এই নিয়ে চতুর্থবার পর্দায় চিত্রায়িত হচ্ছে বঙ্কিম উপন্যাস দেবী চৌধুরানী। প্রথমটি হয়েছিল নির্বাক যুগে। পরে আবার ছবিটি তৈরি হয় ১৯৪৯-এ, যেখানে প্রফুল্লর চরিত্র করেছিলেন সুমিত্রাদেবী। দীনেন গুপ্তর নির্দেশনায় দেবী চৌধুরানীর তৃতীয় ভার্সান তৈরি হয়েছিল ১৯৭৪ সালে, যেখানে নামভূমিকায় ছিলেন সুচিত্রা সেন ও ভবানী পাঠকের চরিত্রে বসন্ত চৌধুরী। এবার তাঁর নিজের মতো করে এই ছবিটি পর্দায় তুলে ধরতে চান ‘অভিযাত্রিক’-এর চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্র। প্রযোজক হিসাবে রয়েছেন এডিটেড মোশন পিকচার্স এবং লোক আর্টস কালেকটিভ। এটি অফিশিয়ালি ভারত-ইউকে যৌথ উদ্যোগে নির্মিত প্রথম আঞ্চলিক ছবি।
এর আগে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘অপরাজিত’-এর শেষ অংশ ও সত্যজিৎ রায়ের ক্লাসিক ‘অপু ট্রিলজি’-র সিক্যুয়েল অবলম্বনে তৈরি তাঁর ছবি ‘অভিযাত্রিক’-এর জন্য জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছিলেন শুভ্রজিৎ। তারপর থেকেই, দর্শকদের তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশা বেড়েছে। ‘দেবী চৌধুরানী’ ছবিটি তৈরির নানা বিষয় উঠে এল এই সাক্ষাৎকারে।
পঞ্চাশ বছর পরে যখন আবার ‘দেবী চৌধুরানী’ তৈরি হচ্ছে, তখন এটা কীভাবে এবং কতটা আলাদা হবে বলে আমরা আশা করতে পারি?
এর আগে যে-তিনবার ‘দেবী চৌধুরানী’ পর্দায় এসেছে, তিনবারই কিন্তু সুপার সাকসেসফুল হয়েছে। আমার যে-‘দেবী চৌধুরানী’, এটা কিন্তু ইন্টারপ্রিটেশনের দিক থেকে একদম আলাদা। কারণ এটা মোর অফ আ হিস্ট্রি, রাদার দ্যান আ নভেল। আগেরগুলো সবই ছিল ট্রু টু দ্য নভেল।
আমরা যদি ইতিহাস দেখি, ঘটনার পটভূমি হচ্ছে ১৭৭০ থেকে ১৭৮০। বঙ্কিমচন্দ্র এই উপন্যাস লিখেছিলেন তারও ১০০ বছর পরে। ফলে এটা জনশ্রুতি এবং তাঁর কল্পনা দুইয়ে মিলিয়ে রচিত হয়েছিল। আমার ছবির ক্ষেত্রে আমি ওই টেক্সট-এর বেসিক স্ট্রাকচারটা রেখেছি, ক্যারেক্টার ও তাদের ট্রেটসগুলো অনুসরণ করেছি। কিন্তু তারপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে-রেকর্ড এবং যে সব জনশ্রুতি রয়েছে, সেগুলো সংগ্রহ করে গল্পটাকে নিজের মতো করে বুনেছি। এটা ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ বলতে পারেন। কারণ উপন্যাসের ঘটনা এবং ইতিহাসবর্ণিত ঘটনাগুলো কিন্তু অনেকটাই আলাদা। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন ‘ভবানী পাঠক ধীরে ধীরে প্রফুল্লকে দেবী চৌধুরানীতে রূপান্তরিত করিল।’ কিন্তু কীভাবে রূপান্তরটা হল, সেটাই আমার ছবির প্রধান উপজীব্য।
এই যে বিপুল গবেষণা, এটার জন্য কি আলাদা টিম ছিল?
গবেষণা আমি একাই করি। ওটা আমার প্যাশন। ‘অভিযাত্রিক’-এর ক্ষেত্রেও তা-ই করেছিলাম। আমার পরের তিনটি ছবিও পিরিয়ড পিস-ই হতে যাচ্ছে। এটা আমার সিগনেচার, একটা ক্লাসিক উপন্যাসকে নিয়ে তার ইতিহাসটাকে মিশিয়ে ছবি তৈরি করি। এক্ষেত্রে আমার ইন্সপিরেশন আকিরা কুরোসাওয়া এবং রিডলি স্কট। ‘গ্লাডিয়েটর’ সিনেমার ক্ষেত্রে যেমন স্কট, লোককথার সঙ্গে রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে মিশিয়ে পিরিয়ড পিস ক্রিয়েট করেছিলেন। এই ধরনটা আমাদের ভারতীয় ছবির ক্ষেত্রে সাধারণত অ্যাটেম্পট করা হয় না। হয় সেটা ফিকশনালাইজ করে লার্জার দ্যান লাইফ করে তোলা হয়। নয়তো অভয়েড করা হয়।
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মতো স্টারকে ডিরেকশন দেওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন?
বুম্বাদা প্রফেশনালিজিমের চূড়ান্ত এবং সেটাই কারণ যে ইন্ডাস্ট্রিতে এই জায়গাটা উনি সাফল্যের সঙ্গে ধরে রাখতে পেরেছেন। ওঁকে আমি আমার আঠারো বছর বয়স থেকে চিনি। উনি আমা দাদা এবং মেন্টর। আমি মনে করি অ্যাক্টররা পাপেটস নন। ফলে আমার টেকনিকাল গাইডলাইন সবসময়ই থাকে। কিন্তু বুম্বাদার সেট-এ প্রচুর নিজস্ব ইনপুট থাকে। আমার থেকে ডিটেইলে সিন এবং চরিত্রের ট্রেইট বুঝে নেন। তারপর ইম্প্রোভাইজেশন করেন আমার সঙ্গে অলোচনা করে। এই বিষয়গুলো নবাগতদের সত্যিই বুম্বাদার থেকে শেখা উচিত।
এই ছবির ট্রিটমেন্টের বিষয়ে একটু বলুন।
এটা কমপ্লিট ফিকশন, ফলে একেবারেই মেইনস্ট্রিম ট্রিটমেন্ট করতে হয়েছে। এটার এত বড়ো বাজেট এবং যেহেতু এর সঙ্গে বুম্বাদা বা শ্রাবন্তীর মতো স্টাররা ইনভলভড, সেখানে ছবির প্রেজেন্টেশনটা খুব ইমপর্ট্যান্ট। যাতে অনেক বেশি মানুষের এটা ভালো লাগে। আমি হিস্টোরিকাল রিকনস্ট্রাকশনের বিষয়টাকেই প্রাধান্য দিয়েছি।
এবারের ছবির লোকেশন ও শুটিংয়ের উল্লেখযোগ্য বিষগুলি কী ছিল?
পুরুলিয়া, বীরভূম, ঝাড়খণ্ড, বিহার এমন নানা জায়গায় লোকেশন ছিল। প্রায় ৩২ দিনের শুটিং ছিল তিনটি পর্বে। ১৮০ জন ক্রু মেম্বার ছিলেন। কয়েক দিন তাঁদের সংখ্যাটা ৩৫০ পেরিয়েছিল। প্রতিদিনই ঘোড়া ছিল, গরু, ষাঁড়ও ছিল কিছু। ঘোড়াদের নিয়ে বেশ নাজেহাল হতে হয়েছে একেক দিন। কারণ এই প্রাণীগুলি খুবই মুডি। পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা বেস ক্যাম্পে, মেক শিফট ড্রেসিং রুম করে শুটিং সারতে হয়েছে।
মুম্বইতে যেভাবে সঞ্জয় লীলা বনশালী কিংবা দক্ষিণী ছবির নির্দশকরা যে সব ম্যাগনাম ওপাস তৈরি করতে পারেন, কারণ বাজেট সেখানে কোনও অন্তরায় নয়। টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিতে সেটা আশা করা যায় না। ফলে কতটা কম্প্রোমাইজ করতে হল?
সেটা সত্যি কারণ ওঁদের একটা সিনে আমাদের চারটে ছবি হয়ে যাবে (হাসি)। জার্নির শুরুতে আমি যে-স্কেলে ছবিটা ভেবেছিলাম, খুব স্বাভাবিক প্র্যাক্টিকাল ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব ছিল না। যখন রেকি হচ্ছে বা বাজেট রিভিশন হচ্ছে, তখন অনেক কিছুতে আমাদের বেন্ড ডাউন করতে হয়েছে। অনেক সময় বাজেট অপ্রতুল বলে, বুদ্ধি দিয়ে সেই এফেক্টটা অ্যাচিভ করতে হয়েছে। হলিউড লেভেলে হয়তো করা গেল না, কিন্তু মানের নিরিখে খুব খারাপ তো করা যায় না। কারণ দিনের শেষে এটা একটা প্রোডাক্ট। যে-বাজেট এটাতে ব্যয় হয়েছে, বাংলা ছবিতে সাধারণত সেটা হয় না। ফলে নির্দেশকের একটা দায়িত্ব বর্তায় লগ্নিটা যাতে ফেরত আসে।
আমাদের ডিওপি অনির্বাণ চ্যাটার্জি, ‘পদ্মাবত’ এবং ‘বাজিরাও মস্তানী’ ছবির অপারেটিভ ক্যামেরাপার্সন ছিলেন। উনি ওই স্কেল এবং ভিজ্যুয়ালাইজেশনটা হ্যান্ডেল করেছেন। এখানে রিসোর্স কম হলেও, টেকনিকালি ওই গ্র্যাঞ্জারের কতটা কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায় সেটা উনি জানেন। সুতরাং আমরা চেষ্টা করেছি একটা লার্জার দ্যান লাইফ ফিল্ম তৈরি করার। এটুকু বলতে পারি যে, শেষ দুই দশকে এইরকম ক্যানভাসের ছবি বাংলাতে আসেনি।