১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে তথ্যচিত্র পরিচালনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত হয়েছিলেন হরিসাধন দাশগুপ্ত। তাঁর কর্মজীবনে ফিচার ফিল্মের সংখ্য কম হলেও, তথ্যচিত্রকার হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার ফিল্ম স্কুলে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন হরিসাধন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম শেষ করার পর, তিনি আমেরিকান নির্দেশক ইরভিং পিচেল-এর তিনটি ছবিতে পর্যবেক্ষক শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ শুরু করেন। হরিসাধন কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৪৭-এ। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে ৫০টি তথ্যচিত্র এবং বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করেন হ্যারি এস দাশগুপ্ত ।
তাঁর প্রতিভা চিনে নিতে ভুল হয়নি ফরাসি নির্দেশক জাঁ রেনোয়ার। ভারতের স্বাধীনতার ঠিক পরে কলকাতায় ‘দ্য রিভার’ পরিচালনার সময়, তাঁকে সহায়তা করার জন্য তিনি ডেকে নিয়েছিলেন হরিসাধনকে।
পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য, ক্লঁদ রেনোয়ার-এর ক্যামেরা, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনা এবং পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাজনায় সমৃদ্ধ, হরিসাধনের তৈরি তথ্যচিত্র ‘দ্য স্টোরি অফ স্টিল’, একটি ক্লাসিক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। ফিচারের মধ্যে তাঁর প্রথমটি ছিল ১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-মাধবী মুখোপাধ্যায়-বসন্ত চৌধুরী অভিনীত ‘একই অঙ্গে এত রূপ’ প্রদর্শিত হবে ৩০ তম KIFF-এ।
বাবাকে একজন নির্দেশক হিসেবে কীভাবে দেখেন, প্রশ্ন করা হলে তাঁর পুত্র নির্দেশক রাজা দাশগুপ্ত জানালেন, ‘একদম ছোটবেলায় বাবাকে কেবল দেখতাম ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে। কখনও পাঞ্জাব, কখনও মধ্যপ্রদেশ, সঙ্গে বন্ধুবান্ধব। এই বেরিয়ে পড়ার মজাটা থেকেই তথ্যচিত্রের আইডিয়া আসত। কত রকম প্রকৃতি, কত ধরনের মানুষজন, কত ধরনের জীবনচর্যা! যত বেশি দেখা যায় তত বেশি তথ্যচিত্র তৈরির রসদ পাওয়া যায়। বাবাকে সবসময় ইম্প্রোভাইজ করতে দেখেছি। বাবা কোনও জায়গায় গিয়ে শুট করার সময় তৎক্ষণাৎ ঠিক করতেন কী শুট করবেন। এটাই ওঁর মৌলিকতা।
একটা বিশেষ ছবির উদাহরণ দিই। বাবা টি বোর্ড অব ইন্ডিয়ার একটি তথ্যচিত্র করেছিলেন। ‘দ্য টেল অফ টু লিভস অ্যান্ড এ বাড’। বাবা ঠিক করলেন, মোট চারটে জায়গায় শুটিং হবে। দার্জিলিং,আসাম, নীলগিরি, আর কাংড়া উপত্যকা। কারণ ভারতে এই চারটে জায়গাতেই চা তৈরি এবং প্যাকিং হয়। কিন্তু শুধু এইটুকু বললে যে ছবি হবে, তা দশ মিনিটে শেষ হয়ে যাবে।
চা-এর ওপর এক্সপোর্ট প্রমশানাল ফিল্ম। সেখানে শুধু চা পাতা বা বাগান দেখালেই চলবে না, দেখাতে হবে ভারতবর্ষকেও। সেক্ষেত্রে প্রতিটি এলাকার প্রকৃতি, মানুষের জীবনযাপন দেখাতে হবে। যেমন দার্জিলিঙের মেয়েরা চা তুলছে, তার পেছনে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। তেনজিং নোরগের ইন্টারভিউও নেওয়া হল এই জন্য।
আসামে চা নিয়ে ছবি তুলতে গিয়ে দেখানো হল বিহু উৎসব, কাজিরাঙার জঙ্গল। নীলগিরিতে গিয়ে দেখানো হল চা বাগান বা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সেখানকার অন্য রকম দর্শনীয় চাষবাস। দেখানো হল একটি ফার্ম, যেখানে বিভিন্ন ফল আর সবজি চাষ করা হয়। নীলগিরির বন্যপ্রাণীদের ছবিও তোলা হল। আমি কাংড়া অবধি যাইনি। অবশ্য। এইভাবেই তথ্যচিত্রকে জনমানসের কাছাকাছি নিয়ে আসতেন বাবা।’