির উল্লাস বেজে উঠছে আমারাত্রির ঢাকে
শীর্ণ বুক বিছিয়ে দিয়েছি, নগ্ন পায়ে উঠে এসো
সর্বনাশী মায়া…