নানা আঙ্গিকে ভালোবাসার বন্ধন, মন ছুঁয়ে যায়

প্রীতম সেনগুপ্ত
এই অদ্ভুত প্রেমহীনতার সময়ে প্রেম নিয়ে ছবি করলেন পরিচালক অর্ণব মিদ্যা৷ এই ‘প্রেমের মরশুমে’ যেটি সম্প্রতি মুক্তি পেল৷ প্রথমেই বলে রাখা ভালো পরিচালক এই ছবিতে যে ভাবনা ও ভঙ্গিতে ছবিটির উপস্থাপনা ঘটিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে ভিন্ন স্বাদের এবং ভালো লাগার৷ তিনটি গল্পের সমাহারে গোটা ছবিটি এবং প্রতিটি স্বতন্ত্র গল্পে পরিচালক ভালোবাসা ও বন্ধনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটকে দর্শকদের সামনে হাজির করেছেন৷ ছুঁতে চেয়েছেন মানুষের ভিতরকার চিরাচরিত ভালোবাসার বন্ধনকে৷ প্রেম মানে শুধু প্রাপ্তবয়স্ক দুই নর-নারীর প্রেম, এই যে চিরাচরিত ধারণা, তার থেকে বেরিয়ে এসে তিনি বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন আরও বৃহৎ পরিসরে৷ প্রথম গল্পটির মূল চরিত্র নরেন এবং সুলক্ষণা৷
প্রেক্ষাপট স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল ভারতবর্ষ তথা এই বাংলা৷ পুলিশের তাড়া খেয়ে ঘটনাচক্রে বিপ্লবী নরেন এসে হাজির হয় সুলক্ষণার বাডি়তে৷ ব্রিটিশ পুলিশ উন্মত্ত কুকুরের মতো তাকে খুঁজছে, দেখতে পেলেই গুলি করে মেরে দেবে, এমন একটা অবস্থা৷ নরেন আশ্রয় ভিক্ষা করে সুলক্ষণার কাছে৷ নিতান্ত যুবতী গৃহবধূ সুলক্ষণা স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও তরুণ নরেনকে আশ্রয় দেয়৷ শুধু আশ্রয় নয় সেদিন রাত্রে তার আহারের বন্দোবস্ত করে সুলক্ষণা৷ এর মধ্যে পুলিশ এসে তল্লাশি চালিয়ে যায় তার বাডি়তে, কেননা তারা এক স্বদেশীকে খুঁজছে এবং এখান দিয়েই সে পালিয়েছে৷ ছাদেও যায় পুলিশ, সেখানেও খুঁজে পায় না স্বদেশীটিকে৷ অথচ ওই ছাদেই সেই রাতের মতো নরেনের থাকার বন্দোবস্ত করে সুলক্ষণা৷ তাঁর জন্য থালায় খাবার বেডে় নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ হাজির! শেষমেশ অবশ্য পুলিশের হাতে ধরা পরে না নরেন৷ দেশকে ভালোবেসে ঘরছাড়া নরেন সুলক্ষণার সঙ্গে ক্রমশ আলাপচারিতায় মগ্ন হয় এবং এই আলাপচারিতা থেকে হাতে পিস্তল নিয়ে ঘোরা নরেন অনুভব করতে পারে সহিংস আন্দোলনের রাস্তা থেকে সরে গিয়ে গান্ধীজীর প্রদর্শিত অহিংস আন্দোলনের পথই শ্রেয়৷ তার এই মানসিক রূপান্তরটি ঘটায় সুলক্ষণা৷ কেননা সুলক্ষণার স্বামীও তারই মতো একজন বিপ্লবী এবং এই স্বামীর পথ চেয়ে সে সারাদিন বসে থাকত একদিন৷ পুলিশের গুলিতে মৃতু্য হয় সুলক্ষণার বিপ্লবী স্বামীর৷ যদিও ঘটনাচক্রে নরেনের আর বেঁচে থাকা হয় না, সেও পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায়৷ এরই মধ্যে কাহিনীর নানা নাটকীয় মোড় দর্শককে উদ্বেল করে তোলে৷ একদিকে দেশপ্রেম অন্যদিকে ঘরছাড়া মানুষের প্রতি ঘরের মানুষের টান এই দুই বন্ধন গল্পটিতে টানটান ভাবে উঠে এসেছে৷ সুলক্ষণার ভূমিকায় সৌরসেনী মৈত্র এবং নরেনের ভূমিকায় অর্ণ মুখোপাধ্যায় যথাযথ৷ অন্যান্য ভূমিকায় রয়েছেন সবুজ বর্ধন, উপাবেলা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ৷
দ্বিতীয় গল্পটি তিন বন্ধুর গল্প৷ ৩০ বছর পর যাদের দেখা হল৷ এক জটিল ত্রিকোণ সম্পর্ক তাদের বন্ধুত্বের ভিতর সাময়েক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করলেও, বন্ধুত্বের টান যে ফল্গু ধারার মতো প্রবাহিত হচ্ছিল তা দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর সম্যকভাবে উপলব্ধ হয়৷ অগ্নি (দেবশঙ্কর হালদার), বরুণ (খরাজ মুখোপাধ্যায় ) ও ইন্দ্র (জয় সেনগুপ্ত ) বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত৷ প্রথমজন পেইন্টার, দ্বিতীয়জন লেখক ও তৃতীয়জন চিত্র পরিচালক৷ দীর্ঘদিন পরে তারা যখন একত্রিত হল তখন এইসব পেশাগত বিশেষণের খোলস ছেডে় বেরিয়ে এসে বন্ধুত্বের নিবিড় আবেশে সময় যাপিত হতে থাকল৷ কলকাতার কাছেই একটি হলিডে রিসর্টে খোলামেলা প্রকৃতির মাঝে তিন প্রৌঢে়র পুরানো সেই দিনের কথা দর্শকদের ভালো লাগবে৷ রয়েছে গানও৷ এর শেষ পর্বে পরিচালক এক অদ্ভুত নাটকীয়তায় দর্শককে চমকে দেন৷ জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া যেন৷ তিন বন্ধুর চরিত্রাভিনেতা হিসেবে দেবশঙ্কর (হালদার )ও খরাজ (মুখোপাধ্যায়) কে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই৷ জয় সেনগুপ্তও মানানসই৷
তৃতীয় গল্পটি পারিবারিক বন্ধনের, সন্তানের প্রতি বাবা-মা’র অকৃত্রিম ভালোবাসার৷ এক গ্রামের ছেলে৷ ডাক্তার হয়ে শহরে এল এবং সেখানে তার ডাক্তার হিসেবে নাম হল৷ বিয়ে করল এক শহরের মেয়েকে৷ তাদের একটি কন্যাও রয়েছে৷ এই ছেলেটি গ্রাম থেকে বাবা-মাকে আর তার কাছে শহরে নিয়ে আসে না৷ তাঁর স্ত্রী শহুরে মহিলা, গ্রামে থাকা মানুষেরা কাছে থাকলে স্ট্যাটাসে ধাক্কা লাগবে৷ কিন্ত্ত ছেলের জন্মদিনে আগাম না জানিয়েই গ্রামে থাকা বাবা-মা উপস্থিত হন পুত্রের বাডি়৷ জন্মদিনের উপহার এক বয়াম ভর্তি নাড়ু৷ সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের চিরন্তন ভালোবাসা! এই গল্পের শেষাংষটিও চমকে দেয় দর্শককে৷ বাবা-মায়ের ভূমিকায় ( রামকৃষ্ণ ও সারদা) পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, লিলি চক্রবর্তী৷ পুত্র, পুত্রবধূ ও নাতনির  ভূমিকায় যথাক্রমে জিতু কমল, সায়ন্তনী গুহ ঠাকুরতা ও পৃথা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ প্রসঙ্গত শিশুশিল্পী পৃথা বর্ষীয়ান অভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রিয়াল লাইফ নাতনিও৷ একটি ছোট চরিত্রে রয়েছেন অবন্তিকা বিশ্বাস৷ স্যাণ্ড আর্ক মিডিয়া প্রযোজিত এই ছবিটির সঙ্গীত বেশ ভালো৷ মিউজিক ও ব্যাক গ্রাউণ্ড মিউজিক পরিচালনা করেছেন রণজয় ভট্টাচার্য৷ সঙ্গীতশিল্পীরা হলেন —  নচিকেতা চক্রবর্তী, লগ্নজিতা চক্রবর্তী, খরাজ মুখোপাধ্যায়, শাওনি মজুমদার, নিষ্ঠা সিনহা এবং রণজয় ভট্টাচার্য৷ ছবির নাম ‘সেদিন কুয়াশা ছিল’ কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে পরিচালক জানান, প্রত্যেক সম্পর্কের মধ্যে একটা কর্তব্যের জায়গা থাকে, আবার কর্তব্য পালন করতে না পারার গ্লানিও আছে৷ পালন করতে পারা বা না পারার কারণও খুঁজে পাওয়া যায় না অনেক সময়৷ বিষয়টি কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে৷ তাই কুয়াশা শব্দটি, আর বিশেষ কোনও দিনের ঘটনা বলে, সেদিন কুয়াশা ছিল, এই নামকরণ৷