সমর কুমার রায়
গ্রাম বাংলায় শীতের মরশুমে পিঠে, পুলি, পায়েসের সাথে সাথে আরো যে বিষয়টি বাঙালির জীবনের সাথে জডি়য়ে ছিল বেশ কিছুদিন আগেও, সেটা হলো যাত্রা পালা৷ পুজোর পর থেকেই শুরু হয়ে যেত যাত্রার মরসুম ৷ চলত প্রায় চৈত্রের শেষ পর্যন্ত৷ সন্ধ্যে হলেই বোকা বাক্সের সামনে বসে পড়া বাঙালি কিংবা অধুনা নানা ও টি টি মাধ্যমে ওয়েব সিরিজের খুল্লাম খুল্লা সংলাপে মজে যাওয়া বর্তমান প্রজন্ম যাত্রা পালায় বিনোদনের যে আমেজ পাওয়া যেত সেটা ভুলেই গেছে৷ অথচ বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির অল্প যা কিছু এখনও অবশিষ্ট রয়েছে যাত্রাপালা তার মধ্যে অন্যতম৷
যাত্রাপালার ইতিহাস কিন্ত সুপ্রাচীন৷ একসময় মানুষের জীবনে বিনোদনের ক্ষেত্র বলতে যে কয়টি ক্ষেত্র উল্লেখযোগ্য ছিল তার মধ্যে যাত্রাপালা ছিল বেশি জনপ্রিয়৷ সে সময় মূলত পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কাহিনীগুলোই যাত্রাপালার মাধ্যমে দর্শকের সামনে তুলে ধরা হতো৷ সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক পালাও যাত্রাদলগুলি পরিবেশনা করতে থাকে৷ বিগত শতাব্দীর ষাট সত্তরের দশকে চিৎপুরের যত্রাদলগুলি তাদের পালাগান নিয়ে শীতের মরসুম শুরু হলেই বেরিয়ে পড়তো বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে৷ সে সময়ের বিখ্যাত কয়েকজন পালাকারের লেখা বিভিন্ন পালা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল দর্শকের দরবারে৷ এমনই কয়েকজন পালাকার ছিলেন আনন্দময় বন্দোপাধ্যায়, ব্রজেন দে প্রমূখ৷ যাত্রার এইসব মহীরুহের পাশাপাশি বর্ধমানের অখ্যাত জনপদ মন্তেশ্বরের মূলগ্রাম থেকে উঠে আসা ততোধিক অখ্যাত এক পালাকার যে একদিন বাংলার যাত্রাশিল্পে বিপ্লব নিয়ে আসবেন সেটা অনেকের কল্পনার অতীত ছিল৷ যাত্রাশিল্পে এই নতুন বিপ্লবের নায়ক আর কেউ নন, তিনি যাত্রার বাল্মীকি নামে খ্যাত স্বর্গত ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় যার লেখা একেকটি পালা যাত্রা জগতে সুনামি নিয়ে আসে৷ মা মাটি মানুষ, অচল পয়সা,গান্ধারী জননীর মত একেকটি পালা যেনো একেকটা মাইল স্টোন৷
পালাকার হিসেবে ভৈরব বাবুর শুরুটা কিন্ত্ত অনেক আগে৷ তার নাট্যকার হয়ে ওঠার প্রেরণা ছিলেন তার জ্যাঠামশাই প্রফুল্ল কুমার গঙ্গোপাধ্যায় যিনি নিজের গ্রামে পালা মঞ্চস্থ করার জন্য সখের নাটক লিখতেন৷ নিজে অভিনয় করতেন৷ ভাইপো ভৈরবকে দিয়েও অভিনয় করাতেন ৷মন্তেস্বরের সেই দিনগুলোই ভৈরব বাবুকে যাত্রাপালা লেখার ব্যাপারে উৎসাহী করে তোলে৷ তার লেখা বিভিন্ন ঐতিহাসিক পালা খুব অল্প সময়েই মন্তেশ্বর ও তার আশেপাশের এলাকায় সারা ফেলে৷ নাট্যকার হিসেবে ভৈরববাবু এলাকায় ভালো পরিচিতি পেতে থাকেন৷কিন্ত্ত এই পরিচিতি তার সৃষ্টিশীল মনকে তৃপ্তি এনে দিতে পারেনা৷ তিনি আরো বহুলোকের কাছে তার সৃষ্টিকে পৌঁছে দিতে চান৷ তাই রুজি রোজগারের কোনো নিশ্চয়তা না থাকলেও ঝুঁকি নিয়েই চলে আসেন কলকাতায়৷ সম্বল বলতে তার লেখা কিছু ভালো যাত্রাপালা আর একবুক স্বপ্ন৷ মনে আশা যদি ভালো কোনো প্রযোজককে তার লেখা শুনিয়ে খুশি করতে পারেন তবে ভালো কোনো দলের মাধ্যমে তার সৃষ্টি বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিতে পারবেন৷ কিন্ত্ত বাস্তবটা বড্ড কঠিন৷ যাত্রাপাড়া চিৎপুরের বিভিন্ন দলের গদিঘরে প্রযোজকদের তার লেখা শোনাতে গিয়ে কখনো প্রত্যক্ষভাবে কখনো বা পরোক্ষভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন দিনেরপর দিন৷ ওনার পুত্র বর্তমানের আরেকজন প্রখ্যাত পালাকার শ্রী মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে কথা বলে জানা গেলো ভৈরববাবুর নাটক শুনে সেই সময়ের অনেক নামীদামী পালাকার তার লেখার প্রসংশা করেছেন৷ আবার অনেকে তার লেখা শুনবেন বলে তাকে গদি ঘরে বসিয়ে রেখে পেছনের দরজা দিয়ে বাডি় চলে গেছেন৷
এত বিরূপ পরিস্থিতিতেও কিন্ত্ত ভৈরববাবু মনের জোর হারান নি৷ সংসারে তখন তাদের খুব খারাপ আর্থিক অবস্থা৷ তবুও কলকাতায় আসতে হবে বলে কারো কাছে থেকে জামা, কারো কাছে থেকে প্যান্ট ধার করে পডে় এসেছেন৷ দিনেরপর দিন অভুক্ত থেকেও মাটি কামডে় পরে থেকেছেন কলকাতায় যদি কোনো প্রযোজক তার লেখা নাটক নিয়ে সে বছরের পালা করে৷এরকম পরিস্থিতে তার লেখা একটি নাটক তাকে অনেকটাই পরিচিতি এনে দেয়৷ নাটকটির নাম ‘ নাচ মহল ‘৷ এই পালাটির মাধ্যমে তিনি গ্রামেগঞ্জে ও যাত্রামহলে পরিচিত হয়ে যান৷ এরপর তার লেখা একের পর এক নাটক তাকে যাত্রার পালাকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তোলে৷ ঐতিহাসিক, ভক্তিমূলক, সামাজিক সব ধরনের নাটকেই তিনি লেখক হিসেবে মুন্সিয়ানার পরিচয় রাখেন৷ কিন্ত্ত তখনও তিনি পাকাপাকিভাবে কলকাতার বাসিন্দা হয়ে উঠতে পারেন নি৷ নিজের গ্রাম থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার হেঁটে তিনি মেমারিতে আসতেন৷ তারপর কলকাতায় আসতেন বাসে করে বা ট্রেনে চডে় শুধুমাত্র যাত্রার পালাকার হিসেবে কাজ করার জন্য৷৷