দাম্পত্যে পঞ্চাশ বছর কাটানো একটা গর্ব অনুভবেরও ব্যাপার। আপনি সেটাকে কীভাবে দেখেন?
অপর্ণা সেন: এই প্রসঙ্গে আমার একটা গল্প মনে পড়ছে। সেই ডায়লগটা আমি আমার মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার ছবিতে রেখেছিলাম। জেনিফার কেন্ডাল এবং শশী কাপুরের দাম্পত্য জীবন ছিল দীর্ঘদিনের। জেনিফারের বোনের বিয়ে ভেঙে যায়। তিনি জেনিফারকে বলে ছিলেন তোমাদের সম্পর্ক কীকরে এত দীর্ঘস্থায়ী হল। জেনিফার হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ২৫ বছর আগে কাটিয়ে নাও। তারপরে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। আগে একসঙ্গে থাকতে হবে।
এটা কিন্তু একটা দারুণ কথা এই ২৫ বছর দাম্পত্যে একসঙ্গে থেকে কাটাতে হবে, এই কথাটা আমি আমার ছবি মিস্টার এন্ড মিসেস আইয়ারে ব্যবহার করেছি। যখন রাহুল এবং কঙ্কণা বাংলোটাতে এসে উঠছে। তখন ওখানকার কেয়ারটেকার বলছে, ‘মেমসাব একসাথ পঁচিশ শাল রহে, উসকে বাদ সব ঠিক হো জায়েগা।’ আমার মনে হয়, এই কথাটির মধ্যে কিন্তু কিছুটা সত্যি আছে। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে গেছে। আগে মানুষ যখন বিয়ে করত সেটা প্রেম করে হোক বা সম্বন্ধ করে— মানুষের মধ্যে একটা অন্য ব্যাপার ছিল। তারা বিয়ের পর ভাবতো এই বন্ধনটা আমার সারা জীবনের জন্য। কিন্তু চট করে ভাঙার প্রশ্ন উঠত না। তবে সেখানেও অনেকে অসূখী জীবন যাপন করেছে। আমি এমনও ফ্যামিলি জানি যে, বাবা-মায়ের প্রত্যেকদিনের অশান্তিতে ছেলেমেয়েরা তাদের বলছে, ‘প্লিজ তোমরা আলাদা থাকো।’ আমার বোনের সম্পর্কটা খুব সুন্দর। আমার বোন এখন একটু অসুস্থ। তাদের দীর্ঘ দাম্পত্যজীবন। তাদের শ্রদ্ধা ও পারস্পরিক ভালোবাসা সত্যিই কিন্তু দেখার মতন।
এখনকার ছেলে মেয়েরা বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায় না এবং বিয়ে করলেও এখন বিয়ে ভাঙার সংখ্যাটা অনেক বেশি। কেন বলে মনে হয়?
অপর্ণা সেন: আজকালকার ছেলেমেয়েদের আমি দোষ দিই না। ওরা সামনে কোনো আদর্শবান মানুষের দেখা পাচ্ছে না। রাজনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক জীবনে। তাই উদ্দেশ্যহীনভাবে ওরা বেড়ে উঠছে।
সেরকম কিছু দেখে বড় হতে পারছে না বলেই হতাশা আর অধৈর্য তাদের গ্রাস করছে। আমার সামনে সেরকম কোনো আদর্শ না থাকলে আমি জীবনটাকে বদলানোর চেষ্টা করব কীকরে। তারপর যেসব কোম্পানিগুলোতে ছেলেমেয়েগুলো চাকরি করছে, তাতে তারা অনেক টাকা মাইনে পাচ্ছে। কিন্তু তাদের জীবন থেকে অফিস পুরো চব্বিশ ঘন্টা কেড়ে নিচ্ছে, যার ফলে তারা তাদের পার্টনারকে সময় দিতে পারছে না। দুরত্ব বাড়ছে। পারস্পারিক বোঝাপড়া এবং পরস্পরকে সময় না দেওয়াটা একটা বিশাল বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায় সম্পর্ক ভাঙার জন্য। জীবনযাপনটা অনেক বেশি টেনশনে পরিপূর্ণ হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে আর একটা গল্প মনে পড়ছে। শাবানা আজমির বাবা কাইফি আজমি আর ওঁর স্ত্রী প্রতিদিন সকালে একসঙ্গে বসে চা খেতেন। সেই যে চা-টা ঢালছেন, কাপটা হাতে করে দিচ্ছেন সেটা নিয়েই উনি দারুণ একটা কবিতা লিখেছিলেন। এই যে একসঙ্গে বসে খাওয়াতে যে একটা প্রেম, একটা ভালোবাসা গড়ে ওঠা এই সময়টুকু আমরা একে অপরকে দিচ্ছি না।
খুব ছোটবেলায় যেটা হয়, সেটা হচ্ছে একটা কামনা থাকে। একটা একটা অ্যাগ্রেসিভনেস থাকে। তারপরে দিন যত এগোতে থাকে পারস্পরিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং বিশ্বাস বন্ধুত্ব একটা আলাদাভাবে গড়ে ওঠে। তার সঙ্গে একে অপরের প্রতি সম্মানটা খুব দরকার।
দাম্পত্যের এই জার্নিতে আপনি আর কল্যাণবাবু কেমন আছেন?
অপর্ণা সেন: আমাদের বরাবরই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এখন কল্যাণ রিটায়ার করেছে। ওর কাছে অবসরটা একটু বেশি। দাম্পত্য মানেই কিন্তু শুধু সংসারের খুঁটিনাটি আলোচনা নয়। আমরা সময় পেলেই একসঙ্গে বেড়াতে যাই। গান শুনি। ধরো, ও ক্রিকেট দেখছে। আমার দেখতে তখন ভালো লাগছে না। আমি গান শুনছি বা বই পড়ছি। আমি সেখান থেকে আমার উপলব্ধিটা ওর সঙ্গে শেয়ার করছি। আমি কলকাতায়, ও শান্তিনিকেতনে— এই যে দু’জনের দু’জনের জন্য এই অপেক্ষা, এটাও কিন্তু খুব দরকার। আজও যখন আমি এই সকালবেলায় রেডি হচ্ছি বেরোবো বলে। হঠাৎই ও আমাকে একটা জিপসি গান শোনালো। সেটা নিয়ে ব্যাখ্যাটা করল, সেখানে কী ইনস্ট্রু্মেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে, অনেক খুঁটিনাটি, এতে ভালো লাগার মুহূর্ত তৈরি হয়। পরস্পরের প্রতি পরস্পরের আগ্রহ ভালোবাসা বিশ্বাস ভরসা জীবনের মান অভিমান সব কিছু নিয়েই জীবন চলে।
অঞ্জন দত্তর সঙ্গে আপনার পরিচয়, বন্ধুত্ব অনেক দিনের। আপনার পরিচালনায় অঞ্জন কাজ করেছেন। এই প্রথম দু’জনকে আমরা পাচ্ছি জুটি হিসেবে। এর জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য পরিচালক পরমের। নয় কি?
অপর্ণা সেন: হ্যাঁ এটা একদম ঠিক কথা। এর আগে পরমের সঙ্গে আমার ওর ছবি সোনার পাহাড়ের সময় কথা হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়টা আমার টাইম ম্যাচ করেনি বলেই আমি কাজটা করতে পারিনি। এই ছবিটা, ও যখন গল্পটা আমাদের শোনায়, ও প্রথমেই বলেছিল, ‘তুমি আর অঞ্জনদা রাজি না হলে আমি এই ছবি করতে পারবো না।’ ছবিটা আসলে একটি রাতের গল্প। দুটি মানুষের কথোপকথনের উপর ছবিটা এগিয়ে চলে। এই চরিত্রটাই অভিনয় করতে গেলে দু’জনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং একটা ভীষণ দরকার। আমার আর অঞ্জনের মধ্যে ভীষণভাবে রয়েছে। আমি ওর গান শুনতে চলে যাচ্ছি কখনো ওর প্রোগ্রামে। ওর বাড়িতে চলে যাচ্ছি কল্যাণকে নিয়ে।
ডিনার করলাম এবং তার সঙ্গে ওর বউ জয়তী আর নীলের সঙ্গেও আড্ডা মারলাম। আবার অঞ্জনের সঙ্গে আমার মতবিরোধ হয়। ওর উপর রেগে যাই। রাগ ভাঙাতে ও আমাকে ফোন করে। আমাদের দু’জনের একটা খুব ভালো বোঝাপড়া আছে। দরকারে অদরকারে ফোন হয়।
এই ছবির কেন্দ্রে ‘জয়িতা’ এবং ‘অমর’। তাদের পঞ্চাশ বছরের বিবাহবার্ষিকী। সেই নিয়ে কী বলবেন?
অপর্ণা সেন: একসঙ্গে পঞ্চাশ বছর জীবন কাটালে তাদের জীবনে অনেক ওঠাপাড়া থাকবেই। তাদের মধ্যে ভাব-ভালোবাসা বিশ্বাস-অবিশ্বাস-নালিশ সবকিছু থাকবে। আবার একে অপরের প্রতি অদ্ভুতভাবে কেয়ারিং। এটা কিন্তু পঞ্চাশ বছরের যে কোনো দম্পতিরই হয়। তবে ছবিতে এই রাতটা একটা বোঝাপড়ার রাত। এটা বলব খুব দক্ষতার সঙ্গে পরম এই গল্পটা ভেবেছে। অভিনয়ের সময় যখনই কোনো প্রবলেম হয়েছে, আমরা ইনপুট দিয়েছি, ও সেটাকে চেঞ্জ করেছে। সব মিলিয়ে কিন্তু আমার পরমের সঙ্গে কাজ করতে দারুণ লেগেছে। আমি বরাবরই পরমের অভিনয় এবং ছবির ভক্ত।
জুটি হিসাবে অঞ্জনকে কেমন লাগল?
অপর্ণা সেন: এই ছবিটা অঞ্জন না হলে আমি করতাম না। আমি না হলে অঞ্জনও করতো না। আমি অঞ্জনের অভিনয় ধারার সঙ্গে পরিচিত। অঞ্জন কখন কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে এবং সেখানে আমি কীভাবে রিঅ্যাক্ট করব, এটা আমার মোটামুটি জানা। যেহেতু ছবিটাকে দু’জন অভিনেতাকে টেনে নিয়ে যেতে হবে, তাই তাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়াটা খুবই দরকার। দু’জনের অভিনয়টাই ভীষণ স্বতঃস্ফূর্ত ও জীবন্ত হতে হবে।
অঞ্জনের সঙ্গে আমার একটা আলাদা কমফোর্ট লেভেল আছে। সহ-অভিনেতা হিসেবে ওকে পেয়েছিলাম বলে আমি এই ছবিটা করতে রাজি হয়েছিলাম। এই ছবিতে আমাদের কোনো ইনটিমেট দৃশ্য নেই। কিন্তু অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছে, শুইয়ে দিচ্ছে, বমি পরিষ্কার করছে— এই ধরনের দৃশ্য আছে। একটা কমফোর্ট লেভেল না থাকলে আমরা এই অভিনয়টা করতে পারতাম না।