পুরনো বাংলা কমেডি ছবির নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে, বেদম হাসির হিড়িকে যাঁর সংলাপ মনে করে বাঙালি- তিনি হলেন অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতো দক্ষ অভিনেতা কমই পেয়েছে বাংলা ইন্ডাস্ট্রি। ‘আশিতে আসিও না’, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’, ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’, ‘ভানু পেল লটারি’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’— এক কথায় অবিস্মরণীয় সব ছবি!
সময় পালটেছে, কিন্তু বাঙালির মননে আজও এক টুকরো দ্বীপের মতোই, সুখস্মৃতি হয়ে জেগে আছে অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। ১০০ পেরনো এই কিংবদন্তি অভিনেতাকে জীবন্ত করে তুলতেই যেন, তাঁর আগমন হচ্ছে ‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’ নামের একটি ছবির মধ্যে দিয়ে। এই ছবিতে ভানু অভিনীত মাইলস্টোন ছবিগুলির দৃশ্যও যেমন থাকবে, তেমনি তাঁর সমকালীন অভিনেতাদের স্মৃতিও রঙিন হয়ে উঠবে পর্দায়। নামভূমিকায় অর্থাৎ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রে দেখা যাবে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে।
ভানুর মুখের সঙ্গে এক আশ্চর্য সাদৃশ্য তো রয়েছেই শাশ্বতর, কিন্তু পুরোপুরি তাঁকে পর্দায় ‘জীবন্ত ভানু’ করে তুলেছেন জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত মেকআপ আর্টিস্ট সোমনাথ মন্ডল। সম্প্রতি এই ছবির গান রিলিজ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় শেয়ার করলেন ‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’ প্রসঙ্গে তাঁর কিছু কথা।
ভানুবাবুর চরিত্রটা করার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন ?
উত্তর: প্রস্তুতি ছোট থেকেই চলছে, কারণ এঁদের দেখেই তো বড় হয়েছি। যেসব সাদা-কালো ছবি দেখতাম, তাতে তো এনারাই থাকতেন বেশির ভাগ সময়ে। কাজেই রক্তে ঢুকে গিয়েছিল। ছোট থেকেই ভানুবাবুকেকে নকল করতাম, সেটাই কাজে লাগল আর কী।
পারিবারিকভাবে আপনাদের সঙ্গে উনি তো খুবই অন্তরঙ্গ ছিলেন। কোনও ব্যক্তিগত স্মৃতি ?
উত্তর: একটা ঘটনা মনে আছে, একবার ওঁনার একটা শুটিং দেখতে গিয়ে আমি টেক-এর মাঝখানেই সশব্দে হেসে ফেলেছিলাম। শট-টা কাটতে হয়েছিল কারণ ডাইরেক্ট সাউন্ড ছিল। সেটা নিধিরাম সর্দার নামের একটা ছবির শুটিং। পরে উনি আমার সঙ্গে আলাদা করে একটা ছবিও তুলেলেন এবং বললেন ‘শুয়োরের বাচ্চাটা প্রমাণ করল আমার সিনটা হাসির হয়েছে।’ আসলে আমার বাবাকে উনি স্নেহবশত শুয়োর বলে সম্বোধন করতেন। সেই সূত্রে আমার ওই বিশেষণ জুটেছিল। এমনই মজার মানুষ ছিলেন ভানুবাবু।
এই ধরনের বায়োগ্রাফিকাল ছবির ক্ষেত্রে আলাদা কোনও চাপ কাজ করে কি?
উত্তর: এই ছবিটায় আমার অভিনয় করার একটা বিশেষ কারণ আছে। ওঁনার বাড়ির লোক চেয়েছিলেন নামভূমিকায় আমিই অভিনয় করি। ফলে একটা দুশ্চিন্তা তো ছিলই যে, আমি চরিত্রটার প্রতি জাস্টিস করতে পারব কিনা। একটা প্রাইভেট স্ক্রিনিং হয়েছে যেখানে আমরা ছবিটা ভানুবাবুর ছেলে এবং মেয়েকে দেখাতে পেরেছি। ওঁরা ওটা দেখে খুবই খুশি হয়েছেন, তাই কিছুটা নিশ্চিন্ত লাগছে।
সময়ের সঙ্গে তো সেলুলয়েডে কমেডিরও চরিত্রবদল হয়েছে। বাংলা ভাষায় কমেডি ছবি কতটা এখনকার ছেলেমেয়েদের স্পর্শ করবে কি? উঃ এটা আমার মনে হয় অনেকটাই নির্ভর করছে এখনকার অভিভাবকদের উপর। এই প্রজন্ম যে বাংলা ভাষা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, তার জন্য দায়ী আমার মতে এখনকার বাবা-মায়েরা। অভিভাবকদের দায়িত্ব, তাঁরা নিজেরা যা দেখেছেন ছোটোবেলায়, সেটা এই প্রজন্মকে দেখানোর। আমার মেয়েকে আমি ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’ থেকে ‘নায়ক’ বা ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’— সবই দেখিয়েছি। বদল তো থাকবেই, তাই বলে আমরা ঐতিহ্য কেন ছেড়ে দেব! একটা বাড়ি কিন্তু তার পুরনো ভিতের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে।
তবে বর্তমানে কমেডি জিনিসটা আমাদের জীবন থেকেই লোপ পাচ্ছে কারণ আমাদের বেঁচে থাকাটা আর অতটা সিম্পল নেই।
ক্যালকুলেশনের কাছে ইমোশন হেরে যাচ্ছে। সেটাই ফেরানোর চেষ্টা করা হয়েছে এই ছবিতে।
‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির সংলাপ ‘মাসিমা মালপো খামু’ আজও বাঙালির মুখে মুখে ঘোরে। এই সংলাপ কি রাখা গেছে ছবিতে?
উত্তর: না, দুঃখের বিষয় কপিরাইটের চক্করে হবহু একই সংলাপ আমরা ব্যবহার করতে পারিনি। ‘মাসিমা’র বদলে ‘পিসিমা মালপো খামু’ করা হয়েছে ছবিতে। একটি বহুল জনপ্রিয় গান ইচ্ছে থাকলেও রিক্রিয়েট করা যায়নি এই কপিরাইট ইশ্যুতে। তবে একটা সিকোয়েন্স রাখা হয়েছে যেখানে ভানুবাবু, শাশ্বতকে শুয়োরের বাচ্চা বলে সম্বোধন করছেন। এটা বাবার কাছ থেকে শোনা একটা ব্যক্তিগত ঘটনা।
একটা সিরিয়াস চরিত্রে অভিনয় নাকি কমেডি চরিত্র করা, আপনার কোনটা বেশি চ্যালেঞ্জিং মনে হয় ?
উত্তর: আমার কাছে আজও যে-কোনও ছবির প্রথম দিনের শুটিং চ্যলেঞ্জিং। এখনও প্রথম দিন শটের আগে ভীষণ টেনশন হয়। আমাদের অভিনেতাদের সবরকম ভূমিকাতেই অভিনয় করতে হয়। ফলে একবার চরিত্রটায় ঢুকে গেলে, তখন আর চ্যালেঞ্জিং মনে হয় না।