সন্তানের শিক্ষাখাতে সঠিক বিনিয়োগ

প্রতীকী চিত্র

শিক্ষালাভের মধ্যে দিয়েই যে জীবনে সাফল্যলাভ করা যায়, এই আপ্তবাক্যটুকু ছোটবেলাতেই মাথায় গেঁথে দিতে চেয়েছেন আমাদের অভিভাবক ও গুরুজনেরা। সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করে তুলতে এবং সঠিক শিক্ষাদানের জন্য কঠিন পরিশ্রম করতে হয় বাবা-মাকে। এর জন্য বেশ কিছুটা পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়- যার ব্যবস্থা অগ্রিম করে রাখতে হয় যাতে সন্তানকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া যায়।

আধুনিক সমাজব্যবস্থায় শিক্ষার ধরন বদলেছে। তাই মা-বাবারাও চিন্তাধারার পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছেন। এখন বাংলা মাধ্যমের তুলনায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করানো হয় এমন ধারণা থেকে যে, ইংরেজি ভাষাটা ভালোভাবে রপ্ত করতে পারলে, সন্তান বা সন্ততি পৃথিবীর যে-কোনও প্রান্তে কর্মজীবনে সাফল্য লাভ করবে।

সেই কারণেই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের চাহিদা বাড়ছে এবং এই সুযোগে স্কুল কর্তৃপক্ষও পঠনপাঠনের জন্য আর্থিক বোঝা চাপিয়ে চলেছে অভিভাবকদের উপর। আর সন্তানের শিক্ষাখাতে খরচ হওয়া এই বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিতে হিমসিম খাচ্ছেন এই সময়ের মা-বাবারা। কিন্তু যদি পরিকল্পনামাফিক ব্যয় বরাদ্দ করা যায় সন্তানের শিক্ষাখাতে, তাহলে আর্থিক ঝামেলায় পড়ার সম্ভাবনা কমবে।


অতএব, সন্তানের শিক্ষাখাতে সঠিক ব্যয় বরাদ্দের জন্য আগাম পরিকল্পনা করা জরুরি। সন্তানের শিক্ষাজীবনকে তিনটি পর্বে ভাগ করে নিন প্রথমে। প্লে স্কুল থেকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত ধরে নিন প্রথম পর্ব। ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্ব এবং তার পরের উচ্চশিক্ষা কিংবা পেশাগত শিক্ষাকে রাখুন তৃতীয় পর্বে।

এবার সঞ্চয় পর্ব যার অগ্রিম পরিকল্পনা করা দরকার। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর থেকেই টাকা জমানো শুরু করুন। এক্ষেত্রে আগাম সময় পাবেন আড়াই বছর। কারণ, সন্তানের আড়াই বছর বয়স থেকে শুরু হয় শিক্ষাজীবন। প্রথমে খেয়াল করুন আপনার মাসিক আয়ের পরিমাণ। তারপর নানা খাতে ব্যয়ের পরিমাণ হিসাব করার পর দেখুন কতটা টাকা বাঁচাতে পারবেন। এরপর সন্তানের আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত, অর্থাৎ ত্রিশ মাস টাকা জমাতে থাকুন। এরই পাশাপাশি, খোঁজ নিন বিভিন্ন স্কুলের ভর্তি বাবদ এবং টিউশন ফিজ ইত্যাদি খরচের পরিমাণের বিষয়ে। এবার আপনার আর্থিক সামর্থ্যের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিন, কোন স্কুলে ভর্তি করলে নিশ্চিন্তে সন্তানকে সঠিক শিক্ষাদান করতে পারবেন। এক্ষেত্রে মাথায় রাখবেন, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই যদি চাকুরিজীবী হন, তাহলে সন্তানকে হয় ডে-কেয়ার অথবা ক্রেশ-এ কিংবা আয়ার কাছে রাখতে হবে এবং এর জন্য আরও পাঁচ-সাত হাজার টাকা খরচ হবে প্রতি মাসে।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বাচ্চার অ্যাডমিশন বাবদ মোটামুটি পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে এক লক্ষ টাকা খরচ আছে ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াতে গেলে। এরপর আছে স্কুল ড্রেস, বইখাতা এবং মান্থলি স্কুল ফিজ। প্রায় সব ভালো ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে, দু’হাজার টাকা মান্থলি ফিজ নিয়ে থাকে নার্সারি থেকে ক্লাস ওয়ান পর্যন্ত। এরপর ক্লাস ফোর পর্যন্ত তা দাঁড়ায় মোটামুটি আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার মতো। ক্লাস ফাইভ থেকে খরচ কিছুটা বাড়বে। কারণ, বেশিরভাগ স্কুলে ক্লাস ফাইভ থেকে সবরকম ফিজ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে পড়ার চাপ বাড়লে হোম ওয়ার্ক-এর জন্য যদি হোম টিউটর রাখেন তাহলে খরচ আরও কিছুটা বাড়বে এবং এই ব্যয়ের পরিমাণ প্রতিবছরই কিছুটা বাড়তে থাকবে। তাই সেইমতো ব্যয় বরাদ্দও করতে হবে মা-বাবাকে। ক্লাস এইট থেকে টেন মোটামোটি ৫০০০ টাকা ফিজ বাবদ ব্যয় হবে প্রতি মাসে। এর সঙ্গে থেকে যাবে প্রাইভেট টিউশন বাবদ ব্যয়।

তৃতীয় পর্ব, অর্থাৎ দশ ক্লাস পাশ করার পর যেমন ‘বিভাগ’ বেছে নেবে আপনার সন্তান, খরচের পরিমাণটাও তেমনই হবে। অর্থাৎ, আর্টস, কমার্স এবং সায়েন্স- এই তিন বিভাগে পড়ার খরচও আলাদা। সবচেয়ে বেশি খরচ সায়েন্স বিভাগে।

এর পর স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের খরচের পরিমাণ বাড়বে ক্রমান্বয়ে। আর যদি চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়র বা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট তৈরি করতে চান কিংবা অন্য কোনও কারিগরী শিক্ষা দিতে চান আপনার সন্তানকে, তাহলে কোর্সের খরচের বিষয়ে খোঁজ খবর করে সেইমতো ব্যয় বরাদ্দ করুন।

জমানোর জন্য শিক্ষামূলক যোজনায় টাকা জমান অথবা রেকারিং অ্যাকাউন্ট-এ টাকা রাখুন। এছাড়া এসবিআই লাইফ চাইল্ড ইনস্যুরেন্স প্ল্যানে বিনিয়োগ করতে পারেন। এরপরও যদি আর্থিক ঘাটতি থাকে, তাহলে এডুকেশনাল লোন নিতে পারেন। উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয় পেপার্স ব্যাংক-এ সাবমিট করে লোনের জন্য আবেদন করুন। এক্ষেত্রে অবশ্য আপনার সন্তানকে মেধাবী হতে হবে এবং ভবিষ্যতে উপার্জনের প্রবল সম্ভাবনা থাকতে হবে।

সরকারি প্রকল্প
ভারতে শিশুদের শিক্ষার জন্য অনেক প্রকল্প রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে সমগ্র শিক্ষা। এই প্রকল্পের লক্ষ্য প্রাক-বিদ্যালয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত শিশুকে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করা। এর লক্ষ্য হল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ তৈরি করা যা সমস্ত শিশুদের চাহিদা পূরণ করে। শিশুদের জন্য পিএম কেয়ারস-ও একটি প্রকল্প, যা কোভিড-১৯ মহামারিতে পিতামাতা বা অভিভাবককে হারিয়েছে এমন শিশুদের আর্থিক সহায়তা, স্বাস্থ্য বিমা এবং স্কুল ও উচ্চ শিক্ষার জন্য সহায়তা প্রদান করে।

এছাড়া সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা, কন্যা সন্তানের পিতামাতার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একটি সঞ্চয় কর্মসূচি। বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও একটি প্রকল্প যা হ্রাসমান শিশু লিঙ্গ অনুপাত (সি এসআর) এবং মহিলা ক্ষমতায়ন সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে আলোকিত করে। ভারতে শিশুদের জন্য অন্যান্য কিছু প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, চাইল্ড হেল্প লাইন (সিএইচএল) ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস (আইসিডিএস) ইম্প্রুভিং ইনফ্যান্ট অ্যান্ড ইয়ং চাইল্ড ফিডিং (আইওয়াইসিএফ) এবং আপকি বেটি হামারি প্রকল্প।