‘নজরুল সঙ্গীত’ সুরের ধারা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

ড: দীপা দাস
দুই বাংলায় দুই রুপ, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্যায়ে একই নজরুল সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটতো বা এরকম ধারনা করা হত৷ নজরুলগীতির ভবিষ্যত পশ্চিমবঙ্গে- এই বিষয়ে সাধারণত অনেক গবেষণা হয়েছে এবং আলোচনা ও সেমিনার হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গে বহু নবীন শিল্পীর কণ্ঠে যা শোনা যায়, তা নজরুল ইসলামের মূল সুরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ শোনায় না৷ এমনকি রাগ, মাত্রা, তালেরও পরিবর্তন ঘটেছে৷ আধুনিক বাংলা গান আর নজরুল সঙ্গীত এক নয়৷ একথা ঠিক সেই সময়ে কবির গানকে আধুনিক গান বলা হতো কিন্ত্ত আধুনিক গান নামে পরিচিত গানের সঙ্গে নজরুলগীতির কি তফাৎ সে কথা কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই বলে গেছেন, তাঁর ‘সুর, ও শ্রুতি’ প্রবন্ধে৷ সম্পূর্ণ নিজের স্বার্থসিদ্ধি বা পেশার জন্য কবি ঘনিষ্ঠ বা ট্রেনার  আধুনিক গানের দিকে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত করে কবির হূদয়ে আঘাত করেছেন৷ এই জন্য তিনি  আক্ষেপ প্রকাশ করে  লিখেছিলেন- ‘দেখ আমি তোমাদের হাতে আমার সৃষ্টিকে দিলাম যদি পারো এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে তাহলে ততটুকুই করবে, এর বিকৃত রুপ না হয়৷ কবি স্নেহধন্য বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের একটি লেখায় জানা যায়, কবি নজরুল তাঁর গানের সুর ও গায়কী বিষয়ে এই বলতেন৷ নজরুল সঙ্গীত গাওয়ার জন্য উপযুক্ত হতে হবে৷ তার কারণ কন্ঠ সাধনা- রাগ পরিচয় ছাড়া নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করা সম্ভব নয়৷

কবি নিজে অসংখ্য শিল্পীকে ট্রেনিং করিয়েছেন, গানও রেকর্ডিং করিয়েছিলেন৷ যেমন আঙ্গুরবালাদেবী, ইন্দুবালাদেবী, কমলা ঝরিয়া, কে মল্লিক, ধীরেন দাস, শৈলদেবী, ইলা ঘোষ, রাধারাণীদেবী, যূথিকা রায়, দীপালি তালুকদার, কমল দাশগুপ্ত, সুধীরা দাশগুপ্ত, সত্য চৌধুরী, রঞ্জিত রায়, বিমল গুপ্ত, হরিমতিদেবী, আব্বাস উদ্দিন আহমদ, আশ্চর্যময়ী দাসী, অনিমা বাদল, মিস্ লাইট, মানিকমালা, মৃনালকান্তি ঘোষ, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়, নিতাই ঘটক, সুপ্রভা সরকার, বেচু দত্ত, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, মড কস্টোলা, কানন দেবী, প্রমোদা দেবী, সিতারা দেবী প্রমূখ৷ আকাশবাণী ও গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য কবিকে প্রয়োজনে সহকারী বা ট্রেনারের সাহায্য নিতে হয়েছিল৷ তাঁর অন্যতম শিষ্য নিতাই ঘটক ১৯৯৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মারা যান৷ এছাড়াও ছিলেন ধীরেন দাস, কমল দাশগুপ্ত, চিত্ত রায়, জগৎ ঘটক, গিরিণ চক্রবর্তী, মনোরঞ্জন সেন, আব্বাস উদ্দিন আহমদ প্রমুখ৷ শিল্পীদের মধ্যে উৎসাহ প্রদান করতে প্রয়োজনে মূল গানকে অক্ষত রেখে কিছু রঙ লাগাতে পারতেন ট্রেনারগণ৷ কিন্ত্ত পরবর্তীতে দেখা যায় আকাশবাণী ও দূরদর্শনে গাওয়ার সময় অনেকেই নজরুলের মূল সুর থেকে বিচু্যত হয়েছিলেন৷ অথচ ষাটের দশকেই এব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে নজরুল গবেষক, ভক্ত, অনুরাগী, শিষ্য-শিষ্যারা সরকারের তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে স্মারকপত্র ও আবেদন জমা দিয়েছিলেন৷ খুব দুঃখের বিষয় তখন বা এখনও কেউ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি৷

উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছিল রাজ্য সঙ্গীত একাডেমি তখন গঠিত হলেও তারা কিন্ত্ত এর শুদ্ধতার প্রশ্নে উদাসীন ছিলেন৷ কতৃপক্ষের তেমন সহযোগিতা বা সাড়া কোনোদিনই পাওয়া যায়নি৷ নজরুল গবেষক কল্পতরু সেনগুপ্তের বই থেকে সবিস্তারে এই তথ্য পাওয়া যায়৷ বাংলা ভাষা যেমন দুই বাংলার তেমন নজরুলও দুই বাংলার সেটা স্মরণে রেখে ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ থেকে একটি প্রতিনিধি দল কলকাতায় এসেছিলেন৷ নজরুলগীতি ও নজরুল চর্চা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং পশ্চিমবঙ্গে নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষকদের মত বিনিময় করতে৷ দুই বাংলায় নজরুল চর্চায় সমন্বয় সাধনেও পারস্পরিক সহযোগিতায় তাঁরা উদ্যোগী হয়েছিলেন৷ নজরুল চর্চা সম্পর্কে অবহিত হওয়া, দুই বাংলার পারস্পরিক সহযোগিতায় কিভাবে নজরুল ইসলামের সব গান ও সুর উদ্ধার করা যায় তার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়৷ তাঁরা বাংলাদেশে নজরুল চর্চা, প্রকাশনা, গবেষণা ও অন্যান্য কার্যক্রম এবং ভবিষ্যত কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন৷ এই প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে ছিলেন নজরুল গবেষক অধ্যাপক করুনাময় গোস্বামী এবং প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন রিজিয়া আহমদ, সেকান্দর শওকত হোসেন, বেগম নাসরিন নাহার, মোখলেছুর রহমান প্রমুখ৷ ওনারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন৷ নজরুল স্মৃতি রক্ষার্থে এই কাজটি  সব থেকে বেশি প্রয়োজন ছিল৷ সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে আলোচনা করার পর সিদ্ধান্তগুলি যদি কার্যকর করা এবং চর্চা বিনিময় চালু রাখা সম্ভব হতো তাহলে নজরুল সঙ্গীত চর্চায় বর্তমান সময়ের শিল্পীদের বিভ্রান্তীকর এই পরিস্থিতির মধ্যে পরতে হতো না৷ একারণেই বর্তমান সময়ে কিছু গানের সুর বদল ও বিকৃতি আমরা দেখতে পাচ্ছি বা একটি গানে দুটি সুরের উদ্ধার৷ একথা ঠিক কবি সুস্থ অবস্থায় একটি গানকে দুবার রেকর্ড করিয়েছেন৷ কখনো নিজে সুর দিয়েছেন এবং অন্যান্যকে দিয়ে রেকর্ড করিয়েছেন৷


কিন্ত্ত বর্তমানে প্রায় তিন-চারশো গানের সুর বদলে গেছে কিন্ত্ত সেই সুরের আসল তথ্যের কোনো প্রমাণ নেই৷ সাধারণত রাগ ভিত্তিক সঙ্গীত বা লোকসঙ্গীতে তেমন পরিবর্তন ঘটেছে এমনটি নয়৷ ১৯৯৫ সাল থেকেই যদি দুই বাংলা এক হয়ে নজরুল নিয়ে সঠিক চর্চা করা সম্ভব হত তাহলে আজ বর্তমান সময়ে নজরুল সঙ্গীত চর্চায় পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরা আরও উৎসাহিত হতো৷ সঠিক সুর ধরে রাখা যদি সম্ভব হতো   দুই বাংলার শিল্পীরা আরো উৎসাহিত হতেন৷ মূল সুর নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন নজরুল গবেষক ব্রহ্মমোহন ঠাকুর৷ তিনি পশ্চিমবঙ্গে কবির জন্মস্থান চুরুলিয়া ও বিভিন্ন জায়গায় থেকে অরিজিনাল গান, সুর, অপ্রকাশিত লেখা সংগ্রহ করে বাংলাদেশের নজরুল গবেষকদের দিয়ে সাহায্য করেছেন৷ সম্প্রতি ব্রহ্মমোহন ঠাকুরের পরিবারের কাছে শেষ চিঠিতে তা লিখেছিলেন সুধীন দাশ৷

উল্লেখযোগ্য এই যে, নয়ের দশকের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে নেওয়া কিছু তথ্য বা দৃষ্টান্ত জানাতে চাইছি৷ পশ্চিমবঙ্গে এক উল্লেখযোগ্য দিক নজরুলগীতি নির্ভর নৃত্য রুপায়ণ৷ সম্প্রতি একশো বছরের বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ ও ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ কবিতার নৃত্য রুপ, ‘কথাকলি’ নৃত্যের অনুসরণ দিয়েছিলেন বিখ্যাত শিল্পী শম্ভু ভট্টাচার্য্য৷ কবি নজরুল ইসলামের প্রকৃতি পর্যায় থেকে ঋতু সঙ্গীত অবলম্বনে নৃত্য রুপায়ণ করেছিলেন, বিখ্যাত ওডি়শী নৃত্য শিল্পী পৌষালী মুখোপাধ্যায়৷ নজরুল সঙ্গীতের সঙ্গে কত্থক নৃত্য শৈলী নিয়ে রুপায়ণ করেছিলেন বিখ্যাত নৃত্য শিল্পী ও রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেলা অর্নব৷ নজরুল সৃষ্ট নবরাগ থেকে রেকর্ড ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র অনবদ্য৷ বিংশ শতাব্দীর নয়ের দশক নজরুল সঙ্গীত চর্চা অন্য রুপ নিয়েছিল কিন্ত্ত সমস্যা হয়েছে শ্রদ্ধাশীল প্রকৃত মানুষের অভাবে সঠিক রাস্তা পাওয়া যায়নি৷ এখন নজরুল সঙ্গীত চর্চা কেন্দ্র স্থল সীমান্তের কাঁটাতারের এপার – ওপার৷

নজরুলের জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গ ও তাঁর প্রকৃত উত্তরাধিকারী দুই বাংলায় ছডি়য়ে, তাঁর অগণিত ভক্ত বিশ্বজুডে় এবং সেই সমস্ত শ্রোতাদের কান ও চোখ চাতক পাখির মত৷ তাদের মনে আতঙ্ক ছডি়য়েছে সঠিক সুর পাওয়া নিয়ে৷ এর মধ্যে সোশ্যাল নেটওয়ার্কস, চ্যানেল ইউটিউব কিছুটা হলেও স্বস্থি দিয়েছে যে এখানে খুঁজলে কিছু না কিছু পাওয়া যায়৷ সঙ্গীত গুরুমুখী বিদ্যা, শিল্পীরা গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল৷ তাঁরাই সত্য ও তথ্য ইতিহাস কে বহন করেন৷ গবেষণার উপর গবেষণা অর্থাৎ পূনঃ পূনঃ চর্চা করার চেষ্টা, নজরুল চর্চাকে বর্তমান থেকে সুদুর প্রসারী ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে৷ তাই নজরুল সঙ্গীতের উপযুক্ত শিক্ষণ শিবির করে তার আসল রূপ জনসাধারণ বা শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব সবাইকে নিতে হবে বিশেষত সরকারকে তাতেই আমরা সবাই সমৃদ্ধ হব এবং নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সেটাই হবে উপযুক্ত৷ তাহলে ‘কারার ঔ লৌহকপাট’ গানের মত আর বিতর্ক ঘটবে না৷