ধনতেরাস – পড়শির উৎসব, আত্মীয়তার চোরাটানে বাঙালির উদ্‌যাপন

বিভিন্ন খবরের কাগজে ধনতেরাসের সময় প্রকাশিত অনেক লেখায় পড়েছি, অবাঙালি হিন্দুদের ‘ধনতেরাস’ বা জৈনদের ‘ধনতেরস’-এর সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির কোনও যোগ নেই। তাঁদের কারও লেখায় পড়েছি, ধনতেরাস হল ধন্বন্তরীর পূজা। ধন্বন্তরি, হিন্দু ঐতিহ্য অনুসারে, সমুদ্র মন্থনের সময় আবির্ভূত হন, এক হাতে অমৃতকলস এবং অন্য হাতে আয়ুর্বেদের পবিত্র গ্রন্থ। তিনি দেবগণের চিকিৎসক হিসেবে বিবেচিত হন। ধন্বন্তরীকেও বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করা হয়। আবার কেউ লিখেছেন, ধনত্রয়োদশীর দিনে, সমুদ্র মন্থনের সময় দেবী লক্ষ্মী দুধের সাগর থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। তাই ত্রয়োদশীর দিনে দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়।

এর পাশাপাশি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, ডোগরি ও মৈথিলী লোকসাহিত্যে সামান্য অদলবদল করে একটি ‘দন্তকথা’ বা কিংবদন্তিও পেয়েছি।
গল্পটি হল রাজা হিমার ১৬ বছর বয়সী ছেলে ও তাঁর বৌমার। এই গল্পের সঙ্গে আমাদের মনসামঙ্গলের বেহুলা- লক্ষীন্দরের গল্পের অনেক মিল আছে। রাজা হিমার ছেলের বিয়ের পর জানতে পারে যে রাশিফল অনুযায়ী তার বিয়ের চতুর্থ দিনে সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হবে। একথা জেনে রাজপুত্রের নববধূ সেদিন তাকে ঘুমাতে দেয়নি। সে তার সমস্ত অলঙ্কার এবং অনেক সোনা ও রুপোর মুদ্রা বাসরঘরের দরজায় স্তূপ করে রেখে চারপাশে অনেকগুলি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে। তারপর সে তার স্বামীকে ঘুমিয়ে পড়া থেকে বিরত রাখতে অনেক গল্প বলে এবং গান গেয়ে শোনায়।

সেরাতে, মৃত্যুর দেবতা যমরাজ সাপের ছদ্মবেশে সেই বাসরঘরের দোরগোড়ায় পৌঁছয় ঠিকই, কিন্তু এত প্রদীপের আলো এবং গহনা ও সোনা-রুপোর মুদ্রায় আলোর প্রতিফলনে তাঁর চোখে ধাঁধা লেগে যায়, আর সাময়িকভাবে অন্ধ হয়ে পড়ে। ফলে যমরাজ আর বাসরঘরে ঢুকতে পারেনি, তিনি স্বর্ণমুদ্রার স্তুপের উপরে উঠেবসে নববধূর বলা গল্প ও গানগুলি শুনতে থাকেন। তারপর একসময় ভোর হয়ে গেলে তিনি নিঃশব্দে চলে যান। এইভাবে, নববধূর বুদ্ধিবলে রাজপুত্র সে যাত্রায় মৃত্যু এড়াতে পারে। আর সেদিন থেকেই নাকি দিনটি ধনতেরাস হিসাবে উদযাপিত হয়। বাড়ির মহিলারা যমকে মহিমান্বিত করে রাতভর মাটির প্রদীপ জ্বালাতেন বলে এই প্রথাটি যমদিপদন নামে পরিচিত। এদিন রাতে গমের আটার তৈরি তেরোটি দিয়া বা প্রদীপ ঘি দিয়ে জ্বালানো হয় এবং দক্ষিণ দিকে মুখ করে রাখা হয়।


এবার যদি ধনতেরাসের প্রস্তুতির দিকে তাকাই তাহলেও আমরা অনেক আত্মীয়তার চোরাটান খুঁজে পাবো। কালীপূজোর দু’দিন আগে ত্রয়োদশীর দিনে যে বাড়িগুলি দীপাবলির প্রস্তুতির জন্য পরিষ্কার করা হয়নি সেগুলিকে ভালোভাবে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন করা হয়। সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য ও আয়ুর্বেদের দেবতা ধন্বন্তরির পূজা করা হয়। বাড়ির সদর দরজা থেকে শুরু করে মন্দির বা ঠাকুরঘর অব্দি সারা বাড়িতে চালের আটা এবং সিঁদুরের গুঁড়া দিয়ে ছোট ছোট পায়ের ছাপ আঁকা হয় যা লক্ষ্মীমায়ের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত আগমন বোঝায়। প্রধান প্রবেশদ্বার রঙিন লণ্ঠন এবং প্রদীপের আলো দিয়ে সাজানো হয়, আর রঙ্গোলি বা রঙিন আবির বা রং দিয়ে নানা ঐতিহ্যবাহী নকশায় আলপনা এঁকে সম্পদ ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীকে স্বাগত জানানো হয়। ধনতেরাসের রাতে, লক্ষ্মী এবং ধন্বন্তরীর সম্মানে সারা রাত রঙিন লণ্ঠন এবং প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয় আর বাঙালির লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠের মতোই সারারাত দেবীর প্রশংসাভরা ভজন বা ভক্তিমূলক গান গাওয়া হয় এবং দেবীকে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি নিবেদন করা হয়। মহারাস্ট্রে একটি অদ্ভুত প্রথা রয়েছে যেখানে ভক্তরা এক কেজি গুড়ের সঙ্গে আধা কেজি করে শুকনো ধনের বীজ মিশিয়ে নৈবেদ্য হিসাবে দেয়।

এই রাতে আকাশপ্রদীপগুলিকে নিভিয়ে শুধু তুলসী গাছের গোড়ায় প্রদীপ জ্বালিয়ে পুজো করে সেই প্রদীপটিকে বাড়ির দরজার সামনে স্থাপন করা হয়। এই আলো দীপাবলি উৎসবের সময় অকাল মৃত্যু এড়াতে মৃত্যুর দেবতা যমের কাছে একটি নৈবেদ্য। উত্তর ও পশ্চিম ভারতের গ্রামে, হিন্দু কৃষকরা তাঁদের আয়ের প্রধান উত্স গবাদি পশুগুলিকেও গা ধুইয়ে পরিষ্কার করে, তারপর খুড় ও শিঙগুলিকে রং করে সাজিয়ে পুজো করে দিনটিকে সম্পদ এবং সমৃদ্ধি বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদযাপন করে।

দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে ব্রাহ্মণ বাড়ির মহিলারা নরকা চতুর্দশীর আগের দিন ধনত্রয়োদশীতে কাঁচা হলুদের সঙ্গে দারুচিনির গুড়ো, নানারকম তেতো গাছের পাতা ও শিকড় বেটে মিশিয়ে মারুন্ডু বা ঔষধ তৈরি করে। এই মারুন্ডু ধন্বন্তরীর পুজোর সময় পরিবারের সমস্ত সদস্যকে দেওয়া হয় এবং সূর্যোদয়ের আগে নরকা চতুর্দশীতে খাওয়া হয়। অনেক পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠা মহিলা সেদিন ঐতিহ্য মেনে মেয়ে ও জামাইদের হাতে এই ভেষজ ঔষধের রেসিপি তুলে দেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুসারে শরীরে ত্রিদোষের ভারসাম্যহীনতা দূর করতে এই মারুন্ডু খাওয়া হয়। ভারতীয় তামিলদের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার তামিল ও সিংহলীরাও এই দিনে মারুন্ডু খান।

গুজরাটি পরিবারগুলিতে এদিন ‘ডাল বাথ’ এবং ‘মালপোয়া’ প্রসাদ তৈরি করা হয়। তাঁদের কাছে ধনতেরাস যে কোনও কিছুকে শুদ্ধ করা, নবায়ন এবং লক্ষ্মীপুজোর মাধ্যমে যেকোনও শুভকিছুকে সুরক্ষিত রাখা ও সংরক্ষণের দিন।

জৈন ধর্মে, এই দিনটিকে ধনতেরাসের পরিবর্তে ধনতেরস হিসাবে পালিত হয় , যার অর্থ ‘তেরো তারিখের শুভ দিন’। কথিত আছে যে এই দিনে মহাবীর এই জগতের সমস্ত কিছু ত্যাগ করে ধ্যান করা শুরু করে একসময় মোক্ষলাভ করেন। সেজন্য জৈনরা এই দিনটিকে শুভ বা ধনধান্যের মোহ ত্যাগ করে ধ্যান করার দিন হিসেবে পালন করেন। কর্ণাটকের শ্রাবণবেলাগোলায় বিশাল মহাবীর মূর্তিকে এদিন কলসী কলসী দুধ দিয়ে স্নান করানো হয়। তারপর চলে পালিভাষায় মন্ত্রপাঠ ও দান- ধ্যান।

উত্তর ও পশ্চিম ভারতের অধিকাংশ জায়গাতেই দীপাবলিতে লক্ষ্মীপুজো হয়। বাঙালিরা সেদিন কালীপুজো করলেও অনেক বনেদী বাড়ির পুজোয়, এমনকি কালিঘাটের কালীমন্দিরেও সেদিন লক্ষ্মীর পুজো হয়।

২০০১ – এ কলকাতা বইমেলায় চিলি না পেরু কোন এক লাতিন আমেরিকার দেশ ছিল বিশেষ আমন্ত্রিত। ওদের প্যাভেলিয়নে ওদের দেশের এক প্রাচীন দেবীর ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল। ওই দেবীর খোলা চুল, গলায় মুণ্ডমালা, ন্যাংটো দাঁড়ানো উগ্রমূর্তি দেখে আমার মেয়ে প্রণাম করে বলেছিল, মা কালী! আসলে তিনি ওদের প্রাচীন দেবী। কে তাকে লাতিন আমেরিকায় নিয়ে গেল ? কবে ? কীভাবে?

প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ কুমুদ কুণ্ড চৌধুরী ত্রিপুরার আদিভাষা ককবরকের লিখিত রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলা লিপির ব্যবহালের সপক্ষে বলেছেন। মঙ্গোলিয়ার বর্ণমালা বাংলা বর্ণমালারই পরিবর্তিত রূপ। মা তারা মঙ্গোলিয়ার আরাধ্যা দেবী। ওদের জাতীয় পতাকায় মা তারার ছবি। বাংলার বৌদ্ধ তান্ত্রিক সন্ন্যাসীরা তিব্বত পার হয়ে, চিন পার হয়ে সুদূরে নিয়ে গেছেন বাংলার ধর্ম আর সংস্কৃতি। স্কটল্যান্ড পার হয়ে প্রাচীন আইসল্যান্ডেও মা তারাকে পাবেন। কিছুদিন আগেও ইউরোপে তারা নামের অনেক মহিলাকে দেখেছেন ঢাকার কবি সৈয়দ আবদুল করিম।‘ উমা ‘ নামও তিনি ইউরোপে পেয়েছেন। হলিউডের একজন নামি নায়িকার নামও নাকি ‘উমা’। প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুকুমার সেন তাঁর প্রবন্ধে অনেক ফটোগ্রাফ দিয়ে দেখিয়ে গেছেন যে, দুর্গাদেবী উমা, যিনি সিংহবাহিনী, তিনি ইরান থেকে আমাদের দেশে এসেছেন। কিন্তু শাকম্ভরী দুর্গা তো হরপ্পা যুগ থেকে এদেশেই ছিলেন। শাকম্ভরী আর সিংহবাহিনী পরবর্তী সময়ে কালের স্রোতে একাকার হয়ে গেছে। মঙ্গোল আর হুনরা হলুদ পতাকা, বেগবান ঘোড়া আর রক্তপিপাসু তলোয়ার নিয়ে বারবার ইউরোপের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে। ওরা শুধু সম্পদই লুণ্ঠন করেনি, নারীদের যৌবনও লুঠ করেছে। সেজন্যেই আজ ইউরোপে লক্ষ লক্ষ মঙ্গোলয়েড চেহারার মানুষ দেখা যায়|

নিজেদের জিন ছেড়ে আসার পাশাপাশি হয়তো ওরা মা তারাকেও ওদিকে রেখে এসেছে, নাকি তাঁরা আগে থাকতেই ইউরোপে ছিলেন?
তারা ইউরোপে আগে থাকতেই ছিলেন? কোন পথে বাংলায় এসে মঙ্গোলিয়ায় গিয়ে যাত্রা শেষ করেছেন? শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে দক্ষিণের শহরের নামও মা তারা। সম্প্রতি ওই জেলায় এমপি নির্বাচিত হয়েছেন ক্রিকেটার সনৎ জয়সূর্য । ওদের মা তারা কি আমাদেরই মা তারা ? বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরা নিয়ে গেছেন?

যাই হোক, দীপাবলি উৎসবের প্রথম দিবস ধনতেরাসের দিনটিকে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের হিন্দুরা নতুন কেনাকাটা করার জন্য একটি অত্যন্ত শুভদিন বলে মনে করে, বিশেষ করে সোনা বা রুপোর জিনিসপত্র এবং নতুন পাত্র কেনা হয়। তাঁদের বিশ্বাস যে এদিন কেনা নতুন ‘ধন’ বা মূল্যবান ধাতুর তৈরি কিছু জিনিস সৌভাগ্যের লক্ষণ। আজকাল তো ধনতেরাস সোনা-রুপো ছাড়াও বহুমূল্য প্ল্যাটিনামের গয়না, সোনা রুপোর মুদ্রা থেকে শুরু করে কমদামী স্টিলের বাসন, রান্নাঘরের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এমনকি নতুন ঝাড়ু কেনার জন্য সবচেয়ে শুভ উপলক্ষ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। এদিন অনেককে রান্নাঘর বা বাড়ির প্রয়োজনে মিক্সি, গিজার, এয়ার কুলার ইত্যাদি নানা যন্ত্রপাতি এবং অটোমোবাইলের ভারী কেনাকাটা করতেও দেখেছি। তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এখন শুধু বাঙালি নয়, সারা পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে বসবাসকারী সমস্ত ভারতীয়রাই জাতিধর্মভাষাবর্ণ নির্বিশেষে এই উৎসব পালন করছে।