• facebook
  • twitter
Sunday, 6 April, 2025

‘মানুষ আর পারফর্মার লগ্নজিতার মধ্যে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে’

লগ্নজিতা চক্রবর্তীর এই এক দশকের জার্নি ঠিক কেমন ছিল? পাওয়া না পাওয়ার অনেক কথাই বললেন লগ্নজিতা একান্ত এই সাক্ষাৎকারে। কথোপকথনে অবন্তী সিনহা।

ফাইল চিত্র

গানের জগতে লগ্নজিতার সাফল্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তাঁর প্রাণবন্ত গায়কি, তাঁকে প্লেব্যাক এবং স্টেজ উভয়ক্ষেত্রেই অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলেছে।

‘বসন্ত এসে গেছে’ এখন বাঙালির বসন্তকালের জাতীয় সঙ্গীতের মতো। এরকম একটা
হিট গান দেওয়ার পর প্রথম অনুভূতিটা কেমন ছিল?

প্রথম অনুভূতিটা সে অর্থে তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না, কারণ আমি ছোটবেলা থেকে ভাবিইনি কখনও যে গান গাইব। ভেবেছিলাম চাকরি করব আর-পাঁচজনের মতো। গান নিয়ে তাই কোনও স্বপ্ন বা অ্যাম্বিশন ছিল না। বরং অ্যাম্বিশন সফল হলে বা কিছু অ্যাচিভ করলে একটা এক্সাইটমেন্ট হওয়ার কথা। কিন্তু একটা হিট গান দেওয়ার অনুভূতিটা বুঝতেই আমার চার-পাঁচ বছর সময় লেগে গিয়েছিল।

আপনার গলার বা গায়কির কোন বৈশিষ্ঠ্যর জন্য অনুপম রায় আপনাকে নির্বাচন করেছিলেন বলে মনে হয়?
এই প্রশ্নটার উত্তর আমার পরিবর্তে মনে হয় অনুপমদা-ই ভালো দিতে পারবেন। তবে একান্তই আমায় যদি জিজ্ঞেস করন, আমি বলব আমার নিজের গলা তো আমি গত তেত্রিশ বছর ধরে শুনছি। আমার নিজের কানে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য সেভাবে ধরা পড়ে না।

স্টেজ পারফর্মেন্স, প্লেব্যাক, সব মিলিয়ে পাবলিক ফিগার হয়ে ওঠা-
জীবনের এই চেঞ্জটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এই গানের জীবনটাকে আমি যে খুব একটা আলাদা করে দেখেছি তা নয়। আমি ছোটবোলা থেকে কোনও দিনই পাবলিক ফিগার হতে চাইনি। আমার রোল মডেল গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। ওঁর মতো বিদগ্ধ মানুষ যদি গড়িয়াহাটের মোড় দিয়ে হেঁটে যান, তাহলে যে শয়ে শয়ে লোক ওনার পেছনে ছুটবে- বিষয়টা এমন তো নয়। কারণ উনি ইন্টেলেকচুয়াল ক্লাসকে রিপ্রেজেন্ট করেন। আমার আইডল ওয়ারশিপ এই ধরনের মানুষদের ঘিরেই ছিল বরাবর। ফলে আমার জীবনেও তেমন কোনও পরিবর্তন হয়েছে বলে আমি মনে করি না।

এখনও অবধি আপনার সেরা তিনটি গান হিসেবে কোনগুলিকে বাছবেন?
আসলে তিনটে গানকে যদি দশ বছরের কেরিয়ার থেকে বেছে নিতে হয়, সেটা খুবই কঠিন। আমার জীবনে পর পর তিনটে সুপারহিট গান হয়েছিল যা ছাড়া আমার কেরিয়ার তৈরিই হতো না। তার মধ্যে অবশ্যই বাছব ‘বসন্ত এসে গেছে’ গানটাকে, কারণ ওটাই আমায় প্রথম পরিচিতি দেয়। তারপরে ‘বিবাহ ডায়ারিজ’ ছবির গান ‘এভাবেই গল্প হয়’ এবং তৃতীয়টা অবশ্যই ‘হৃদয়ের রং’, যেটা ‘ঘরে অ্যান্ড বাইরে’ ছবির গান।

তবে আমি আলাদা করে আমার জীবনের প্রথম প্লেব্যাক ‘অদল বদল’-গানটার কথাও মেনশন করতে চাই। ওটা বাদ দিলে কষ্ট হবে, কারণ ‘অদল বদল’ না গাইলে অনুপমদা (অনুপম রায়) বা সৃজিতদা (সৃজিত মুখোপাধ্যায়) আমাকে খুঁজেই পেতেন না ‘বসন্ত এসে গেছে’ গাওয়ানোর জন্য।

একসময় তো বাঙালি শিল্পীরা দাপিয়ে মুম্বইতে কাজ করেছেন। আপনার মুম্বইয়ে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
আমি ২০১৬ থেকে প্যান্ডেমিকের আগে অবধি মুম্বইতে কাজ করেছি। তবে ওখানে প্লেব্যাক ক্র্যাক করতে পারিনি। কিন্তু প্রায় ৫০-৫৫টা বিজ্ঞাপনের কাজ করেছি। মুম্বইয়ের অভিজ্ঞতা খুবই ভালো। কোনও তুলনায় যেতে চাইছি না। কারণ কলকাতা-মুম্বই দুটো আলাদা শহর এবং দু’জায়গায় দু’রকমভাবে কাজ হয়। আমার দুটো শহরেই কাজ করতে খুব ভালো লাগে। মুম্বইতে কাজ বেশি, টাকা বেশি- কিন্তু সেখানে স্ট্রাগলটাও বেশি। তবে যাঁরা বেশি অ্যাম্বিশাস, আমার মনে হয় তাঁদের জন্য মুম্বই প্রোব্যবলি ইজ আ বেটার সিটি।

তিরিশের আগে হয়তো আমিও কিছুটা অ্যাম্বিশাস ছিলাম তাই আমারও মুম্বই ভালো লাগত। কিন্তু তিরিশের পর আমার মনে হচ্ছে আমার এই সেন্স অফ অ্যম্বিশনটা কিছুটা কমে গেছে। এই মুহূর্তে মুম্বইয়ের ওই সাংঘাতিক স্পিডটা আমার আর ভালো লাগবে কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। সেটা টানা মুম্বইতে থাকলে বুঝতে পারব।

আপনি সদ্য একটি ঠান্ডা পানীয়ের জিঙ্গল গাইলেন। ছবির গান আর জিঙ্গল গাওয়ার ক্ষেত্রে একটা মুডের তফাৎ নিশ্চয়ই হয়। সেটার ক্ষেত্রে কীরকম প্রিপারেশন থাকে?
আমার কাছে গানটা গানই, প্লেব্যাক বা বিজ্ঞাপনে তফাৎ করি না। তবে হ্যাঁ, জিঙ্গলের ক্ষেত্রে অনেক রকম এক্সপেরিমেন্ট করা হয়, বিভিন্ন গায়কি ব্যবহার করার সুযোগ থাকে। প্রত্যেকটা কথা যে গানের মতো করেই গাইতে হবে, সেরকম কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে না জিঙ্গলে। এই ঠান্ডা পানীয়ের জিঙ্গলটাতেই ধরুন আমি কিছুটা জায়গা আ..আ করে, অ্যানিমেটেড কার্টুনের মতো করে গেয়েছি। এটা হয়তো প্লেব্যাকের ক্ষেত্রে করা যেত না।

একটা তিরিশ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে অনেক কিছু বোঝানোর থাকে, প্লেব্যাকের ক্ষেত্রে সেই প্রেশার থাকে না। কারণ সেটা একটা দু-আড়াই ঘন্টার সিনের অংশ, যেখানে গানটাও তিন মিনিটের। ফলে অনেকটা স্পেস পাওয়া যায় বোঝানোর। বিজ্ঞাপনে ওয়ে অফ এক্সপ্রশনটাই আলাদা। উচ্চারণ অনেক বেশি স্পষ্ট হতে হয়, অ্যানিমেশন থাকে ফলে অনেক সাটল এক্সপ্রেশন দিয়ে গাওয়ার প্রয়োজন হয়।

পারফর্মার লগ্নজিতা আর মানুষ লগ্নজিতার মধ্যে কী তফাৎ আছে বলে মনে করেন?
আমার আগের ‘আমি’র সঙ্গে হয়তো কিছুটা তফাৎ হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিতে দশ বছর হয়ে গেছে, আমার বয়সটাও যেহেতু বেশ খানিকটা বেড়ে গেছে, ফলে সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে, আমাকেও এখন অনেক মিথ্যে বলতে হয়। আমি আগে অনেক কথাই স্টেজে উঠে বলতাম, যেগুলো আজকাল আর বলি না। আজ থেকে দশ বছর পর হয়তো আরও কম বলব। মানুষ আর পারফর্মার লগ্নজিতার মধ্যে আজকাল একটা পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে। বয়স এবং অভিজ্ঞতা আমায় শিখিয়েছে, যা মনে হচ্ছে তা আমি বলতে পারি না স্টেজে দাঁড়িয়ে। কারণ সেখানে একসাথে পঁচিশ-তিরিশ হাজার মানুষ শুনছেন। সুতরাং আমার কাছে যেটা সত্যি, সেটা আমি স্টেজে উঠে বলে দেব- এমনটা করা যায় না।

এখনও পর্যন্ত জার্নিতে কোনও কিছু নিয়ে কোনও রিগ্রেট কাজ করে ?
না এতদিনের জার্নিতে আমার প্রফেশনালি কোনও রিগ্রেট নেই। আমি বেশ খুশি। তবে এই জার্নিতে আমার পার্সোনাল লাইফটা খুবই অ্যাফেক্টেড হয়েছে। আমি এই দশ বছরে আমার পরিবার থেকে হয়তো অনেকটা দূরে সরে গেছি। যে-কোনও উৎসবের দিনেই আমার কাজ থাকে। মানুষের যখন দুর্গাপুজো কালীপুজো, ক্রিসমাস বা নিউ ইয়ার, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান- সেই দিনগুলোতেই আমি কাজ করি। ফলে আমার শ্বশুরবাড়ি এবং বাপের বাড়ি দু’জায়গা থেকেই আমার একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। তাঁরা চেষ্টা করেন পারিবারিক অনুষ্ঠানে যাতে আমিও যোগদান করতে পারি, কিন্তু আমার কিছুতেই সেই অবকাশ হয় না। এটার কারণেই বোধহয় শিল্পীরা আস্তে আস্তে একা হয়ে যান।

আজকাল দুশ্চিন্তা হয়, আমি যখন বৃদ্ধ হব, তখন আদৌ কাউকে পাব কিনা আমায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কারণ বাকিদের যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি হয়েছে, আমি তো তখন যেতে পারিনি। কাজ করছিলাম অন্য কোনও শহরে! এই রিগ্রেটটা থেকে গেছে। এটা মনে হয় আমাদের মতো প্রফেশনে সবারই থাকে।