অবহেলায় ভগবান তৈরির কারখানা, মুখ ফেরাচ্ছে নতুন প্রজন্ম

শোভন মণ্ডল: ঢাকের বাদ্যি, পাড়ার মোড়ে মোড়ে প্যান্ডেল, চারদিন মনভরে আমোদ-প্রোমোদ৷ বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো দোর গোড়ায় কড়া নাড়ছে৷ বাকি হাতে গোনা কয়েকটা দিন৷ ক্যালেন্ডার বলছে আর মাত্র ৭৫ দিন বাকি শারদোৎসবের৷ শরতের আকাশে ভাসমান পেঁজা তুলোর মতো মেঘ কিংবা মাঠজুড়ে কাশফুলের শুভ্র শোভা, গ্রাম বাংলায় এর দেখা মিললেও শহর কলকাতায় প্রায় অমিল দুর্গাপুজোর এই প্রাকৃতিক আভাসগুলি৷ তাই কলকাতাবাসীর পুজোর কাউন্টডাউন শুরু হয় কুমোরটুলির হাত ধরেই৷ সামাজিক মাধ্যমে হোক কিংবা সশরীরে গিয়ে, কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের হাতে তৈরি খড়ের কাঠামোতে মাটির প্রলেপ দেখে কলকাতাবাসী দিন গুনতে শুরু করে তাদের প্রাণের উৎসবের৷

২৪৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী উত্তর কলকাতার এই পটুয়া পাড়া আজ সমস্যায় জর্জরিত৷ পুজোর মরশুমে কুমোরটুলি চর্চার শীর্ষে থাকলেও হাল ফেরেনি শিল্পীদের৷ সংকীর্ণ গলিতে চলাফেরা করা দায় হয়েছে৷ প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি এলাকাজুড়ে৷ এমনকী মূর্তি রাখার পর্যাপ্ত জায়গারও অভাব দেখা দিচ্ছে৷ সমস্যার কথা সরকারকে বারবার জানিয়েও নিরাশ হতে হয়েছে মৃৎশিল্পীদের৷ যদিও, কুমোরটুলিকে ‘মডেল’ পাড়া হিসেবে গড়ে তুলতে ২০১০ সালে উদ্যোগ নিয়েছিল তৎকালীন বাম সরকার৷ এ, বি, সি এবং ডি চারটি ব্লকে ভাগ করে কুমোরটুলি সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল৷ সেই মতো ১০০ জন শিল্পীকে অস্থায়ী পুনর্বাসন কেন্দ্রেও পাঠনো হয়৷ কিন্ত্ত ২০১১ সালে রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পর ‘কুমোরটুলি মডেল’ কার্যত থমকে যায়৷

কুমোরটুলির একজন মৃৎশিল্পী বিশাল পাল৷ অতীতে তাঁর ঠাকুরদা, এরপর তাঁর বাবা এবং বর্তমানে তিনি, বংশানুক্রমিকভাবে মূর্তি গড়ে আসছে গোটা পরিবার৷ বর্ধমান, নদিয়া থেকে শিল্পীরা এসে কাজ করেন তাঁর তত্ত্বাবধানে৷ তিনি মনে করছেন, সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের উপর৷ সম্পূর্ণ কুমোরটুলিকে নতুন করে সাজানোর অতীতের সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করলে উপকৃত হবে মৃৎশিল্পী সহ পুজো উদ্যোগক্তারা৷ টিনের চালায় প্লাস্টিক ঘেরা ছোট্ট পরিসরে কাজ করতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তাঁরা৷ বৃষ্টিতে মূর্তিকে জলের হাত থেকে বাঁচাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে৷ বেশ মোটা অংকের টাকা ভাড়া দিয়ে তবেই মিলছে এই সামান্য জায়গা৷ সরকার যদি কুমোরটুলিকে সঠিক পরিকল্পনা মাফিক অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে সাজিয়ে তুলে মালিকদের হাতে তুলে দেয় তবে ভাড়ার সমস্যা সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিকের ব্যবহারও কমবে৷ একইসঙ্গে আরও বেশি সংখ্যায় মূর্তি গড়তে পারবেন তাঁরা৷ ফলে মূর্তির দাম অনেকাংশে কমবে৷ দূষণের মাত্রাও হ্রাস পাবে৷


বর্তমানে কুমোরটুলিতে শিল্পীদের কিছু সংগঠন গড়ে উঠেছে৷ কুমোরটুলি সেবা সমিতি, কুমোরটুলি মৃৎশিল্পী সমিতি তাদের মধ্যে অন্যতম৷ এই সংগঠনগুলি মূলত শিল্পীদের আর্থিক, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সাহায্য করে থাকে৷ শিল্পীদের অভিযোগ, সরকারের তরফে কোনও সাহায্য তাঁরা পাচ্ছেন না৷ মৃৎশিল্পী বিশাল পালের কথায়, ‘ভাতার প্রয়োজন নেই, স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দিলেই খুশি আমরা৷’ কুমোরটুলির আরও এক শিল্পী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, ‘আমাদের ঘুমানোর জায়গার ঠিক নেই, খাওয়ার জায়গা ঠিক নেই৷ উপার্জনও অনিশ্চিত৷ এই অনিশ্চিয়তায় কীভাবে নতুন প্রজন্ম মৃৎশিল্পে আসবে! প্রতিভা থাকলেও শিল্পীদের দুরাবস্থা দেখে এই পেশা ভবিষ্যতে কতজন বেছে নেবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে৷’

কংক্রিটের জঙ্গলে থাকা এক টুকরো কুমোরপাড়ার হাল ফিরবে শীঘ্রই৷ এখন এই আশাতেই দিন গুনছেন ভগবান তৈরির কারিগড়েরা৷