গওহরের জীবনের গভীর কথন

মন ভালো নেই গওহরের। মুজরার রোশনাইয়ের আড়ালে সেই মনের অন্ধকার কিছুতেই ঢাকতে পারছেন না গওহর জান। এই তওয়াইফের জীবনে, রসিকজনের নজরানা, অর্থের প্রাচুর্য, নাচ-গানের কদর, তিনি বহুল পরিমাণে পেয়েছেন। কিন্তু সারাজীবন যে-কমল হিরের জন্য তাঁর চাতকের মতো অপেক্ষা- সেই ভালোবাসার খোঁজ তিনি পাননি।

একসময় গওহরকে রত্ন দিয়ে মুড়ে দিলেও, ‘বাঈ’ আর ’বউ’-এর মধ্যে একটা সীমারেখা টেনে দিয়েছিলেন জমিদার নিমাই সেন। সেটা বেশ বুঝতেন গওহর। কিন্তু সংসার করার সাধ যে চিরদিন মনের গোপনে লালন করে এসেছেন তিনি। তাই আবেগে ভেসে গিয়ে, তাঁর থেকে প্রায় দশ বছরের ছোট, তাঁরই তবলচি গুলাম আব্বাসকে বিয়ে করলেন গওহর জান। অথচ বিশ্বাসঘাতক আব্বাস বহু নারীতে আসক্ত। গওহরকে আর্থিক শোষণ করা থেকে শুরু করে, মামলা মোকদ্দমায় জেরবার করার মতো নানা ক্ষত, সে দিয়ে গেছে গওহরের জীবনে।

নিবিড় নিঃসঙ্গতা পিছুছাড়া হয় না গওহরের। জখম জমে জমে পাথর হয়। একসময় গুজরাতি মঞ্চাভিনেতা আম্রুত ভাগল নায়েকের সঙ্গে থাকতে শুরু করলেন। কিন্তু এমনই নিয়তি, ঈশ্বর নায়েককে অকালেই ডেকে নিলেন। আবার নেমে এল একাকিত্ব।। গওহরের জীবন আসলে এক শূন্যতার গহ্বর, যার ভিতর সুখের আলো প্রবোশ করে না। লোকে দেখে তাঁর বাহ্যিক বোলচাল, অন্তর দেখে না।


দেখে সেই জমানায় ২০,০০০ টাকা উড়িয়ে তাঁর বেড়ালের বিয়ে দেওয়া। দাঁতিয়াতে এক ধনী পরিবারে, সপার্ষদ মুজরো করতে যাবেন বলে একটা গোটা ট্রেন চেয়ে পাঠিয়েছিলেন গওহর। সেই ট্রেনে তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁর হাকিম থেকে বাবুর্চি সকলেই। একই পোশাক নাকি দু’বার তিনি পরেন না- এমন কথা লোকের মুখে চাউর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তবু যেন গওহরের মনে সুখ নেই। তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, গওহর নয়- শৈশবের অ্যাঞ্জেলিনাকে খুঁজতে চেয়ে।

এ যেন এক পদ্মপাতা-জীবন, ভেসে বেড়ানোই যার ভবিতব্য। আর্মেনিয়ান পিতা উইলিয়াম ইয়োয়ার্ড আর অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মা ভিক্টোরিয়ার কন্যা অ্যাঞ্জেলিনার, জীবন বদলে দিয়েছিল মা-বাবার ডিভোর্স। নৃত্যগীত পটীয়সী মা, ভিক্টোরিয়া (বড়ি মলক জান), ধর্মান্তরিত হন তাঁর দ্বিতীয় বিবাহের পর। আর অ্যাঞ্জেলিনা রূপান্তরিত হন গওহরে। কলকাতায় এসে থেকে মায়ের সঙ্গেই শুরু হয় গওহরের নাচ-গানের তালিম। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই দ্বারভাঙার মহারাজের মেহফিলে ডাক পড়ে গওহরের।

কিন্তু খেয়াল, ধ্রুপদ, ঠুংরির রসে নিমজ্জিত এই সুরসাধিকার বাঈজি জীবনে, অসম্মানই বেশি। তবু হঠাৎই একটা বিরাট পরিবর্তন এনে দেয় তৎকালীন গ্রামাফোন কোম্পানি। এই গ্রামাফোন কোম্পানিতেই ১৯০২ থেকে ১৯২০-র মধ্যে ১০টি ভারতীয় ভাষায় গওহর রেকর্ড করেন ৬০০টিরও বেশি গান। ভারতীয় সংগীত জগতের ‘রেকর্ডিং স্টার’ গওহর তখন খ্যাতির তুঙ্গে। তাঁর প্রতিটা গানের রেকর্ডিংয়ের পর নিজেই সিলমোহর দিয়ে, স্বকণ্ঠে বলে দিতেন- ‘আই অ্যাম গহর জান’।

এমনই দ্যুতিময় জীবনের আলো-আঁধারি নিয়ে মঞ্চে পুনরায় গওহর। ‘মাই নেম ইজ জান’-শিরোনামের নাটকটির নির্দশনায় অবন্তী চক্রবর্তী। নাম ভূমিকায় অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়। মুম্বইয়ে প্রথম শোয়ের পর এবার কলকাতার, জিডি বিড়লা সভাঘরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই নাটক, আগামী ৬ ডিসেম্বর।

অর্পিতার ব্যস্ততা তুঙ্গে তবু তারই মাঝে জিজ্ঞেস করে ফেলি, গওহর জানের জীবনকে মঞ্চে তুলে আনার নেপথ্যের জার্নিটা কেমন ছিল? উত্তরে শিল্পী জানান, ‘এ নাটকের ভাবনাচিন্তা থেকে মঞ্চস্থ করার নেপথ্যে ছিল, প্রায় এক বছরের প্রস্তুতি। নির্দেশকের আইডিয়াটা ছিল যে, এটায় একক শিল্পী হিসেবে আমিই পারফর্ম করব। এবং যেহেতু আমি গান গাইতে পারি, এতে গানও থাকবে। কোভিডের সময় এটার ভাবনাচিন্তা শুরু হলেও, এরপর গবেষণা, স্ক্রিপ্ট, চিত্রনাট্যকে বারবার ভাঙা, রিশেপ করা- এই গোটা পর্বটা জুড়ে আমি ছিলাম। ফলে চরিত্রটা আমার সামনেই যেন তৈরি হল। আমাকে আলাদা করে বুঝতে হয়নি গওহর কী, কেমন বা কীভাবে তাঁকে পোর্ট্রে করব। একটা অন গোয়িং প্রসেসের মধ্যে থেকেই আমি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম গওহর জানকে।’

কিন্তু এমন এক বর্ণময় জীবনের সবটুকু কি ধরা যাবে এই নাটকে? অর্পিতা জানান, ‘এটাকে ব্যাকবোন অফ গওহরস জার্নি হিসেবে দেখা যেতে পারে। হয়তো সব গল্প, সমস্ত ঘটনাকে ধরা সম্ভব নয় কিন্তু তাঁর জীবনের একেকটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভকে তুলে ধরাই এর মূল উদ্দেশ্য। যেমন গওহর অ্যাজ অ্যান পারফর্মিং আর্টিস্ট বা একজন নারী যিনি ভালোবাসার জন্য কাঙাল ছিলেন, কিন্তু বারবার বিশ্বাস ভেঙেছে তাঁর। এগুলোও যেমন আছে, তেমনই ধরা হয়েছে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল গওহরের উদারতার সুযোগ নিয়ে, ওঁকে প্রায় কপর্দকশূন্য করে দেওয়ার ঘটনাগুলো।’

গওহরকে নিয়ে একটি আস্ত নাটক ‘জান-এ –কলকত্তা’, এর আগে মঞ্চস্থ করেছিলেন ভদ্রা বসু। আনন্দী বসু করেছিলেন গওহরের চরিত্রটা। তবে অর্পিতা ওঁর নাটকটি সম্পূর্ণ স্বকীয়তায়, আর নিজস্ব আঙ্গিকে উপস্থাপনা করছেন। গওহরের সঙ্গে তাঁর একটি জায়গায় দারুণ মিল। গওহরের মতোই অর্পিতাও, খুব ছোটবেলা থেকে শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্যে তালিম নিয়েছেন। গানের ক্ষেত্রে, জীবনের নানা পর্বে গুরু হিসেবে পেয়েছিলেন অরুণ ভাদুড়ি, শিপ্রা বসু ও রাজ্যশ্রী ঘোষকে। কিছুটা সময় শিখেছেন রাশিদ খাঁর কাছেও। রাজ্য সংগীত অ্যাকাডেমি, ডোভার লেন প্রভৃতি বহু প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ, জয়ী হওয়া এবং স্টেজ পারফর্মেন্সের মধ্যে দিয়ে চলেছে তাঁর প্রস্তুতি। অর্পিতার মতে, যে-কোনও শিল্পীরই ভিতটা তৈরি হওয়া উচিত একদম শৈশব থেকেই। আর সেই জন্যই হয়তো ‘মাই নেম ইজ জান’-এর দর্শকদের প্রাপ্তির ঝুলি ভরে উঠবে অর্পিতার গানে।

কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়ে ‘মাই নেম ইজ জান’ কতটা প্রাসঙ্গিক? অর্পিতার স্পষ্ট জবাব, ‘দুর্ভাগ্যক্রমে গওহরকে যে-ঘটনাগুলোর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল, আজও সেগুলো মহিলাদের জীবনে ঘটে। যারা পারফর্মার তাদের জীবনে তো আরও বেশি। এই পুরুষশাষিত সমাজে, মহিলাদের আজও নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে, নিজের জায়গা কায়েম করতে একটা এক্সট্রা লড়াই লড়তে হয়। এটা পারফর্মিং আর্টস থেকে আজকের কর্পোরেট, সর্বত্র প্রযোজ্য। গওহর তাওয়াইফ ছিলেন বলেই শুধু নয়, আজও তো মহিলাদের অসম্মানের শিকার হতে হয় ঘরে বাইরে। সেই জন্যই গওহরের গল্পটা আজও প্রাসঙ্গিক।’

সামনে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে ‘মাই নেম ইজ জান’কে। কলকাতার পর শো রয়েছে দিল্লি, হায়দ্রাবাদে। তারপর ওয়ার্ল্ড টুরের পরিকল্পনা। ইতিমধ্যেই শো ফাইনাল হয়ে গেছে কানাডা আর জার্মানিতে।

এই প্রোডাকশনে একাধিক ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে। তবে অর্পিতা জানালেন যে, কলকাতার শোয়ের পর থেকে বাংলার বদলে শুধু হিন্দি আর ইংরেজিতেই থাকবে সংলাপ।

গওহরের মনের খবর রাখতে পারেননি তাঁর মনের মানুষেরা। কিন্তু দর্শক আজও তাঁর জন্য পাগল, একথা প্রমাণ করেছে মুম্বই। এবার তাঁর প্রাণের শহর কলকাতার পথ চেয়ে আছেন গওহর জান। মেহফিল-এ-চিরাগের আলোয় কি সেই জন্যই চিকচিক করে উঠছে তাঁর চোখদুটো!