বৃহত্তর উৎসবের আড়ালে লৌকিক দেব-দেবী

প্রতীকী চিত্র

সুলেখা সরকার

প্রাচীন বাংলার লোকায়ত মন লৌকিক দেবদেবীকে আবিষ্কার করেছে  মাঠ-ঘাট, পথ, গোয়াল, জনপদ এবং গৃহের অভ্যন্তরে। লোকদেবতা উদ্ভবের মূলে আছে আদিম টোটেম, ট্যাবু ও ঐন্দ্রজালিক বা যাদুবিদ্যার প্রভাব। বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গিতে লোকদেবতাদের অশাস্ত্রীয়, অপৌরাণিক মনে করা হলেও এরা সম্পূর্ণরূপে লোকজীবনেরই অঙ্গ। যদিও ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে বেশ কিছু দেবদেবীর মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও প্রাচীন নামের পরিবর্তন হয়েছে। তবে এ কথা ঠিক, অনার্য সংস্কৃতিতে গ্রামীণ আদিবাসী সমাজে এই অকুলিন লোকদেবতারা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত ছিল।

এই বিষয়ে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে লৌকিক দেবতার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ড. মিহির চৌধুরী কামিল্লা তাঁর ‘আঞ্চলিক দেবতা ও লোকসংস্কৃতি’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘আঞ্চলিক দেবতাদের জন্মের মূলে আছে এক বিশেষ শ্রেণীর সংস্কার ও বিশ্বাস কিন্তু সেই গূঢ় রহস্য ছাড়াও প্রতি দেবতাকে ঘিরেই পুরুষানুক্রমে গড়ে উঠেছে নানা রকম লোকসংস্কার ও লোকবিশ্বাস’। শাস্ত্রীয় পরিভাষায় গ্রামীণ দেবদেবীরা ব্রাত্য ও পতিত দেবতা। সমস্ত যুক্তিতর্কের বাইরে লোকায়ত বিশ্বাস ও আন্তরিকতার গভীরে এদের জন্ম, অবস্থান এবং প্রচলন। আসলেই তারা আঞ্চলিক, গ্রাম্য ও ব্রত দেবতা।


অঞ্চলভেদে লৌকিক দেবদেবীর রূপ এবং আঙ্গিক পরিবর্তন দেখা গেলেও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে প্রায় সবাই সমান। সাধারণত মূর্তির গড়ন ও রং, লোকাচারের বিভিন্নতা, মন্ত্র মিশ্রিত ভাষা প্রয়োগ এবং প্রায় অর্থহীন লৌকিক শব্দের ব্যবহার দেখা যায় লৌকিক মন্ত্রগুলিতে। অনেক ক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষার প্রভাব ও প্রাধান্য থাকলেও স্থানীয় উপভাষায় মন্ত্রপাঠ হয়। গ্রামের উন্মুক্ত স্থানে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে লোকদেবতার পুজো হয়। আমরা জানি, হিন্দু ধর্মের উদ্ভবের পূর্ববর্তী সময় থেকে হিন্দু বাঙালির লোকাচার ও ধর্মবোধে গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ দেবতা হলেন শিব। যখন প্রাগার্য আদি ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ঋগ্বৈদিক আর্য সংস্কৃতির বিমিশ্রণে হিন্দু ধর্মের জন্ম হয় তখন শিব ছিলেন তার প্রধান তিন পুরুষ দেবতার অন্যতম প্রধান দেবতা। এবং প্রাগার্য মাতৃকা দেবী তখন শক্তিতে পরিণত হলেন।

উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে বসবাসকারী কোচ, মেচ, থারু, ধিমাল, রাভা, লিম্বু, লেপচা, ওরাওঁ, কুকি, সাঁওতাল এবং অন্যান্য উপজাতিদের মধ্যে এখনো লৌকিক দেবদেবীর প্রাধান্য লক্ষণীয়। প্রত্যেকটি উপজাতির নিজস্ব লোকাচার, দেবদেবী এবং পুজোর নিয়মনীতি আছে যেগুলি তাদের নিজস্ব সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যা বর্তমান আধুনিক সভ্যতার প্রভাব ও নগরোন্নয়নে ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। যেমন—

সিজ বৃক্ষ বা জ্ঞান বৃক্ষ : লোকশ্রুতি অনুযায়ী সিজ বা সিজৌ বৃক্ষটির সর্বপ্রথম জন্ম মানস সরোবরের মরু অঞ্চলে। সিজ শব্দের অর্থ ‘সিন্ধু’। এটি সৃষ্টির প্রথম জীব। সৃষ্টিকর্তা তাঁর আত্মাকে বৃক্ষরূপে প্রতিষ্ঠা করে নিজেই আবির্ভূত হয়েছিলেন পৃথিবীতে। সৃষ্টির আদি-প্রাণ সিজ বৃক্ষের মধ্যে পঞ্চতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত আছে বলে মনে করা হয় যেমন, পঞ্চজীবন, পঞ্চপ্রাণ, পঞ্চআত্মা এবং পঞ্চশক্তি। ফণীমনসা জাতীয় গাছের কাণ্ডটিতে পাঁচটি নালার মতো খাদ থাকে। খাদের পিঠ ও পিঠে অসংখ্য জোড়া কাঁটা থাকে। মূল গাছের কাণ্ড থেকে শাখা-প্রশাখা বের হয়।
শাখা-প্রশাখা এবং কাঁটাগুলি দেবদেবী ও প্রাণীকুলের প্রতীক। ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে, রান্না ঘরের পাঁচ হাত দক্ষিণে বাথৌ ধানশালী বা বাথৌ মন্দিরে গোলাকার বেদি তৈরি করা হয়। যার আকৃতি পৃথিবীর মতো এবং ব্যাসার্ধ ১৮ ইঞ্চি। বেদির চারদিক ছোটো ছোটো খুঁটি ও পাঁচজোড়া পাতলা বাতা দিয়ে ঘেরা হয়। বেড়ার ভেতর মাটি দিয়ে বেদি নির্মাণ করে সিজ বৃক্ষটি মাঝখানে গেঁথে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়। কথিত আছে, নির্মিত মন্দিরের পঞ্চ বান্ধ বা বন্ধন ৫টি দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আকর্ষণে গ্রহ- নক্ষত্র যেমন একই কক্ষপথে আবর্তন করে তেমনি প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া-মমতা, দয়া ও করুণাজনিত ইন্দ্রিয়জাত বন্ধন, চরিত্রগত স্বভাব, লোভ-লালসাজনিত সম্পর্ক সবই হল সংসারের মায়া।

একইভাবে মনুষ্যজীবনও  সুখ-দুঃখের ভেতর আবর্তন করে। এই পুজোয় ‘চিফুং’ (লম্বা বাঁশি) বাজানো হয়। দ্বারেন ঈশ্বরারীর প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ‘চিফুং’ বাঁশির প্রথম ছিদ্রটি হল ভগবত মুখ। এই ছিদ্রে বীরাই বাথৌ প্রথম বীজমন্ত্র ‘আহাম’ (ওঁ) শব্দটি ফুঁ দেন।

থাইগির বা পাঁচখল ফলের ভেতরে থাকা বীজ থেকে সিজ বৃক্ষের বংশবিস্তার হয়। এই বীজেই বাথৌ ধর্মের পঞ্চতত্ত্ব সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এছাড়াও রয়েছে পঞ্চঅবস্থা যেমন, মাতৃগর্ভের স্থিতি, জন্ম, মৃত্যু, যৌবন ও বার্ধক্য। মেচদের বিশ্বাস, অঙ্কুরিত আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটলে ফলের মধ্যে নিহিত পঞ্চতত্ত্বকে উপলব্ধি করা যায়।

টিউগ্যাপ : ‘টিউগ্যাপ’ একটি নক্ষত্রের নাম। ডুকপা সম্প্রদায় এই নক্ষত্রের পুজো করে। ভুটান থেকে আগত ডুকপা জনগোষ্ঠী ভারতে সরকারি কাগজপত্রে ‘ভোটিয়া উপজাতি’ হিসেবে চিহ্নিত। জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত বক্সাদুয়ারে এদের বসবাস। দুর্গাপূজার দু’সপ্তাহ আগে ডুকপাদের ‘টিউগ্যাপ’ উৎসব শুরু হয়। এই উৎসবে তাদের একটি নিজস্ব আধ্যাত্মিক ভাবনা আছে। তাদের ধারণা, পুজোর দিন ‘টিউগ্যাপ’ নক্ষত্রটিকে আকাশে দেখা যায়। সেদিন এই নক্ষত্রটি পৃথিবীর সকল জলাশয়ে জন্ম নেয়া জীবাণুগুলো থেকে জলাশয়গুলিকে মুক্ত করে দেয় ফলে পরদিন ডুকপাদের সকলে নগ্ন হয়ে নদীতে, ঝোরায় স্নান করে। স্নানের পর লামারা পুজো করে। পুজো শেষে মাখন, চিনি ও ছাং দিয়ে তৈরি প্রসাদ খাওয়া বাধ্যতামূলক। পুজোর দিন বিকেলে চলে তীর খেলা এবং নাচ-গান।

ঋষি-জগ : রাভাদের প্রধান দেবদেবীর মধ্যে ঋষি-জগ অন্যতম। ঋষি-জগের কোনও মূর্তি না থাকলেও ঋষিকে শিব এবং জগকে কালী বলে ধরে নেওয়া হয়। সাধারণত বিবাহ অনুষ্ঠানের পূর্বে মঙ্গল কামনার্থে আবার কখনো কখনো প্রায়শ্চিত্ত করার প্রয়োজনেও এই পূজোর আয়োজন করা হয়ে থাকে। প্রতিবছর বৈশাখ মাসে ঋষি-জগের পুজো হয়। রাভাদের ঘরে চদং-এর (মাচা) ওপরে গৃহদেবী ‘রুণতুক’-এর প্রতীক হিসেবে মাটির কলসি রাখা হয়। সেখানেই ঋষি-জগের পুজো করা হয়, জায়গাটিকে ‘একরার’ দিয়ে ঘিরে একটি বাঁশের গা থেকে চাঁচলা আলগা করে ফুলের মতো তৈরি করে সেই দণ্ডটি চালের বাতায় টাঙানো হয়। ঘরের দেওয়ালে পিটুলির গোলা ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং এই গোলা দিয়ে একটি আয়তক্ষেত্র তৈরি করে সেটি কোণাকুণিভাবে চার ভাগ করা হয়। পুজোর উপকরণ হিসেবে থাকে দুই ঝুঁকি ১৬ টিয়া মনুয়া কলা, আতপ চাল, দই-চিড়ে, চকত ও চিকা। যিনি পুজো করেন তাকে ‘হুজি’ বলা হয়। যিনি ‘হুজি’কে সহায়তা করেন তিনি ‘মতক’।

‘মতক’-এর কাজ মুরগি ও শুয়োর বলি দেওয়া এবং পুজোর জোগাড় করা। বলিপ্রদত্ত রক্ত কলাপাতা করে ঋষি-জগের পূজোয় দেওয়া হয়। রাভাদের ধারণা, এই পূজো করলে পরিবার ও গৃহের মঙ্গল হয়।

খ্যাপ্পা সঙ পুজো : পিতৃপুরুষের স্মরণে তামাঙ পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুরুষ অঘ্রাণ, ফাল্গুন ও জ্যৈষ্ঠ মাসে গমের আটা জল দিয়ে মেখে ডেলা তৈরি করে। সেই ডেলা দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ হয়। একে বলে ‘তরশো’। কোনও ক্ষেত্রে পাথরকেও মূর্তি হিসেবে পুজো করা হয়। পূর্বপুরুষের প্রতীক হিসেবে ধূপকাঠি এবং পূর্ণপাত্র জল রাখা হয়। ১৮৬৪-৬৫ সালে সমগ্র ডুয়ার্স ব্রিটিশ অধিকারভুক্ত হলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৭৬ সালে ঘন জঙ্গল কেটে চা বাগান শুরু করে এবং রাঁচি, সিংভূম, হাজারীবাগ ও নেপালের তেমাল, ওয়াফল, থংমাল ও অন্যান্য স্থান থেকে প্রচুর শ্রমিক ডুয়ার্সে নিয়ে আসে। উপরন্তু কারণ হিসেবে সেই সময় নেপালে সামন্ত রাজার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েও নেপালিদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে তামাঙদের অনেকে উত্তরবঙ্গে চলে আসে এবং চা শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত হয়। ক্রমে দার্জিলিং জেলার চা বাগান অধ্যুষিত এলাকাতে এবং ডুয়ার্স অঞ্চল জুড়ে তাদের সামাজিক, ব্যবহারিক জীবন শুরু হয়। ভাষা-সংস্কৃতির পাশাপাশি জন্ম নেয় ধর্মবিশ্বাস, পুজোপার্বণ। তামাঙদের মধ্যে ‘দোঙ’ গোষ্ঠীর লোক এই পুজোয় যত পূর্বপুরুষের নাম জানা আছে তাদের স্মরণ করে মন্ত্র উচ্চারণ করে। এই পুজোকে তারা ‘দেলা’ বলে। অনেকে ‘খ্যাপ্পা সঙ’ পুজোকে ‘কুলপুজো’ বা ‘যাওলা লাসু’ বলে। পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে তাদের কাছে ক্ষেতের ফসল, গৃহপালিত পশুপাখি রক্ষার আশীর্বাদ ও কৃপাদৃষ্টি প্রার্থনা করে তারা। ডুয়ার্সের চা-বাগান এলাকার তামাঙরা মহালয়া থেকে দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন পর্যন্ত এই পুজো-অনুষ্ঠান করে। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ই খ্যাপ্পা সঙ পুজোয় অংশগ্রহণ করতে পারে। উপকরণ হিসেবে থাকে আতপ চাল, ফলমূল, পান-সুপারি, টোটলা, ধুপকাঠি, সিঁদুর, ফুল, জার (ঘরে তৈরি মদ)। পুরোহিত স্নান সেরে নতুন বস্ত্র পরিধান করে পুজো করেন। মুরগি বলি প্রথা প্রচলিত। পুজো শেষে খাওয়া দাওয়া ও আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে তামাঙরা।

দুঃখের বিষয়, তামাঙরা যেহেতু ‘বোনপো’ তান্ত্রিক তাই বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে এই পুজোর প্রচলন তুলনামূলকভাবে কমে গেছে।

কামাখ্যা পুজো: রাভা উপজাতি কামাখ্যা এবং কালীকে অভিন্ন দেবী বলে মনে করেন। কামাখ্যা মায়ের পুজো কামাখ্যাগুড়ির দেড়শো বছরের প্রাচীন কামাখ্যাধামে হয়ে থাকে। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী প্রতিবছর অম্বুবাচীতে এখানে বিরাট মেলা বসে। এটি রাভাদের স্থানীয় প্রিয় উৎসব। কামাখ্যাধামটির নামকরণ সম্পর্কে যে প্রাচীন উপকথা প্রচলিত আছে তা হল, কামতা রাজ্যের মহারাজা শিকার করতে এসে একদিন হাতি সমেত কাদাযুক্ত বিলে ডুবে যান। সেই সময় মা কামাখ্যার কৃপায় হাতি এবং তিনি বিপদমুক্ত হন, প্রাণে বেঁচে যান। প্রতিশ্রুতবদ্ধ হন যে, প্রতিবছর অম্বুবাচীর দিন তিনি এখানে মা কামাখ্যার পূজো করবেন এবং সেই পুজোর সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করবেন কোচবিহারের মহারাজা। সেই থেকে রাজন্যপ্রথা বিলুপ্তির পূর্ব পর্যন্ত এই প্রতিশ্রুতি কার্যকরী হয়েছে। তিথি অনুযায়ী প্রতিবছর আষাঢ় মাসের ১১ তারিখ মায়ের পুজো হলেও লোকাচার অনুসারে বাঁশ জাগানো হয় জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৫ তারিখের আগে। এখানে দেবীর ৬টি মাথা, ১২টি হাত, বাহন সিংহ। পুজোর উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয় আতপ চাল, দূর্বা, ফুল, তুলসী পাতা, আমের ডাল, জাত রাসির পাতা, কলা ১৬ টিয়া এক ঝুড়ি, সর্ষের তেল, সিঁদুর, প্রদীপ, দই, দুধ, কাঁঠাল, শশা, বাতাসা, ঘট ইত্যাদি। পুজো শেষে কলার ভেলায় পাঁঠা ও একজোড়া কবুতর ভাসানো হয়। তবে এক সময় রাভারা এই পুজোয় পাঁঠা, কবুতর বলি দিত। এখন শুধু পায়রা ভাসানো হয়। এই পুজো উৎসর্গ করেন ‘মাড়োয়া’। রাজবর রাভা ছিলেন রাভা সমাজের প্রথম ‘মাড়োয়া’। পরবর্তী ‘মাড়োয়া’রা হলেন ভৈচালু রাভা, দীন রাভা, হুকুমদাস রাভা, কালীচরণ রাভা, মনমোহন রাভা, রজনী রাভা। দীন রাভার সময় পর্যন্ত শুধুমাত্র রাভা সম্প্রদায়ের মানুষরাই কামাখ্যা মায়ের পুজো করতে পারতো, কিন্তু তারপর থেকে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ কামাখ্যা মায়ের পুজো দিতে পারেন।

গো-দেবতা : কৃষি বিষয়ক পুজো। কথিত আছে গো-দেবতাকে তুষ্ট করলে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তাই কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে গরুকে স্নান করিয়ে, শিংয়ে তেল মাখিয়ে, কপালে

সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে গরুটিকে ভালো ভালো খাবার পরিবেশন করা হয়। গরুকে গো-দেবতা হিসেবে পুজো করার অনুষ্ঠানটিকে ওরাওঁরা ‘সোহরাই’ উৎসব’ বলে থাকে।

দরিচেক মিট্ দে : গর্ভবতী নারীর সুস্থতা কামনায় গারো সমাজে এই পুজো প্রচলিত। গারোদের ধারণা, এই পুজো করলে গর্ভস্থ সন্তানের অমঙ্গল হয় না, গর্ভপাতের ভয় থাকে না, সুষ্ঠুভাবে সন্তান জন্ম নেয়। পুজোর উপকরণ হিসেবে একটি লাল রঙের মোরগ, একটি লাল রঙের কুকুর এবং ‘চু’ (হাতে তৈরি মদ) লাগে। এই পুজোর বিশেষত্ব হল, পুজোর সময় ‘খামাল’ অর্থাৎ পুরোহিত অদৃশ্য দেবীর বিরুদ্ধে হাতে ধারালো অস্ত্র, ঢাল-তলোয়ার নিয়ে নাচের তালে যুদ্ধের অভিনয় করে। কুকুর বলি হয়। অতঃপর বলি দেওয়া লাল কুকুরটিকে রাস্তার মাঝখানে পুঁতে দেওয়া হয়।

সোনারায় ঠাকুর : এই দেবতার পুজোর প্রসাদ চিঁড়ে, মুড়কি, খই ও পায়েস। চাঁই-রা সারাটা পৌষ মাস ধরে হাতে বড় লাঠি নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ‘সাঁকোল’ গান গায় এবং দান হিসেবে যে অর্থ পায় তা সঞ্চয় করে সোনারায়-এর পুজো করে। মেয়েরা কলা গাছের খোল দিয়ে নৌকো তৈরি করে নৌকাটিকে ফল-ফুল দিয়ে সাজায়। এর ভেতর হলুদ কাপড়ের পুঁটুলি দিয়ে কাল্পনিক কন্যা তৈরি করে বন্যার জলে নৌকোটি ভাসিয়ে দেয়। একে ‘কানিয়া ভাসা’ বলে। নৌকো তৈরি করা থেকে নৌকো সাজানো এবং ভাসানো পর্যন্ত মেয়েরা কানিয়া ভাসানোর গান গায়।

‘…কানিয়া গে…
হুড়িয়া গে
মাট্টিকে তল্ তল্ য্যাইহ্যান গে,
ওথরি দেবাও
সামার্ট দেবাও
চুড়া কুটকুট খ্যাইহ্যান গে…’

গ্যাংরাজা : যখন ক্ষেতে হৈমন্তী ধানের থোড় আসে তখন ভালো ফসলের আশায় ও পোকামাকড়ের হাত থেকে ফসল বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে রাভা কৃষকরা গ্যাংরাজার পুজো করে। আশ্বিন মাসের শেষভাগে সন্ধ্যায় ধানের ক্ষেতে এই পুজো করা হয়। ক্ষেতের মধ্যে একটি জায়গায় চারটি খুঁটি পুঁতে ‘চদং’ অর্থাৎ মাচা তৈরি করে সেই মাচার ওপর দুটি কলার খোলায় আতপ চাল ও কলা দেওয়া হয়। ‘চদং’-এর চারপাশ সাজানো হয় যাত্রাসির পাতা দিয়ে। হাঁস বলি দেওয়ার প্রথা চালু আছে । হাঁসের মাংস চাল ও মশলা দিয়ে রান্না করে ‘চকৎ’ (মদ) সহযোগে গ্যাংরাজা’র উদ্দেশে নিবেদন করা হয়।

চুসুমী মিট্ দে : শরীরে কোনও বিকৃত অঙ্গ থাকলে বা দেহের কোনও অংশে ক্ষত তৈরি হলে বুঝতে হবে এটি চুসুমী মিট্ দে দেবতার অসন্তুষ্টি বা ক্রোধের ফলাফল। গারো সমাজের ধারণা এই দেবতার প্রতি উৎসর্গ নিবেদন করলে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। পুজোর উপকরণগুলি হল, একটি শূকর, একটি লাল মোরগ এবং হাতে তৈরি ‘চু’ (মদ)। বলি দেওয়া শূকর এবং মোরগের রক্ত দেবতার উদ্দেশ্য নিবেদন করা হয়। পুজো শেষ হলে

‘মিই-ব্রেং’ তৈরি করা হয়। ‘মিই-ব্রেং’ হল বাঁশের চোঙ-এর ভেতর চাল দিয়ে আগুনে জাল দিয়ে রান্না করা ভাত। বলি দেয়া মোরগের মাংস এবং ‘মিই-ব্রেং’ প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হয়।

সারণা দেবী : কুরুখ-ভাষী ওরাওঁদের উল্লেখযোগ্য ধর্মানুষ্ঠান ‘সারণা’। প্রচলিত আছে, যে বংশের লোক প্রথম জঙ্গল কেটে একটি নির্দিষ্ট গ্রামের পত্তন করে, সেই বংশের আদি মাতা হন সেই গ্রামের ‘সারণা দেবী’। প্রত্যেক গ্রামের সারণা দেবীর আলাদা নাম আছে। চৈত্র-বৈশাখ মাসে শুক্লপক্ষে শাল গাছের নিচে একটি নির্দিষ্ট পরিছন্ন জায়গায় ‘সারণা’ পুজো বা ‘সারণা’ নৃত্যে শুধুমাত্র পুরুষরা মাদল ও ধামসা বাজিয়ে অংশগ্রহণ করে। এখানে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।

নাহেন ক্ষমা : শত্রুতা, চক্রান্ত ইত্যাদি বিপদ থেকে অব্যাহতি পেতে লিম্বুরা চৈত্র বা কার্তিক মাসে মঙ্গল অথবা শনিবারে বিকেল বেলা এই পুজো করে। বাড়ির উঠোনের দক্ষিণ দিকে দু’ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট পাথরকে মূর্তি হিসেবে পুজো করা হয়। পাথরের চারদিকে ধারালো চারটি বাঁশের খুঁটি ‘পহেঙ’ পোঁতা থাকে, পুজোর পাথরটিকে বলা হয় ‘লুঙ’। পুজোর উপকরণ হিসেবে থাকে মাংলোক (ভেরেন্ডা গাছ), ইয়েনফা (এক ধরনের বাঁশ), ৯টি ‘মুক্তো’র ডাল। ‘মুক্তো’র ডাল পাওয়া না গেলে বাঁশের বাতা ব্যবহার হয়। এছাড়াও থাকে ঘরে তৈরি মদ ‘মাঙদংথি’। পাথরের সামনে কলাপাতা বিছিয়ে দেওয়া হয় যাকে বলে ‘লাজম’। ‘লাজম’-এর ওপর মুরগির ডিম, আতপ চাল, কাঁচা টাকা ও দূর্বা ঘাস রাখা হয়। পুজোতে ৮ প্রকার অস্ত্র উপকরণ হিসেবে রাখতে হয়। কাঙ্ (কোদাল), ভেজা (খুকরি), ফোংলা (লোটা), ইউপ্পা (রুপো), ওয়াদি (লম্বা ধরনের দা), অতি (কুড়াল), সাঙ ইয়াং (সোনা), হুকসঙ (কাঁসার বাটি), চেথিয়া (কাঁসার থালা) ইত্যাদি। লাল রঙের মোরগ বলি হয়। পুজোর সময় মুরগির ডিম এবং মোরগটিকে ভক্তদের কপাল, বুক, কাঁধ ও হাঁটুতে ছোঁয়ানো হয়। মোরগের দু’চোখে তিরবিদ্ধ করে মোরগটিকে বলি দিয়ে তিরসহ মোরগের মাথা আলাদা করে দেবতা পাথরের ওপর মোরগের রক্ত দেন লিম্বু ‘ইয়োরা’(পুরোহিত)। পুরোহিতের অবর্তমানে ‘ফেদাংমা-রাও’ এই পুজো করে। আধঘন্টাব্যাপী মন্ত্র উচ্চারণে এই পুজো সম্পন্ন হয়। একে ‘মুন-ধুম-ক্ষমা’ বলে। এই পুজোতে লম্বা বাঁশের সঙ্গে ৪টি তির-ধনুক বাঁধা থাকে। বাঁশের মাথাটি ধারালো থাকে। ধারালো অংশে মোরগের মাথা এমনভাবে লাগিয়ে দেওয়া হয় যাতে মাথাটি পূর্বদিকে মুখ করে থাকে। পৃথিবী যাতে দ্বিখণ্ডিত না হয় এই প্রার্থনায় পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণ করে বাঁশটিকে মাটিতে পুঁতে দেন। এই সময় পুরোহিতকে এক বোতল মদ এবং ১০১ টাকা দিতে হয়। বলির মাংস পুরোহিত একাই খান। ভক্তদের খাবার নিয়ম নেই।

মহাকাল : বৈশাখ অথবা আষাঢ় মাসে গৃহস্বামী ও পরিবারের মঙ্গল প্রার্থনায় রাভা পরিবার মহাকালের পুজো করে। ঘরের বাইরে উত্তর-পূর্ব দিকে (রাভা ভাষায় যাকে বলা হয় ‘মুপাকপির’) পান পাতা হয়। এই পুজোর কোনও নির্দিষ্ট বার বা তিথি নেই। মুরগি অথবা শুয়োর বলি প্রথা প্রচলন আছে। বলির মাংস রান্না করে মহাকালকে নিবেদন করা হয়। পুরুষরা পুজোর কাজ করেন। হুজি মন্ত্রপাঠে পুজো সম্পন্ন করেন।

ঢপ ঠাকুর : বিশেষ করে মাদারীহাটে মুজনাই টি এস্টেটে মেচ সম্প্রদায়ে এই পুজোর রীতি চালু আছে। প্রতিবছর অক্টোবর মাসের জ্যোৎস্না রাতে এই পুজোর আয়োজন করে মেচরা। ঢপ ঠাকুর হচ্ছেন আসলেই শিব। যেমন মেচদের কাছে কালী বা লক্ষীর লোকায়ত নাম হল ‘মৈনাও’। এই পুজোর বিশেষত্ব হল, পুজো শুরু হওয়ার আগে লৌকিক ভাষায় কিছু কথা মন্ত্রোচ্চারণের মতো পাঠ করা। যেমন—

‘ও-হোম খমা খানজেন,
সানজা গৈয়া মোন্ সিনাপ্ গৈয়া মোন্,
খল গৈয়া মোন,
অখন খালি আটগুরু আনন্দ গোসাইয়া
আকাশ নিফ্রা উৎখাঃ নাঃ,
হা সিজন নিজন খ্যুমবা,
আই লক্ষ্মী কোউ সিজন খ্যুমবা,
জংনি মোনু খোউ
সিজন নিজন খ্যুমবা,
অকং খালি দেউসী দোন্ন্যা,
ফানতোল দোন্ন্যা, সোথা দোন্ন্যা
বনদ দ্যোন্না।’

উপজাতীয় কাঠামো সরল, নমনীয় কিন্তু সমাজের সভ্য অথচ জটিল জীবনধারণ প্রণালী সহজলভ্য মনে হলেও উপজাতীয় প্রাকৃতিক আচরণকে ধর্ম, অর্থনীতি, সাক্ষরতা, ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়গুলির সঙ্গে সঠিক মাত্রায় খাপ খাইয়ে নিজেদের বিলুপ্তপ্রায় অস্তিত্বকে শ্রেণীবদ্ধ ও পরিণত করা বা সমতুল্য স্থান অধিকার করে নিম্নবর্ণ ও বিচ্ছিন্নতার বাইরে উপলব্ধির বিচারে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা উপজাতিদের কাছে কখনোই সহজ ছিল না। অনেক উপজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। বাকিরাও শিল্পায়ন এবং নগরায়নের ভেতর বাণিজ্যিক শোষণে অবলুপ্ত হবে। আগামী সময়ে বৃহত্তর উৎসবের অন্তরালে প্রদীপের ছায়ায় হারিয়ে যাবে লৌকিক দেবদেবী, অপদেবতা ও উৎসবের কথা। উত্তরবঙ্গের মুমূর্ষ আদিবাসী নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, উৎসব, লোকাচারকে রক্ষা করবে নাকি জীবনধারণের জন্য উন্নত শিক্ষিত সমাজে শামিল হবার অভিপ্রায়ে নিজেদের যোগ্য করে তুলবে সে প্রশ্ন থেকেই যাক।