• facebook
  • twitter
Friday, 25 April, 2025

শান্তিনিকেতনে নববর্ষ

১৯০২ সালে, বাংলার ১৩০৯-এ আশ্রমের প্রথম নববর্ষ উৎসবের আয়োজন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

সৈয়দ হাসমত জালাল

‘আজ নববর্ষের প্রাতঃসূর্য এখনো দিক্‌প্রান্তে মাথা ঠেকিয়ে বিশ্বেশ্বরকে প্রণাম করেনি–এই ব্রাহ্মমুহূর্তে আমরা আশ্রমবাসীরা আমাদের নূতন বৎসরের প্রথম প্রণামটিকে আমাদের অনন্তকালের প্রভুকে নিবেদন করবার জন্যে এখানে এসেছি। এই প্রণামটি সত্য প্রণাম হোক।
এই-যে নববর্ষ জগতের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, এ কি আমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে পেরেছে? আমাদের জীবনে কী আজ নববর্ষ আরম্ভ হল?

এই-যে বৈশাখের প্রথম প্রত্যুষটি আজ আকাশপ্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালো, কোথাও দরজাটি খোলবারও কোনো শব্দ পাওয়া গেল না, আকাশ-ভরা অন্ধকার একেবারে নিঃশব্দে অপসারিত হয়ে গেল, কুঁড়ি যেমন করে ফোটে আলোক তেমনি করে বিকশিত হয়ে উঠল–তার জন্যে কোথাও কিছুমাত্র বেদনা বাজল না। নববৎসরের ঊষালোক কি এমন স্বভাবত এমন নিঃশব্দে আমাদের অন্তরে প্রকাশিত হয়?’
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১ বৈশাখ ১৩১৮

১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরের বছরই অর্থাৎ ১৯০২ সালে, বাংলার ১৩০৯-এ আশ্রমের প্রথম নববর্ষ উৎসবের আয়োজন করেছিলেন তিনি। সে দিন সকালের উপাসনার পর রবীন্দ্রনাথ অভিভাষণ দিয়েছিলেন নববর্ষ বিষয়ে।

পরে বিকেলবেলায় সেই উৎসবে গান গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ— ‘আমারে করো তোমার বীণা’। প্রবল ঝড় উঠেছিল সেই বিকেলে। তারই মধ্যে উৎসবে তাঁর আমন্ত্রণে যোগ দিয়েছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, মোহিতচন্দ্র সেন, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ।

তারপর থেকেই বৈশাখের প্রথম দিনটিতে বর্ষবরণের উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে। শান্তিনিকেতনের বাইরে বা বিদেশে থাকলেও এদিন রবীন্দ্রনাথের মন পড়ে থাকত শান্তিনিকেতনেই। রবীন্দ্রনাথ এমনই এক নববর্ষের দিনে ইংল্যান্ডের পথে আটল্যান্টিক মহাসমুদ্র পার হচ্ছিলেন জাহাজে। দিনটি ছিল ১৯১৩ সালের ১৪ এপ্রিল। তিনদিন পরে ১৭ এপ্রিল রোদেনস্টাইনের বাড়ি থেকে তিনি অজিতকুমার চক্রবর্তীকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘এবার আমার নববর্ষের প্রথম দিন এই সমুদ্রযাত্রার মাঝখানে এসে দেখা দিল। প্রত্যেকবার আমার চিরপরিচিত পরিবেষ্টনের মাঝখানে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে নববর্ষের প্রণাম নিবেদন করেছি— কিন্তু এবার আমার পথিকের নববর্ষ, পারে যাবার নববর্ষ। এখানকার নববর্ষ যেন আমার কুল থেকে বিদায় নেবার হুকুম নিয়ে এল— আমাকে যাত্রার আশীর্বাদ দিয়ে গেল।’

শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকভাবেই নববর্ষ উদযাপন নয়, এই নববর্ষ সম্পর্কে তাঁর বিভিন্ন ভাবনাচিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর লেখা বহু কবিতায়, গল্পে, নাটকে, প্রবন্ধে এবং চিঠিপত্রে। এছাড়াও বর্ষবিদায় এবং বর্ষবরণ উপলক্ষ্যে শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন সময়ে অভিভাষণ দিয়েছেন তিনি। তাতে তাঁর নববর্ষ সম্পর্কে গভীর দার্শনিক ভাবনাচিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। এরকমই এক অভিভাষণে তিনি বলেছিলেন— ‘মানুষ সৃষ্টির শেষ সন্তান বলেই মানুষ সৃষ্টির মধ্যে সকলের চেয়ে প্রাচীন। সৃষ্টির যুগযুগান্তরের ইতিহাসের বিপুল ধারা আজ মানুষের মধ্যে এসে মিলেছে। মানুষ নিজের মনুষ্যত্বের মধ্যে জড়ের ইতিহাস, উদ্ভিদের ইতিহাস, পশুর ইতিহাস সমস্তই একত্র বহন করছে। প্রকৃতির কত লক্ষকোটি বৎসরের ধারাবাহিক সংস্কারের ভার তাকে আজ আশ্রয় করেছে।| এই-সমস্তকে যতক্ষণ সে একটি উদার ঐক্যের মধ্যে সুসংগত সুসংহত করে না তুলছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার মনুষ্যত্বের উপকরণগুলিই তার মনুষ্যত্বের বাধা, ততক্ষণ তার যুদ্ধ-অস্ত্রের বাহুল্যই তার যুদ্ধজয়ের প্রধান অন্তরায়। একটি মহৎ অভিপ্রায়ের দ্বারা যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার বৃহৎ আয়োজনকে সার্থকতার দিকে গেঁথে না তুলছে ততক্ষণ তারা এলোমেলো চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে অহরহ জীর্ণ হয়ে যাচ্ছে এবং সুষমার পরিবর্তে কুশ্রীতার জঞ্জালে চারি দিককে অবরুদ্ধ করে দিচ্ছে।’

গ্রীষ্মকালে শান্তিনিকেতনে জলের কষ্টের কারণে আশ্রম ছুটি হয়ে যেত পয়লা বৈশাখ দিনটি উদযাপিত করার পর। এদিকে ২৫ বৈশাখ গুরুদেবের জন্মদিন। তাই আশ্রমিকরা স্থির করেন ওই পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের সঙ্গেই তাঁরা উদযাপন করবেন রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনও। ১৯৩৬ সালে ১৫ এপ্রিল নববর্ষের দিনটিতেই কবির জন্মদিনও পালিত হয়। এই উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ সেদিন কবিতায় লিখেছিলেন, ‘বসেছি অপরাহ্নে পারের খেয়াঘাটে’। সেদিন তাঁর জন্মোৎসবের এই অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘খ্যাতির কলরব মুখর প্রাঙ্গণে আমার জন্মদিনের যে আসন পাতা হয়েছে সেখানে স্থান নিতে আমার মন চায় না। আজ আমার প্রয়োজন স্তব্ধতায় শান্তিতে। … আজ ফুলের ঋতু যাক, আর ফলের ঋতুও শেষ হোক, আজ নির্বিশেষে আপনাকে আপনার মধ্যে পূর্ণ করে তোলবার দিন।’

কবির জীবদ্দশায় তাঁর শেষ জন্মদিনটিও পয়লা বৈশাখেই উদযাপিত হয়েছিল শান্তিনিকেতনের আশ্রমে। তিনি তখন যথেষ্ট অসুস্থ। এ কারণে তাঁর শরীরের প্রতি লক্ষ্য রেখে কিছুটা অনাড়ম্বরেই কবির জন্মোৎসব পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিষণ্ণ আশ্রমিকরা। উৎসব হলেও তা ছিল বেদনায় শান্ত ও কিছুটা নীরব।

মানবের জয়গান গেয়ে নববর্ষ উপলক্ষ্যে তাঁর লেখা একটি কবিতাকে গানে রূপান্তরিত করলেন রবীন্দ্রনাথ— ‘ঐ মহামানব আসে’ এটই ছিল তাঁর সেদিনের নববর্ষের গান। সেদিন মন্দিরে উপাসনা পরিচালনা করেছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও রবীন্দ্রনাথ হেঁটে এসে সভার মধ্যে আসন গ্রহণ করলেন। নববর্ষ ও তাঁর জন্মদিনে সেই অনুষ্ঠানে সেদিন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমার মতো সৌভাগ্য অতি অল্প লোকেরই আছে, শুধু যে আমার স্বদেশবাসীরাই আমাকে ভালোবেসেছেন তা নয়, সুদূর দেশেরও অনেক মনস্বী তপস্বী রসিক আমাকে অজস্র আত্মীয়তা দ্বারা ধন্য করেছেন।’

পরবর্তীকালে অবশ্য শান্তিনিকেতনে গ্রীষ্মকালে জলকষ্ট দূর হওয়ায় পয়লা বৈশাখের পর আশ্রম ছুটি হয়ে যায় না। তাই ২০০০ সাল থেকে এখন রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনটি সেখানে ২৫ বৈশাখেই উদযাপিত হয়। তবে বাংলা নববর্ষ আগের মতোই পয়লা বৈশাখে উদযাপিত হয়ে থাকে।