উদ্বোধন করেছিলেন আচার্য নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনা
খায়রুল আনাম : স্বাধীনতা উত্তরকালে অবিভক্ত ভারতে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি সম্পত্তি দেখভালের জন্য বার বার পাঠিয়াছেন শিলাইদহে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনজোড়া সাহিত্য-সৃজনকর্মে বহু রচনা-ই এই শিলাইদহে বসে রচনা করেছেন। তাঁর নোবেলজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’র বহু রচনা এই শিলাইদহে বসেই তিনি রচনা করেছেন। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ঘটেছে দ্বিখণ্ডিত হয়ে। জন্ম হয়েছে পাকিস্তানের। আবার পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান মাতৃভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে হয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ভারত ও বাংলাদেশ-এই দু’টি দেশেরই জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথ রচিত। যাঁর হাত দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ভারতের যে প্রাক্তন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীকে দেখা হয় সেই প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধী এক সময় ছিলেন বিশ্বভারতীর ছাত্রী এবং আচার্য। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে বিদেশী পড়ুয়াদের মধ্যে বাংলাদেশি পড়ুয়াদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে প্রদান করা হয়েছে বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম। শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে বিশ্বভারতীর সমাবর্তন উৎসবে উপস্থিত থেকে তিনি দেশিকোত্তম গ্রহণও করেছেন।
তাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের আগ্রহের সাথে সহমত হয়ে শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন নির্মাণের জন্য বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে জমি দেওয়া হলে সেখানে বাংলাদেশ সরকারের অর্থানুকূল্যে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ ভবন। এই বাংলাদেশ ভবনের জন্য বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ জমি দেওয়ার পরেই বাংলাদেশ সরকার এর নক্সা অনুমোদন করে বাংলাদেশ ভবন নির্মাণের সমস্ত টাকা তুলে দেয় বিশ্বভারতীর হাতে। কিন্তু বিশ্বভারতীর অভ্যন্তরীণ গোলযোগে বাংলাদেশ ভবন নির্মাণের কাজ থমকে যায়। ভারতের তৎকালীন বিদেশ মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফরে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ তাঁর কাছে শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবনের বিষয়টি উত্থাপন করেন। সুষমা স্বরাজ দেশে ফিরেই বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি তথা বিশ্বভারতীর পরিদর্শক প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেন এবং তারপরই বিশ্বভারতীর শান্তিনিকেতনের পূর্ব পল্লিতে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ ভবন। ২০১৮ সালের ২৫ মে বিশ্বভারতীর আচার্য তথা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ একত্রিতভাবে দুপুর সাড়ে ১২ টায় আন্তর্জাতিক বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উদ্বোধনের কিছুদিন পরে ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ ভবনের সংগ্রহশালা সকলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। দুই দেশের শিল্পকলা, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাসের মেলবন্ধন এই ৪ হাজার ১০০ বর্গ মিটারের বাংলাদেশ ভবনে রয়েছে দু’টি সেমিনার হল, একটি গ্রন্থাগার, একটি জাদুঘর, একটি শিক্ষাকেন্দ্র, একটি ক্যাফেটারিয়া এবং ৪৫৩ আসনের অত্যাধুনিক মিলনায়তন। কিন্তু করোনা অতিমারির সময় থেকে বাংলাদেশ ভবনের দ্বার সাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে পড়ুয়াদের জন্য বাংলাদেশ ভবনের বিশাল গ্রন্থাগারের দ্বার খুলে দেওয়া হলেও সাধারণের প্রবেশাধিকারে নিষেধাজ্ঞা এখনও রয়ে গিয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ ভবনের দেখভাল যে ভাবে হওয়ার কথা ছিলো তা হয়নি বলেই বলা হয়। ইতিমধ্যেই রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে বাংলাদেশ ভবনের বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়েছে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রগুলিও সঠিকভাবে কাজ করে না। এরফলে সংগ্রহশালা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ ভবনের এই পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে শান্তিনিকেতনের বাংলাদেশ ভবন পরিদর্শন করলেন কলকাতাস্থ বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস। তিনি বিশ্বভারতীর বিভিন্ন অধিকারিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ ভবনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেন। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ভবন সংস্কারে যে কাজ করেছে তাও তিনি পরিদর্শন করেন। এই আলোচনায় শান্তিনিকেতনের বাংলাদেশ ভবনে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের জন্য স্থায়ী ভাষা শহীদবেদি নির্মাণের প্রস্তাব নিয়েও আলোচনা হয়েছে।