বেহালা ক্ল্যাসিকাল ফেস্টিভ্যাল

বেহালা অঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠা ক্লাসিকাল ফেস্টিভ্যালের এবার ছিল ত্রয়োদশ বর্ষ । প্রতি বছরের মতো বেহালার ব্লাইন্ড স্কুল মাঠে প্যান্ডেলের ঘেরাটোপে জানুয়ারির নয় থেকে বারো এই চারদিন ধরে অনুষ্ঠিত হলো । বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে শুরু হয়ে চললো রাত অবধি । উদ্বোধনী লগ্নে উপস্থিত ছিলেন- মালা রায় (সাংসদ), রত্না চট্টোপাধ্যায় )বেহালা পূর্বের বিধায়ক), অভিজিৎ মুখার্জি (মেয়র পারিষদ), রূপক ভট্টাচার্য (পৌরপিতা), শাশ্বতী সেন (সেনকো গোল্ড সংস্থার পক্ষে), পরিমল ভট্টাচার্য (গায়ক), সন্দীপন ব্যানার্জি প্রমুখজন। এবছর সংস্থার তরফে জীবনকৃতি সম্মান প্রদান করা হয় বিশেষ বর্ষীয়ান তবলাবাদক ও গুরু পন্ডিত গোবিন্দ বোসকে। মঞ্চে বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে এই কাজটি সুসম্পন্ন করা হয়। এরপর শুরু হয় প্রথম সন্ধ্যার অনুষ্ঠান।

প্রথম সন্ধ্যায় কন্ঠসঙ্গীত শিল্পী বিদুষী গৌরী পাথারের গায়ন পর্ব দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান ।অভিজ্ঞ শিল্পী শুরু করেন রাগ শ্রী সহকারে। বিলম্বিত পরিচিত বন্দিশ “ওয়ারি জাউ রে” , তারপর দ্রুত বন্দিশ “চলো রে মাঈ মাই রাম সিয়া দরশন কো”। তানকারির কারুকাজে পরিবেশনা মন্দ লাগেনি। এরপর রাগ কৌশিধ্বনিতে সুপরিচিত রচনা “ইয়াদ পিয়া কি আয়ে” শোনালেন । ভজন “মারে ঘর আওজি” ছিল সবশেষে। সহযোগিতায় ছিলেন পন্ডিত সমর সাহা (তবলা) ও সুপ্রিয়া পাঠক যোশী (হারমোনিয়াম)। হিন্দুস্তানির পর এই সন্ধ্যায় ছিল কর্ণাটকী রাগ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান। যন্ত্র সরস্বতী বীণায় মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করতে দেখা গেল বিদুষী (ডক্টর) জয়ন্তী কুমারেশ ও ভায়োলিনে বিদ্বান আর. কুমারেশকে। নাটৈ রাগের পরিবেশনা দিয়ে (আদি তাল) শুরু করেন, দেবী সরস্বতীকে উৎসর্গ করে । এরপর ছিল রাগ খামাস আলাপ এবং মিক্সড উপস্থাপনা যেখানে বীণা ও ভায়োলিন তাদের পরিবেশনা দেখায়। এরপর ছিল রাগ মনোরঞ্জনী আধারে আরেকটি পরিবেশন। অত্যন্ত উপভোগ্য এই পর্বের রেশ এগোতে থাকে মূল আকর্ষণ রাগম – তানম – পল্লবী। দক্ষিণী সংগীতের বিশেষ রাগ সিমেন্দ্র মধ্যম (ত্যাগরাজার রচনা) আধারে শোনা গেল উপস্থাপনা; যেখানে হিন্দুস্তানি রাগ সঙ্গীতের কায়দায় আলাপ, জোড় এবং কম্পোজিশন পরিবেশন করেন এই দুই যন্ত্রশিল্পী। তারপরে ছিল ঘটম – মৃদঙ্গমের কথোপকথন, যেটি ‘তানিয়াবর্তনম’ নামে পরিচিত। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এদের সহযোগ প্রদান করেন- বিদ্বান ইউ জয়চন্দ্র রাও (মৃদঙ্গম) ও বিদ্বান গিরিধর উডুপা (ঘটম)।

দ্বিতীয় সন্ধ্যার সূচনা হয় সেতার বাদনে। প্রতিভাবান কল্যাণ মজুমদার রাগ শ্যাম ম-কল্যাণ আধারে শোনালেন আলাপ ও জোড় এবং পরে রূপক ও ত্রিতালে দুখানি গত। এরপর ছিল বন্দিশ কি ঠুংরি (খাম্বাজ)। অনন্য এই পর্বে তবলা সহযোগিতায় ছিলেন আরেক তরুণ আর্চিক ব্যানার্জি। তারপর ছিল এই সন্ধ্যার বিশেষ আকর্ষণ। এইসময়ে জনপ্রিয়তার চূড়োয় থাকা তবলা শিল্পী ওজাস আডিয়ার লহরা। মিলিন্দ কুলকার্নির হারমোনিয়াম নগমা সাহচর্যে ত্রিতালের উপর নানান আঙ্গিকে বুঁদ করে রাখেন শ্রোতা দর্শকদের। এই সন্ধ্যার শেষে ছিল কর্নাটকী কন্ঠ সঙ্গীতের উপস্থাপনা। চেন্নাইয়ের বিশিষ্ট কর্ণাটকী কন্ঠসংগীত শিল্পী বিদুষী অরুনা সাইরাম আসেন মঞ্চে। শুরু করেন একটি শ্লোক দিয়ে; এরপর একে একে উপস্থাপন করেন রাগ অমৃতবর্ষিনী, পুণ্যাগবরালি এবং কিরওয়ানি। আলাদা করে বলতে হয় রাগ কিরওয়ানির কথা। রাগম-তানাম-পল্লবী এই পর্বে কিরওয়ানি রাগটিকে বিস্তৃত করেন। পরে ছিল তবলা ও মৃদঙ্গমের কথোপকথন ‘তানিয়াবর্তনাম’। তাঁকে অত্যন্ত সু- সহযোগিতা করেন তবলামায়েস্ত্রো পন্ডিত বিক্রম ঘোষ, ভায়োলিনে পদ্মা শংকর, এবং মৃদঙ্গমে পত্রী সতীশ কুমার । তবে এই পর্বেবাদ্যযন্ত্রের উচ্চকিত স্বর যেন মনে হয় পরিবেশনকে খানিকটা হলেও ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল।


তৃতীয় সন্ধ্যার সূচনা হয় বংশীবাদনে। সংগীতমহলে ধীরে ধীরে খ্যাতি অর্জন করা পরমানন্দ রায় পরিবেশন করেন রাগ শ্রী। পরে শুনতে পাওয়া গেল মিশ্র পিলু। সাথে তবলা সহযোগিতায় ছিলেন সৌমেন নন্দী। এরপর সরোদ পরিবেশন করতে আসেন সুপরিচিত অভিষেক লাহিড়ী। বাজনার সূচনা করেন রাগ শুদ্ধ কল্যাণে। আলাপ পর্বের পর ছিল গতকারি। পরে জনসম্মোহনী ও মিশ্র পিলু রাগ দুটি পরপর শোনান। ওজাস আডিয়ার তবলা সাহচর্যে যেন আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে সমগ্র পর্বটি। এই পর্বের শেষে ছিল গুরু পন্ডিত উল্লাস কোশলকারের কন্ঠসংগীত। শুরু করেন রাগ কেদারে; বিলম্বিত বন্দিশ “যোগী রাওয়ালা” ও দ্রুতে গাইলেন “সুঘর চতুর বাঈয়া”। এরপর ছিল যোগ রাগে “ক্যায়সে ক্যায়সে করে” ও “ঘড়ী পল ছিন”। অত্যন্ত উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল এই উপস্থাপনাপর্ব। শেষ করলেন খাম্বাজ রাগ আশ্রিত “কোয়েলিয়া কুক শুনায়ে” পরিবেশন করে । তবলা সাহচর্যে ছিলেন সত্যজিত তলোয়ালকর, এবং হারমোনিয়ামে মিলিন্দ কুলকার্নি।

এই ফেস্টিভ্যালের অন্তিম ও শেষ সন্ধ্যার প্রথম শিল্পী ছিলেন জনাব গোলাম হাসান খান। তাঁর চয়নে ছিল রাগ পূর্বী ও মারুবেহাগ। শেষ করলেন কৌশিধ্বনিতৈ জনপ্রিয় “ইয়াদ পিয়া কি আয়ে” গেয়ে। এই পর্বে সহযোগিতায় ছিলেন – অশোক মুখার্জি (তবলা) ও পন্ডিত জ্যোতি গোহ (হারমোনিয়াম) । দ্বিতীয় শিল্পী অভয় রুস্তম সোপোরি। ইনি সুবিখ্যাত সোপোরি বাজ শৈলীর আঙ্গিকে শোনালেন রাগ ভগবতী। স্বভাবতই এই পরিবেশনা সকলের মন জয় করে নেয়। আলাপ পর্ব, ও পরে গতকারী আর ঝালা। অত্যন্ত উপভোগ্য এই নিবেদন পর্বে সহযোগিতা করেন- সত্যজিত তলোয়ালকর (তবলা) ও ঋষিশঙ্কর উপাধ্যায় (পাখোয়াজ)। এ বছরের অধিবেশনে সমাপ্তি হয় ইমদাদখানি ঘরানার সুবিখ্যাত বাজিয়ে উস্তাদ সুজাত হুসেন খাঁর সেতার পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। রাগ ঝিঁঝিটকে বিস্তৃতভাবে উপস্থাপন করেন । পরে অনেকগুলো গান মেডলি আকারে শুনিয়ে শ্রোতা মন্ডলীকে মুগ্ধ করেন। তবলা সহযোগিতায় ছিলেন- অমিত চৌবে ও স্বপন অঞ্জরিয়া।