• facebook
  • twitter
Friday, 8 November, 2024

‘আমাদের সমাজে পুরুষরাও পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার’

রোজই যখন সংবাদ শিরোনাম দখল করছে মহিলাদের উপর নির্যাতনের খবর, ঠিক তখনই ‘কাবেরী’ ওয়েব সিরিজে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার এক নারীর চরিত্রে অভিনয় করলেন পাওলি দাম। কী ভাবে দেখছেন পাওলি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পর্যায়টাকে? এক সাক্ষাৎকারে অবন্তী সিনহা-কে বললেন সে কথা।

চারিদিকে যখন নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র, যে-আবহে প্রতিদিন কোনও না কোনও ভাবে নির্যাতিত হচ্ছে মেয়েরা, ঠিক সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে উঠে আসে এক অমোঘ প্রশ্ন! মানসিক এবং শারীরিকভাবে অত্যাচারের শিকার হওয়া ‘কাবেরী’-রা কি বাস্তবে সত্যিই রুখে দাঁড়াতে পারে? কথা হচ্ছিল হইচইয়ের সাম্প্রতিক সিরিজ ‘কাবেরী’ প্রসঙ্গে।

এই সিরিজের নামভূমিকায় রয়েছেন পাওলি দাম। বিপরীতে অভিনেতা সৌরভ চক্রবর্তী। গার্হস্থ্য হিংসার শিকার এই ‘কাবেরী’ কিন্তু একজন শিক্ষিকা, সক্ষম, উপার্জনশীল নারী। অথচ ছাপোষা সমাজ তাকে শিখিয়েছে সাত চড়ে রা না কাড়াই হল নারীর সহনশীলতার প্রকাশ। কিন্তু অত্যাচারিত হতে হতে সেও একসময় সোচ্চার হয়। নারী নয়, একজন মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকারের প্রখর দাবিতে রুখে দাঁড়ায় ‘কাবেরী’। এই চরিত্রটিকে ঘিরে কী অনুভব পাওলির, শেয়ার করলেন সেই কথাই।

সিরিজের শুরুতেই একজন ‘সাবমিসিভ’ নারীকে আমরা দেখতে পাই। এই চরিত্রটি কি আপনার চোখে দেখা কোনও বাস্তব চরিত্র, নাকি নিজের মতো করে কল্পনা দিয়ে তৈরি করে নিয়েছিলেন ‘কাবেরী’কে ?

সত্যি বলতে কি, এরকম চরিত্র আমার আশেপাশে আমি খুব কমই দেখেছি। যে ‘সাবমিসিভ’, ভয় পেয়ে থাকে সারাক্ষণ। যদিও ‘কাবেরী’ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, সে একজন শিক্ষিকা- কিন্তু সে চরিত্রগতভাবে ‘সাবমিসিভ’। নির্দেশক শৌভিক কুন্ডু যখন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন এমন একটি কনসেপ্ট আর ক্যরেক্টার নিয়ে, আমার কিছুটা অসুবিধাই হয়েছিল বুঝতে যে, এটাকে আমি কী করে ডিল করব। কারণ আমি তো নিজেও খুব প্রতিবাদী, বোল্ড ধরনের মানুষ। আর আমি ছোট থেকে যাদের দেখেছি, আমার মা এবং দিদা, বা পেশাগত ক্ষেত্রে মহিলা নির্দেশক এবং সহকর্মীরা, তারা চরিত্রগতভাবে সকলেই খুব শক্তিশালী। আমি মাতৃতান্ত্রিক পরিবার বেশি দেখেছি। এমন নয় যে বিপাকে পড়ে তাদের কোনও ট্রান্সফর্মেশন ঘটেছে, মেরুদণ্ড তৈরি হয়েছে। তাই এই চরিত্রটা আমার জন্য এক্সট্রা চ্যালেঞ্জিং ছিল। কিছুটা অর্গ্যানিক্যালি আমি এটা ডিল করেছি।

‘কাবেরী’র স্বামী যে তার উপর অত্যচার করত, সেটা কি আমাদের সমাজের স্যাডিস্ট মানসিকতারই একটা বহিঃপ্রকাশ?

‘কাবেরী’র স্বামীর একটা সাইকোলজিক্যাল সমস্যা তো ছিলই, তবে আমার মনে হয় একটা মানুষ যেভাবে বেড়ে ওঠে, তার জীবনযাপন- এই সবটা নিয়েই তার চরিত্রগঠন হয়। ‘কাবেরী’র স্বামীর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। মেয়েটির উপর যে-অত্যচারটা হতো, সেটা কেন সে মেনে নেয়- এই প্রশ্ন আমাকেও নিরন্তর ভাবিয়েছে। আমি পরে ডেটা দেখেছি, সমাজের একটা বড় অংশের মেয়েরা, এই ধরনের অত্যাচার মুখ বুজে মেনে নিতেই অভ্যস্ত। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের কথা জানানো দরকার। সেটা সিরিজের মধ্যে দিয়ে হলেও, বাস্তবটা সামনে আসা উচিত।

ব্যক্তিগত জীবনে আপনি মেয়েদের উপর ঘটে যাওয়া অপরাধের বিষয়ে কতটা প্রতিবাদী ?

আমি মনে করি প্রতিবাদটা সহজাতভাবেই আসে। তৎক্ষণাৎ সমস্যা না মেটাতে পারলেও একটা আলোচনার পথ তো অবশ্যই তৈরি করা যায়। আমি সমাধানে বিশ্বাসী। সব কিছুর সমাধান আছে। মেয়েদের ভার্বাল, ফিজিক্যাল বা ফিন্যন্সিয়াল অ্যবিউজ- এর কোনওটার শিকার হওয়া মেনে নেওয়া যায় না।

বর্তমান সমাজে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স থেকে শুরু করে, নানাভাবে মেয়েদের উপর অত্যাচার বাড়ছে। এর কারণটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

এই যে পুরুষতন্ত্রের ভিক্টিম হয় মেয়েরা, এর কারণ হল, সমাজ একধরনের মানসিকতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ইন আ বিগার পার্সপেক্টিভ আমার মনে হয়, আমাদের সমাজে পুরুষরাও পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার। কারণ ছোট থেকেই পুরুষদের শেখানো হয়, তাদেরকেই পরিবারে টাকার জোগান দিতে হবে। ফলে রোজগার করার জন্য তাদের কোনও না কোনও পেশাদার ক্ষেত্রে দক্ষ হতেই হবে। তারাও অভ্যস্ত হয় এটা ভাবতে যে, সংসারে আমার ভূমিকাটাই প্রধান, ফলে সবটা আমার ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করব। মহিলাদের সীমারেখাটাও তারাই নির্দিষ্ট করে দেয়। পুরুষের মেল ইগো বুস্ট হয় এটা ভেবে যে, আই অ্যাম আ প্রোভাইডার। বহু অভিনেত্রী বিয়ের পর সিনেমা ছেড়ে দেন এই পরিস্থিতিতে পড়ে।

বাস্তবে প্রতিবাদী মহিলাদের মেনে নিতে অসুবিধে হয় পুরুষদের। কিন্তু ছবির কেন্দ্রে একজন মহিলা প্রোটাগনিস্টকে মানতে দর্শকদের অসুবিধা হয় না ?

বাস্তবে মানতে পারেন না কারণ সেটা প্রথাগত সিস্টেমের বাইরে। কিন্তু আমরা দেখছি বেশ কিছু বছর ধরে একাধিক মহিলাকেন্দ্রিক সিনেমা জনপ্রিয় হচ্ছে। এর কারণ বহু ওটিটি কন্টেন্ট তৈরিই হয়েছে মহিলা চরিত্রকে সামনে রেখে। ওটিটি যেহেতু পার্সোনাল স্ক্রিনেই দেখা সম্ভব হয়, এটা উইমেনসেন্ট্রিক কন্টেন্ট দেখার একটা অভ্যেস তৈরি করে দিয়েছে মানুষের মধ্যে। সেটাই হয়তো নারী চরিত্রের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। খুব ধীরে হলেও এই বিষয়গুলো মহিলাদের মোটিভেট করবে আর সমাজে পুরুষদেরও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে বলে আমার বিশ্বাস।

সামাজিকভাবে পরিবর্তন আনবে, এমন কী চরিত্রে অভিনয় করতে ইচ্ছে করে আপনার ?

খুব সাধারণ কোনও মেয়ের গল্প থেকে আইকনিক চরিত্র, যে-কোনও ভূমিকাই আমি করতে প্রস্তুত। আমার প্রতিবাদটা কাজের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ করতে চাই। নারী সশক্তিকরণের বিষয়টাকে প্রাধান্য দিই, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে জরুরি হল, যে-চরিত্র আমায় ব্যক্তিগতভাবে মোটিভেট করবে, সেটাতেই অভিনয় করতে চাই আমি।