চিন বর্তমানে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ট্রেড পার্টনার। প্রসঙ্গত, ২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ভারতের বৃহত্তম ট্রেড পার্টনার ছিল চিনই। যদিও, বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই স্থান অধিকার করেছে। কিন্তু গত দশ বছরে চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক লেনদেন হয়েছে চারগুন। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ভারত-চিন বাণিজ্যিক লেনদেনের আর্থিক মান ১১২.৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। এই নিয়ে পর পর তিন বছর ভারত-চিনের বাণিজ্য, ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মাপকাঠিকে ছাপিয়ে গেল।
৩০ অক্টোবর কলকাতার পার্ক হোটেলে অনুষ্ঠিত হল ‘ডুইং বিজনেস উইথ চায়না’ শিরোনামে এক বৈঠক। মার্চেন্টস চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এই বৈঠকটি আয়োজন করে। প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতে চিনের রাষ্ট্রদূত শু ফেইহং। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কলকাতায় চিনে কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল শু ওয়েই, রাশিয়ান কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল ম্যাক্সিম ভি কোজলভ, ভুটান কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল তাশি পেঞ্জোর, মার্চেন্টস চেম্বার অফ কমার্সের প্রেসিডেন্ট অমিত সারাওগি, ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপোর্ট কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (ইইপিসি)-র চেয়ারম্যান এবং কোরোনা স্টিল ইন্ডাস্ট্রির ম্যানেজিং ডিরেক্টর অরুণ কুমার গারোডিয়া, মার্চেন্টস চেম্বার অফ কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট মনীশ ঝাঝারিয়া প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরা।
অমিত সারাওগি-র স্বাগতভাষণে ভারত-চিন বাণিজ্যিক সম্পর্কের নানা দিক উঠে আসে। অমিত জানান যে, এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক থেকে লাভ হচ্ছে মূলত চিনেরই। চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক ঘাটতির মান সবথেকে বেশি। ভারতের যে-রপ্তানিকৃত পণ্যদ্রব্য চিনদেশে যায় যেমন, লৌহ আকরিক, তুলো, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, হিরে এবং প্রাকৃতিক রত্ন- সেইসবের উপর নির্ভরশীল পণ্যের বদলে বাজারে জায়গা করে নিয়েছে চিনা যন্ত্রাদি, বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত সামগ্রী, টেলিকমের সরঞ্জাম, জৈব রাসায়নিক এবং সার। মার্কেট অ্যাক্সেসের এই সমস্যার কথা স্পষ্ট করেন তিনি। এছাড়াও তিনি ভিসা সংক্রান্ত অসুবিধার কথাও তুলে ধরেন। ভিসা মঞ্জুর না হওয়ায় ভেন্ডররা প্রযুক্তিগত বাণিজ্যিক সহায়তার জন্য তাদের টেকনিশিয়ানদের পাঠাতে পারেন না। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে চিনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের যে প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে, সেই কথাও উঠে আসে তাঁর বক্তব্যে।
ভারতের সঙ্গে চিনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজের গুরুত্বপূর্ণ মতামত রাখেন রাষ্ট্রদূত শু ফেইহং। তাঁর বক্তব্য, চিন শুধুমাত্র আর বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদন কেন্দ্রই নয়, বরং বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাজারও হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে চিনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ যথেষ্টই উজ্জ্বল বলে তিনি মনে করেন। তিনি জানান, চলতি বছরে চিনের এমব্যাসি এবং কনস্যুলেটগুলো মিলিয়ে ভারতীয়দের মোট ২.৫ লক্ষ ভিসা মঞ্জুর করেছে, যার শতকরা ৮০ শতাংশই বাণিজ্যিক ভিসা। গত তিন বছরে কলকাতা থেকে চিনে পাঠানো মাছ, চিংড়ি ইত্যাদি রপ্তানিকৃত পণ্যের মান প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
চিনদেশের বাণিজ্যিক বাজারের বিপুল সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন ফেইহং। তিনি জানান, ২০২৪ অর্থবর্ষে ভারত থেকে চিনে গোলমরিচ, লৌহ আকরিক এবং তুলোর রপ্তানি যথাক্রমে ১৭ শতাংশ, ১৬০ শতাংশ এবং ২৪০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের উচ্চ গুণমানের পণ্যদ্রব্য চিনের বৃহদাকৃতি বাজারের তাৎপর্য বিশেষ বাড়িয়ে তুলবে, এমনটাই তাঁর ধারণা।
তবে, বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে তাঁর মত নেতিবাচক। তাঁর মতে, চিনে পণ্যদ্রব্যের উপর অধিক পরিমাণে শুল্ক বা নিষেধাজ্ঞা চাপানো নিম্নমুখী (ডাউনস্ট্রিম) শিল্পের উন্নয়ন এবং গ্রাহকদের স্বার্থের পরিপন্থী। তিনি আরও বলেন, পরিকাঠামোগত উন্নতির কাজে ভারত বিশেষভাবে এগিয়ে রয়েছে। এই ক্ষেত্রে চিনের অভিজ্ঞতার ঝুলি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। যদি দুই দেশের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা যায়, তবে সেটা ‘১+১ = ১১’-এর ফল দেবে।
দুই দেশই যাতে একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে পারে, আরও বেশি সুবিধাজনক নীতি নির্ধারণ করতে পারে, তুলনামূলকভাবে কম নিষেধাজ্ঞা জারি করে – এমনটাই আশা রাখেন তিনি। এর ফলে ভারত-চিনের মধ্যেকার অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক নতুন শিখরে পৌঁছবে।
প্রসঙ্গত, এই বৈঠকটি বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিগত বেশ কিছু বছর ধরে ভারত-চিন সীমান্তে (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল/এলএসি) সেনা উপস্থিতির কারণে দুই দেশের সম্পর্ক শীতল হয়েছিল। সম্প্রতি চিন সীমান্ত থেকে সৈন্য অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্রিকস সমাবেশে ভারত এবং চিন যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর নেতৃত্বে আলাদা দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও করেছে, গত পাঁচ বছরে যা প্রথম। এই বরফ গলার পরিস্থিতিতে এই বাণিজ্যিক বৈঠক, দুই দেশের সম্পর্ককে স্বাভাবিক করতে, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উন্নতি ঘটাতে এবং এশীয় অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে বিশেষ সাহায্য করবে, এমনটাই আশা।