বরুণ দাস
নিম্ন আদালতে আরজি করকাণ্ডে অপরাধীর শাস্তি ঘোষণার পর তাঁর বিরুদ্ধে আজীবন কারাদণ্ডের বিরোধিতা করে ফাঁসির জন্য মহামান্য উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন রাজ্য সরকারের আইনজীবীরা। একই সঙ্গে এতোদিন যা ছিল কিছুটা গোপনে, এখন তা প্রকাশ্যে এনেছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যদপ্তর। খবরে প্রকাশ, স্বাস্থ্যভবনে চলছে আন্দোলনকারী পড়ুয়া-চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ‘কড়া ব্যবস্থা’ নেওয়ার বিতর্কিত পর্ব। যা ইতিমধ্যেই রাজ্যজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে উঠেছে শাস্তি-পর্বের খবর।
‘অপরাধী’র আমৃত্যু কারাদন্ডের, শাস্তিদানও আরজি কর-কাণ্ডের আগুনে জল ঢালতে পারেনি। বরং শাস্তিদানের বিষয়টি আরও জটিলতা ধারণ করেছে। রায়দানের পাশাপাশি মাননীয় বিচারকের গভীর এবং বাস্তবসম্মত পর্যবেক্ষণ অনেকের মনেই নানাবিধ সন্দেহ-সংশয়ের ঝড় তুলেছে। যা শক্তিশালী সমাজমাধ্যমের সৌজন্যে আছড়ে পড়েছে প্রকাশ্যে। বেশকিছু অনিবার্য প্রশ্নও তুলেছে যার কোনও উত্তর নেই! ফলে প্রবহমান সময়ের নিরিখে ন্যায় বিচারের জন্য প্রতিবাদ-আন্দোলন সামান্য হোঁচট খেলেও তা কিন্তু থেমে যায়নি।
বলাবাহুল্য, পড়ুয়া-চিকিৎসকরা সহ কেউ-ই আইনের উর্ধে নন। তাঁরা সরকারি গাইড লাইন না মানলে অর্থাৎ অন্যায় করলে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আসবেন। এবং তা নিয়ে কারও কিছু বলার এক্তিয়ার নেই। মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা এবং হাসপাতালে কর্মক্ষেত্রে তাঁরা নিয়ম-কানন মেনে চলতে বাধ্য। ‘মেধাবী’ বলে বাড়তি ছাড় পাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আইন সবার ক্ষেত্রেই সমান প্রযোজ্য। যদিও এদেশে তা সব সময় হয় না। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
স্বাধীনতার নামে সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা যেমন কোনওভাবেই বরদাস্ত করা যায় না, তেমনি নিয়ম কানুনের অনাবশ্যক বেড়ি পরিয়ে সংবিধান-সম্মত ব্যক্তি স্বাধীনতাকে টুটি চেপে হত্যা করাও যায় না। একথা যেমন পড়ুয়া-চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ঠিক তেমনি যেকোনও শাসক তথা সরকারের পক্ষেও সমান প্রযোজ্য। কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও না ভাবেন, একপক্ষ এর পূর্ণ সুযোগ নেবেন, অন্যপক্ষ গালে হাত দিয়ে বিষাদচিত্তে বসে থাকবেন-নানাবিধ ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাদেরকে ইচ্ছেমতো ও অন্যায়ভাবে দমিয়ে রাখা হবে, তা যেন না হয়।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আরজি কর-কাণ্ডে কিন্তু তেমনটাই দেখা যাচ্ছে বলে অনেকেরই অভিমত। সংবাদ মাধ্যমে এতদ-সংক্রান্ত যেসব খবরাখবর ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে- তাতে কিন্তু দ্বিচারিতার কথাই ভেসে উঠছে। প্রতিবাদি পড়ুয়া-চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্যভবনের প্রতিশোধ নেওয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত দিকটিই সামনে আসছে বলে অধিকাংশ রাজ্যবাসীর ধারণা। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিবাদের দিকটি চাপা দেওয়ার অনৈতিক চেষ্টা কখনও গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্য বা সুস্থতার লক্ষণ হতে পারে না একথা বলাইবাহুল্য।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘ন্যায্য বিচার’-এর দাবিতে আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকা পড়ুয়া-চিকিৎসকদের ওপর নানাবিধ গুরুতর অভিযোগ তুলে ইতিমধ্যেই তাদের বিরুদ্ধে পুলিশি হেনস্থা শুরু হয়ে গেছে বলে অভিযোগ। কাউকে দিয়ে থানায় অভিযোগ দাখিল করিয়ে দিলেই হল। রাজ্যের ‘নিষ্ক্রিয় পুলিশ’ হঠাৎই সক্রিয় হয়ে উঠছে। ‘গুরুতর অভিযোগ পেয়েও যারা নড়াচড়া করেন না’ বলে রাজ্যবাসীর অভিযোগ- তারাই কেমন গা-ঝাড়া দিয়ে ছুটোছুটি করছেন! বোঝাই যাচ্ছে, সরকার পক্ষ ‘দোষী’দের চিহ্নিতকরণের কাজটি সেরে ফেলেছেন।
এবং প্রয়োজনীয় তদন্তের আগেই তাঁদের বাড়িতে ‘পুলিশি হামলা’র অভিযোগ উঠেছে। থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে পড়ুয়া-চিকিৎসকদের দীর্ঘক্ষণ জেরা করা হচ্ছে। কেউ পাশ না করেই নেমপ্লেটে উচ্চ ডাক্তারি ‘ডিগ্রি’ ব্যবহার করে প্রাইভেট চেম্বার কিংবা বেসরকারি নার্সিংহোমে চিকিৎসা করে চলেছেন, কেউ-বা আন্দোলনের সময় সরকারি হাসপাতালে নির্দিষ্ট কাজে ফাঁকি দিয়ে মোটা টাকার প্যাকেজে অভিজাত বেসরকারি হাসপাতালে রুগি দেখেছেন ইত্যাদি ভুরি ভুরি অভিযোগ। এখানেই অবশ্য শেষ নয়। অভিযোগ আরও আছে।
কী সেই অভিযোগ? মিটিং-মিছিল-বিক্ষোভ-অবস্থান-অনশন-আন্দোলনের সময় দূর-দূরান্ত থেকে সরকারি হাসপাতালে আসা গরিব রুগিদের চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে অনেকে মারাও গেছেন। এমন গুরুতর অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে। রুগি-মৃত্যুর দায়ভার ওইসব পড়ুয়া-চিকিৎসকদের ঘাড়ে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তারাই যেন গোটা সরকারি হাসপাতাল চালান! বরিষ্ঠ চিকিৎসকদের যেন কোনও দায়-দায়িত্ব নেই! সরকারি হাসপাতাল টিকে আছে একমাত্র পড়ুয়া-চিকিৎসকদের ওপর!
অথচ গোটা রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে তাঁদের সংখ্যা মাত্র সাত-আট হাজার। বাকি নব্বই-পঁচানব্বই হাজার বরিষ্ঠ চিকিৎসকরা কী তাহলে ঘুমিয়ে কাটান? রুগিদের কোনওরকম চিকিৎসা পরিষেবাই দেন না? যদি তাই-ই হয়, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে এতদিনে কোনওরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন— এমন প্রশ্নও উঠে এসেছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে। এর যথার্থ উত্তর কিন্তু স্বাস্থ্যভবনকে দিতে হবে। রাজ্যবাসী ভালোভাবেই জানেন, এর কোনও যথার্থ উত্তরই নেই স্বাস্থ্যভবনের কর্তা-ভজা উঁচুপদের অধিকাংশ কর্মকর্তাদের কাছে।
আন্দোলনে যুক্ত থাকা পড়ুয়া-চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে, আরজি কর-কাণ্ডের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনের সময় দেশ-বিদেশ থেকে ‘মোটা অঙ্কের অর্থও তোলা হয়েছে। যার কোনও সঠিক হিসেব নেই! অর্থাৎ আন্দোলনের নামে বিপুল পরিমানে টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। যা কোনওভাবেই মেনে নিতে অপারগ স্বাস্থ্যভবন তথা রাজ্য সরকার। গুরুতর অভিযোগ নিঃসন্দেহে। তবে অভিযোগ তুললেই হবেনা, তার স্বপক্ষে উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণাদি দাখিল করতে হবে। তা নাহলে ভুয়ো অভিযোগ বলে গণ্য হবে।
আর কে না জানেন, ভুয়ো অভিযোগের কোনও মূল্য নেই। অকারণে অপরের চরিত্র হনন ছাড়া যার কোনও প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। দল বা সরকারের প্রতিনিধিরা অভিযোগ তোলার আগে তা ভেবে দেখেছেন কী? মিথ্যে অভিযোগ তুলে নিজেদের জনসমক্ষে হাস্যকর করে তোলার কী সার্থকতা থাকতে পারে তা জানেন না রাজ্যবাসী। মিথ্যেকে বার বার উচ্চারণ করলেই কী তা সত্যে পরিণত হয়? যুদ্ধে বা প্রেমে যা (প্রচারের আড়ালে লাগামহীন অপপ্রচার) হামেশাই চলে-তা কী কোনও দায়িত্বশীল সরকার বা প্রশাসনে চলে?
অথচ এটাই চলে আসছে আজ। দলমত নির্বিশেষে। কোনওরকম রাখঢাক না রেখেই। সাধারণ মানুষকে কী এতোটাই বোকা আর নির্বোধ ভাবেন দল ও সরকার? দেওয়ালে কান পাতার চেষ্টা করেন না বলে তাঁরা নির্বাচনে বড়ো মার্জিনে জিতে আসাটাকেই প্রথম ও শেষকথা বলে মনে করেন! কিন্তু ভোটে জিতে আসাটাই কী সব? গণতান্ত্রিক নীতি-নৈতিকতা বলে কিছু নেই? মানুষের মনের কথা, মানুষের প্রাণের কথা, মানুষের অনুভূতির কথা একবার অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন না? শাসকদল কী সেই বোধটুকুও হারিয়ে ফেলেছে?
বলতে কোনও দ্বিধা নেই, সাধারণ মানুষের মনের কথা, সাধারণ মানুষের প্রাণের কথা, সাধারণ মানুষের অনুভূতির কথা সামান্যতম অনুধাবন করার চেষ্টা করেননি বলেই চৌত্রিশ বছর একটানা রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় থেকেও বাংলার মাটি থেকে প্রায় মুছে গেছেন বামপন্থিরা। সর্বহারার ‘চোখের মণি’ বলে যারা নিজেদের দাবি করতেন, তাঁদের এই করুণ হাল দেখেও আজকের শাসকেরা কোনও শিক্ষাই গ্রহণ করবেন না? ক্ষমতার দম্ভে বুঁদ হয়ে থাকবেন? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চিরদিন কী শাসন ক্ষমতা ধরে রাখা যায়?
একদল আসবেন, একদল চলে যাবেন- এটাই তো গণতন্ত্রের প্রথম ও শেষকথা। এর বাইরে দ্বিতীয় বা বিকল্প কোনও কথা বা পথ নেই। আসলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্থায়ী বলে কিছু নেই। সবই সাময়িক। কিন্তু ওই ‘সাময়িক ব্যবস্থা’কে যারা স্থায়ী বলে ধরে নেন, আখেরে তারাই পড়েন মুশকিলে। যেমন পড়েছেন এদেশের বামপন্থিরা। বিশেষ করে বঙ্গজ বামপন্থিরা। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন মহাকরণ (এখন অবশ্য নবান্ন) ছেড়ে তাঁরা কখনও যাবেন না! যেতে পারেন না! যেভাবেই হোক টিকে থাকবেনই। কিন্তু শেষরক্ষা হয়েছে কী?
স্বীকার্য, সরকারের (রাজনীতি নির্বিশেষে রাজ্য কিংবা কেন্দ্র) চোখে চোখ রেখে কথা বলা কোনও সরকারই-বা মুখ বুজে মেনে নিতে পারেন? আরজি কর-আন্দোলনে পড়ুয়া-চিকিৎসকদের থেকে যা চোখে এসেছে আমাদের। যেকোনও সরকারের পক্ষেই যা অস্বস্তিকর এবং তার বিরুদ্ধে ‘কড়া ব্যবস্থা’ নেওয়ার জন্য সরকার বাহাদুর যে বদ্ধপরিকর-তাঁর প্রকৃষ্ট প্রমাণ দাখিলের (অশুভ) উদ্যোগ-পর্বও শুরু হয়ে গেছে। সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলেই তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। সেই যে কথায় আছে না- ‘মারি অরি/পারি যে কৌশলে!’
কিন্তু গণতান্ত্রিক কাঠামোয় কোনও নির্বাচিত সরকারের পক্ষেই প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহা কোনওভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। সরকার কোনওভাবেই এটা করতে পারেন না। করা উচিতও নয়। কিন্তু এখন উচিত-অনুচিতের কথা কেউ আর ভাবেন না। ভাবার প্রয়োজন বোধও করেন না৷ তাই অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবাদী জনগণের সঙ্গে সরকারের সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। সংসদীয় গণতন্ত্রে যা একেবারেই কাম্য নয়। সহিষ্ণুতা ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে। ফলে জনগণের সঙ্গে যেকোনও সরকারেরই দ্বন্দ্ব বাড়ছে। অবাঞ্ছিত অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।
না, আরজি কর-কান্ডে সরকার-পক্ষের কোনওরকম রাখঢাকের বালাই নেই। সোজা ব্যাটে খেলতেই বেশি পছন্দ করেন আমাদের রাজ্যের সরকার বাহাদুর। ঘোমটার নিচে খেমটা নাচেরও ব্যাপার-স্যাপার নেই। যাকে বলে একেবারে খুল্লাম-খুল্লা আর কী! সরকারপক্ষ এতোটাই অসহিষ্ণু যে গঠনমূলক সমালোচনায় কান দিতেও তাঁরা রাজি নয়! এমন কি, ন্যূনতম সৌজন্যবোধের পরিচয় রাখারও প্রয়োজন বোধ করছেন না। রাজ্যের উপ-নির্বাচনে জয়লাভ করে তাঁরা ভেবেই নিয়েছেন যে, তাদের পিছনে রাজ্যের জনগণ আছেন।
গণতন্ত্রে নির্বাচনই শেষকথা নয়। তাঁর বাইরেও থাকে ন্যূনতম নীতি-নৈতিকতাবোধ। যা পরোক্ষে গণতন্ত্রকে সুস্থ ও সবলভাবে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। তা নাহলে নাম বা ব্যবস্থাপনার মধ্যেই গণতন্ত্র থাকে। বাস্তবে তার কোনও চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের দেশেও হয়েছে তাই! ‘গণতন্ত্রের পূজারি’ বলে গলার সবকটি শিরা ফুলিয়ে জোরালো দাবি করি। কিন্তু সুযোগ পেলেই গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরতে কদাপি পিছপা হই না৷ এই উপমহাদেশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই বুঝি এই! আরজি কর-কাণ্ড তা প্রমাণ করে দিয়েছে।