• facebook
  • twitter
Friday, 27 December, 2024

বিদায় বেনেগাল…

১৯৩৪ সালে সেকেন্দ্রাবাদের একটি সেনানিবাস ত্রিমুলগেরিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্যাম বেনেগাল। পরিবারের দৃঢ় রাজনৈতিক চেতনার মধ্যে বেড়ে ওঠেন তিনি।

১৯৩৪ সালে সেকেন্দ্রাবাদের একটি সেনানিবাস ত্রিমুলগেরিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্যাম বেনেগাল। পরিবারের দৃঢ় রাজনৈতিক চেতনার মধ্যে বেড়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু সিনেমার প্রতি টানটা ছিল শৈশব থেকেই। তাঁর বাড়ির সবচেয়ে কাছের গ্যারিসন সিনেমার প্রোজেকশনিস্টের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন শ্যাম। এতে সুবিধা যেটা হল, প্রোজেকশনিস্টের উইন্ডো থেকেই সমস্ত নতুন রিলিজ হওয়া ছবি দেখে ফেলতে শুরু করলেন বেনেগাল। এই সেলুলয়েডের প্রটি টানেই, দশ বছর বয়সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তিনি ছবিই বানাবেন।

বারোতে পা দিয়েই, বাবার ১৬ মিমি ক্যামেরায়, ‘ছুটিয়োঁ মে মৌজ মজা’ দিয়ে শুরু হল প্রথম ছবি তৈরির কাজ। পরবর্তী সময়ে বেনেগাল দীর্ঘদিন বিজ্ঞাপন তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ন্যাশনাল অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিতে কাজ করতেন, আর সেখানেই তাঁর ভাবী স্ত্রী নীরা মুখার্জির সঙ্গে আলাপ। ওই এজেন্সিতে তাঁর বস ছিলেন অ্যালিক পদমসি, যিনি বম্বের থিয়েটার জগতের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তাঁর সূত্রেই শ্যাম পরে, বিজয় তেন্ডুলকর এবং সত্যদেব দুবের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।

প্রথমবার সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ দেখেই সিদ্ধান্ত নেন, ঠিক কী ধরনের সিনেমা করবেন তিনি। এরপর ‘অঙ্কুর’ ছবিটি যখন ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায়, সকলেই বুঝতে পারেন বাণিজ্যক ছবি নয়- শ্যাম আর্ট হাউস ছবি তৈরিরই পক্ষে। শ্যামের বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি অজানা অচেনা স্টেজ অ্যাক্টরদের অভিনয়ের সুযোগ দিতেন। এইভাবেই তাঁর ছবিতে জায়গা পেতে শুরু করেছিল ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে বেরোনো সদ্য স্নাতকরা। নাসিরুদ্দিন শাহ, স্মিতা পাটিল, ওম পুরী এবং শাবানা আজমি-সহ বহু অভিনেতাই, শ্যামের ছবিতে কাজ করে তাঁদের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন।

বেনেগাল সত্তরের দশকে তাঁর সিনেমার মাধ্যমে মূলধারার বলিউড ছবিকে প্রায় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ফেলেছিলেন। নিশান্ত (১৯৭৫) মন্থন (১৯৭৬) এবং ভূমিকা (১৯৭৭), ‘সমান্তরাল চলচ্চিত্র’ আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠে, ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের জীবনের ভিন্ন এক ছবিকে সামনে এনে ফেলেছিল। ‘অঙ্কুর’-এ যেমন সামন্ততান্ত্রিক বিভাজনের অন্বেষণ করেছিলেন তিনি, অন্যদিকে ‘মন্থন’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন দেশের সমবায় দুগ্ধ দুধ আন্দোলনের গল্পের উপর ভিত্তি করে।

১৯৮০-এর দশকে বেনেগাল জওহরলাল নেহরু রচিত ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া বইটির উপর ভিত্তি করে, নির্মাণ করেন ৫৩ পর্বের একটি ঐতিহাসিক টেলিভিশন সিরিজ ‘ভারত এক খোঁজ’। সম্ভবত তিনিই একমাত্র চলচ্চিত্র নির্মাতা যার বিষয়বস্তু ছিল সমগ্র ভারত।

মুম্বাইয়ের একটি ছোট অফিস ঘরে নিয়মিত বসে কাজ করতেন বেনেগল। কাজের জন্যই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। যাদের কথা কেউ বলে না, তেমন মানুষগুলোর প্রায়ন্ধকার জীবনে, একটা চোরা ফাটলের মধ্য দিয়ে পড়া একফালি রোদ হয়ে উঠেছিল তাঁর ছবি। তাদের আনন্দ, আতঙ্ক, যন্ত্রণা এবং দুর্দশা আমাদের অনুভব করিয়েছিলেন বেনেগাল।

অন্যান্য নির্দেশকদের থেকে বেনেগালের কাজের ধরন ছিল একেবারে আলাদা। তিনি অ্যাক্টরদের স্বাধীনতা দেওয়াতে বিশ্বাস করতেন। ফলে অভিনেতাদের কখনও ধরাবাঁধা নিয়মে ফেলে বলতেন না, কীভাবে অভিনয় করতে হবে, কীভাবে আবেগ ফুটিয়ে তুলতে হবে বা কীভাবে সংলাপ বলতে হবে। শ্যাম তাঁর অভিনেতাদের হাতে চিত্রনাট্য তুলে দিতেন এবং তাঁদের কাজ করতে বলতেন। যদি কোনও অভিনেতা বলেন যে, তিনি দাঁড়িয়ে দু’লাইন সংলাপ বলবেন, তারপর একটি চেয়ারে বসে পরবর্তী দু’লাইন সংলাপ বলবেন- তাতেও শ্যামের আপত্তি ছিল না। তিনি অভিনেতাকে বলতেন, ‘অবশ্যই, এভাবেই করা যাক’। গোবিন্দ নিহলানি, যিনি শ্যামের বেশিরভাগ ছবির শ্যুটিং করেছিলেন, তাঁর ক্যামেরা নিয়ে যা খুশি তা-ই করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। শ্যামজি তাঁকে কখনোই নির্দেশ দিতেন না যে, তিনি কীভাবে শট নিতে চান, বা কেন চান।

শ্যাম বেনেগাল পরে স্টুডিওতে ডাবিং-এ বিশ্বাস করতেন না। ফলে শ্যামের ছবিতে সেট বা লোকেশনে সরাসরি সাউন্ড রেকর্ড করা হতো। ৭০ এবং ৮০-র দশকে যখন দেশের প্রতিটি নির্দেশক, ছবির শ্যুটিংয়ের পরে স্টুডিওতে অভিনেতাদের সংলাপের ডাবিংয়ের উপর নির্ভর করতেন, তখনও শ্যাম তাঁর অভিনেতাদের কেবল একটিই নির্দেশ দিতেন- ‘পরে আর ডাবিং হবে না। সংলাপগুলি লাইভ রেকর্ড করা হবে’। অর্থাৎ থিয়েটারে সরাসরি দর্শকদের সামনে অভিনয় করার মতোই ছিল শ্যামের ছবিতে অভিনয়ের বিষয়টি। ৭০-এর দশকে হলিউডে সিঙ্ক সাউন্ড শ্যুট করার প্রযুক্তি ছিল কিন্তু ভারতে সেই সংস্থান ছিল না। তাই অভিনেতাদের গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে হতো এবং সেটে তাদের সেরাটা দিতে হতো। শ্যাম বেনেগালের কোনও ছবি কখনও ডাবিং-এর পর্যায়ে যায়নি। ঠিক এই কারণেই শাবানা আজমি, অনন্ত নাগ, নাসিরুদ্দিন শাহ, স্মিতা পাটিল এবং শশী কাপুরও, শ্যাম বেনেগালের ছবিতে তাঁদের জীবনের সেরা অভিনয় করেছেন। শ্যামের জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে, ভারতীয় সমান্তরাল ছবির একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গেল।