সিনেমা ও সিরিয়ালের দুনিয়ায় বর্তমানে যে সকল প্রবীণ অভিনেতা অপরিহার্য, পার্থসারথি দেব তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য৷ বিগত কয়েক দশক ধরে অভিনয়গুনে দর্শক মনে নিজের জায়গাটা আজও অটুট রাখতে পেরেছেন এই বিনয়ী ও নিপাট ভদ্র অভিনেতা৷ দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার পক্ষ থেকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারের জন্য যোগাযোগ করা হলে তিনি তাঁর ব্যস্ত সময়ের মধ্যেই দৈনিক স্টেটসম্যানের প্রতিনিধি নিশীথ সিংহ রায়কে ডেকে নিলেন তাঁর টালিগঞ্জের আবাসনে৷ এনটিওয়ান স্টুডিও থেকে সামান্য দূরে অভিনেতার ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেলাম শীতের এক বিকেলে৷ দরজার বেল বাজাতেই অভিনেতা নিজে দরজা খুলে হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানালেন৷ ড্রইংরুমে বসে আলোচনা শুরুর আগে জেনে নিলেন চা না কফি কোনটা পছন্দ৷ ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে শুরু হলো অভিনেতার সাথে আলোচনা৷
প্রশ্ন : পার্থবাবু, আপনি কি বরাবরই কলকাতার বাসিন্দা?
পার্থসারথি: হঁ্যা, আমার জন্ম উল্টোদাঙা স্টেশনের কাছের এক পাড়াতে৷ বড়ো হয়ে ওঠা ওখানেই৷ ছোটো থেকেই আমাদের পাড়ায় নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটকের চল ছিল দেখেছি৷ সে কারণে নিজের অজান্তেই নানা রকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছোটো থেকেই জডি়য়ে পডে়ছি৷ পাড়ার বন্ধুদের সাথে মিশে নাটকের মহড়া দেওয়া, মঞ্চস্থ করা একটা নেশার মত হয়ে গিয়েছিল৷ সে সময়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের নানান ধরনের শিল্পীরা ট্রেনে করেই কলকাতায় আসতেন৷ অনেক সময়ই তারা ট্রেনের টিকিট না থাকার কারণে শিয়ালদহে না নেমে আগের স্টেশন উল্টোডাঙায় নেমে পড়তেন৷ তারপর নানা পথে মধ্য কলকাতায় পৌঁছাতেন৷ এই সময় এই সব শিল্পীদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ঘটায় রামযাত্রা ,শীতলা যাত্রা গম্ভীরা এই সব লোকশিল্পের ধারার সাথেও পরিচয় ঘটে৷ যেটা পরবর্তী সময়ে আমাকে অভিনয় জীবনে অনেক রসদ যুগিয়েছে৷
প্রশ্ন: তার মানে ছোটো থেকেই অভিনয়ের জডি়য়ে পডে়ছিলেন?
পার্থসারথি: একদম তাই৷ তবে সাথে খেলাধুলোটাও কিন্ত্ত বাদ যায়নি৷ খেলার প্রতিও একটা ভালোবাসা ছিলই৷ বিশেষ করে ফুটবল৷ আমি নিজেতো খেলতামই, আবার ছোটোদের উৎসাহ দেবার জন্য তাদেরকে স্টাইপেন্ড দিতাম৷
প্রশ্ন: সেটা কি রকম?
পার্থসারথি: আমাদেরকে বাবা মা বাডি় থেকে হাত খরচের জন্য যে টাকা দিতেন তার থেকেই বাঁচিয়ে ছোটদেরকে আমরা স্টাইপেন্ড দিতাম পঁচিশ টাকা করে৷ আমরা একটা ফ্রী কোচিং সেন্টারও করেছিলাম৷ সেটার পক্ষ থেকেই এসব করা হতো৷ পাশাপাশি রানার শিল্পীসংস্থা একটা দল গডে় আমাদের নাটকের অনুশীলন ও বিভিন্ন জায়গায় অভিনয় করার ব্যাপারটা চলতে থাকে৷ সেটা ধরুন ওই ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল নাগাদ৷
প্রশ্ন: তখন আপনার বয়স কেমন ছিল?
পার্থসারথি : ওই ধরুন আঠারো উনিশ হবে৷ আমার কলেজ জীবনের প্রথম দিকে৷ এভাবেই নাটক করতে করতে ১৯৭৭ সাল নাগাদ মঞ্চস্থ করি আলবার্ট ক্যামুর ক্যালিগুলা৷ এভাবেই চলতে চলতে ১৯৭৯ সাল নাগাদ ঠিক করলাম এভাবে সখের অভিনয় করলে চলবে না৷ পেশাদার হতে হবে৷ অভিনয় করে উপার্জন করতে হবে৷ বাডি়তে জানালাম৷ একটু ভয় তো ছিলই বাবার বকুনি খাওয়ার৷ তবুও বাবার হাতের নাগালের বাইরে দাঁডি়য়ে একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম মনের ইচ্ছের কথা৷ বাবা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললেন ‘ঠিক আছে অন্তত নিজের হাত খরচের টাকাটাও যদি নাটক করে জোগাড় করতে পারো, করে দেখো৷ খাওয়ার খরচ আর মাথার উপর ছাদ নিয়ে আমি আছি তোমায় ভাবতে হবে না’৷ সেই থেকে পেশাদার অভিনেতার জীবন শুরু৷
প্রশ্ন: এই পেশাদার অভিনেতার জীবনটা কোন দল থেকে শুরু আপনার?
পার্থসারথি : আমরা নিজেরাই কয়েকজন মিলে প্রথমে পরিবেশ বলে একটা দল গডে় তুলি৷ সেখানে কিছুদিন অভিনয় করার পর প্রোফাইল বলে একটা দলে যোগ দেই৷ সেখানেও কিছুদিন থাকার পর প্রয়াস বলে আরেকটা দলে নাটক করতে শুরু করি৷ দলে ছিলেন নাট্যকার ও পরিচালক বিদু্যৎ নাগ৷ আজ উনি নেই আমাদের মাঝে৷ কিন্ত্ত ওনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি৷ ওনার দাদা ছিলেন বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান পান্ত্ত নাগ৷ ওনার কাছ থেকে খবর পেলাম পূর্ণেন্দু পত্রী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রযোজনায় ‘ছোটো বকুলপুরের’ জন্য একজন হিরো খুঁজছেন৷ কিন্ত্ত মনোমত কাওকে পাচ্ছিলেন না৷ একদিন সাহস করে চলে গেলাম ওনার কাছে৷ দরজা দিয়ে ঢুকতেই আমাকে দেখে চেয়ার ছেডে় উঠে বললেন৷ “এই তো পেয়ে গেছি আমার হিরো’৷ এভাবেই ছোটো বকুলপুরের নায়ক হয়ে গেলাম, প্রায় হটাৎই৷
প্রশ্ন: প্রথম দিনের শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল ?
পার্থসারথি : সেটা ছিল ১৯৮১ সালের একুশে মে৷ শুটিং কেমন করে হয় জানা ছিল না৷ ফলে একটা অজানা ভয় কাজ করছিলো মনের মধ্যে৷ পরিচালককে সাহস করে অনুরোধ করলাম যে প্রথমে আমি ঘণ্টা দুয়েক আগে দেখবো শুটিং কেমন করে হয়৷ তারপর আমি ক্যামেরার সামনে যাবো৷ পরিচালক অনুমতি দিলেন৷ বেশ কিছু সময় ধরে শুটিং দেখে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললাম, ‘আমি এবার প্রস্তুত’৷
ব্যাস সেই থেকে শুরু ক্যামেরার সামনে অভিনয়৷ এরপর প্রায় গোটা আটেক সিনেমায় অভিনয় করে ফেললাম পরপর৷
প্রশ্ন: সিরিয়ালে অভিনয় শুরু কবে থেকে?
পার্থসারথি : ১৯৮৬ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি সোনেক্সের বিখ্যাত ‘তেরোপর্বন’ দিয়ে সিরিয়ালে কাজ শুরু করি৷ পরিচালক ছিলেন জোছন দস্তিদার৷ তারপর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ২৭০ এর মত ফিল্মে আর সিরিয়ালে প্রায় ৭০/৮০ হাজার এপিসোডে অভিনয় করে ফেলেছি৷
প্রশ্ন : আপনি তো হিন্দিতেও কাজ করেছেন বলে জানি৷ সে ব্যাপারে যদি কিছু বলেন৷
পার্থসারথি : বেশ কিছু হিন্দির কাজ করেছি৷ তার মধ্যে নাম গুম জায়েগার কথা উল্লেখ করতেই হবে৷ এতে হেমামালিনি ছিলেন৷
প্রশ্ন : আপনি তো বহু টেলিফিল্মেও কাজ করছেন?
পার্থসারথি : হা তা তো করেছিই ৷ সাথে বিজ্ঞাপনের কাজ৷ আর হঁ্যা, সাথে নাটকটাও কিন্ত্ত করে গেছি এক সাথেই, ওই চুলে বেণী পাকানোর মত এটা ওটা করে৷ শেষ নাটক যেটা করেছি রমাপ্রসাদ বণিকের পরিচালনায় ‘পটলবাবু ফিল্ম স্টার’৷ সেটাতেও প্রায় বছর দশেক ধরে একটানা করে গেছি৷
প্রশ্ন: এখন আর নাটক করছেন না?
পার্থসারথি: না, করোনার পর থেকে আর নাটকটা করা হয় ওঠেনি৷ বছর দুয়েক হলো সিরিয়ালটা করছি না৷ তবে ফিল্মের কাজ করছি৷ কালকে রাত পর্যন্ত শুটিং করেছি৷
প্রশ্ন: কোন ফিল্ম সেটা জানতে পারি কি?
পার্থসারথি: অবশ্যই৷ বাংলাদেশের একটা সিনেমা৷ কমার্শিয়াল কিন্ত্ত একটু অন্য ধরনের৷ নায়ক ওই দেশেরই সাইফুল রাজ আরনায়িকা কলকাতার মেয়ে৷ ইধিকা পাল৷
প্রশ্ন: অনুভব বলে একটা ফিল্মেও তো আপনিই মূল চরিত্র ছিলেন৷ তাই তো?
পার্থসারথি: হ্যাঁ, রিনা চৌধুরীর পরিচালনায় অনুভব৷
প্রশ্ন: আচ্ছা আপনার করা অনেক চরিত্রের মধ্যে৷ এখনো পর্যন্ত কোন চরিত্রটা আপনাকে দর্শকের মনে একটা দীর্ঘস্থায়ী জায়গা করে দিয়েছে বলে আপনার মনে হয়?
পার্থসারথি: সেটা বলতে গেলে বিদ্যাসাগরের চরিত্রে আমার অভিনয় মানুষের মনে অনেকদিন ধরে রয়ে গিয়েছিল৷ (হেসে) এখনও পর্যন্ত ইন্ডাস্ট্রিতে পার্থ বললে অনেকেই জানতে চায়, ‘কোন পার্থ? বিদ্যাসাগর পার্থ?’ এটা কিন্ত্ত আমার কাছে বিরাট পাওনা৷ সোনেক্সের প্রযোজনায় জোছন দস্তিদারের পরিচালনায় ‘সেই সময়’ বলে একটা সিরিয়ালের বেশ কিছু পর্বের কাজ ছিল বিদ্যাসাগর মহাশয়কে নিয়ে৷
প্রশ্ন: সাম্প্রতিক কালে আপনার কি কি কাজ দর্শক দেখতে পাচ্ছেন?
পার্থসারথি: কিছুদিন আগেই রিলিজ হয়েছে রক্তবীজ আর বগলামামা৷ এ ছাড়াও খুব তাড়াতাডি় রিলিজ হতে চলেছে আরো কয়েকটি ফিল্ম৷
প্রশ্ন: এখন তো ওয়েব সিরিজের রমরমা৷ সেখানে আপনাকে সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না কেনো?
পার্থসারথি: না না , করছি তো৷ এই তো “বাবা” একটা ওয়েব সিরিজে কাজ করলাম৷ এ ছাড়া ব্যোমকেশ সিরিজে সজারুর কাঁটাতেও অভিনয় করেছি৷
প্রশ্ন: আচ্ছা আপনিতো বিভিন্ন মাধ্যমে অভিনয় করেছেন৷ পেশাগত ব্যাপারটা যদি বাদ দিয়ে বলতে হয়, তবে মনের দিক থেকে কোন মাধ্যমে কাজ করে আপনি বেশি আনন্দ পেয়েছেন?
পার্থসারথি: অবশ্যই মঞ্চ৷ এ ব্যাপারটায় আলাদ অনুভূতি এনে দেয়৷
প্রশ্ন : আজকের দিনে যারা এই জগতে কাজ করতে আসছে তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বার্তা—-
পার্থসারথি: না না, বলার কি আছে? আর আমি নিজেও তো এখনও শিখে চলেছি৷
প্রশ্ন : তবুও আপনার এই দীর্ঘ অভিনয় জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যদি কিছু বলেন৷
পার্থসারথি: দেখুন দেখা আর শোনার অভ্যেসটা বাড়াতে হবে৷ তানসেন হতে চাইলে আগে কানসেন হতে হবে৷ অর্থাৎ ভালো কিছু কাজ করতে চাইলে ভালো শোনাটাও জরুরি৷ আর হঁ্যা, সাথে নিয়মিত অনুশীলন করে যেতে হবে৷ তবে এখনকার অনেক ছেলে মেয়েই কিন্ত্ত খুব ভালো কাজ করছে৷