• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

প্রাচীন ও ঐতিহাসিক জনপদ চন্দ্রকেতুগড়ে একদিন

সকালে গিয়ে চন্দ্রকেতুগড় এলাকা ঘুরে বিকেলেই ফেরা সম্ভব

চন্দ্রকেতুগড়

খুব বেশি হলে কলকাতা থেকে ঘণ্টা দুইয়ের পথ।অথচ অনেকেরই এই প্রাচীন জনপদ তথা একদা বন্দরনগরীতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অথচ একদিনেই সকালে বের হয়ে বিকেলে ফিরে আসা যায় এই ঐতিহাসিক তথা পুরাতাত্ত্বিক স্থানটিতে।নামটিও বড় মিষ্টি। চন্দ্রকেতুগড় । উত্তর ২৪ পরগনার বেড়াচাপার কাছের এই প্রাচীন জনপদটির অবস্থান। ট্রেনে গেলে শিয়ালদহ থেকে হাড়ােয়া রােড স্টেশন দেড় ঘণ্টা ( ৪৯ কিলােমিটার )। স্টেশনে নেমে তিন কিলােমিটার বেড়াচাপা মােড়ে আসতে হবে টোটো বা অটোতে। সড়ক পথে যেতে হলে কলকাতা থেকে যশাের রােড ধরে বারাসত হয়ে টাকি রােড ধরে দেগঙ্গা পেরিয়ে বেড়াচাপা মােড়।সেখান থেকে বাঁ দিকে খনা মিহিরের ঢিপি। বেড়াচাপা মােড় থেকে ডান দিকে হাড়ােয়া রােড ধরে কিছুটা গেলেই চন্দ্রকেতুগড়।

ঐতিহাসিকদের মতে উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে এই বন্দর নগরীর সম্পর্ক ছিল। এমনকী , দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়ার সঙ্গেও বাণিজ্যিক যােগাযােগ ছিল এই নগরীর।এখান থেকে পাওয়া সিলমােহরে মিলেছে পাল তােলা নৌকো ,ঘােড়ার প্রতিকৃতি।চন্দ্রকেতুগড়ের কাছেই নদীর অস্তিত্ব টের পেয়েছেন ভূতত্ত্ববিদরা।সেই নদী বহুকাল হারিয়ে গিয়েছে। পুরাতত্ত্ববিদদের ধারণা,হারিয়ে যাওয়া নদীটি ধরেই চন্দ্রকেতুগড় প্রায় পাঁচশাে বছর ধরে ক্রমশ সমৃদ্ধ নগরী হয়ে ওঠে।

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে এখানে আসতেন বিভিন্ন দেশের মানুষ, বণিক , শ্রমণেরা।চন্দ্রকেতুগড় নামটি কোথা থেকে এল , তা নিয়ে তর্ক রয়েছে।ইতিহাসবিদদের ধারণা , চন্দ্রকেতুর সঙ্গে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সম্পর্ক রয়েছে।কেউ কেউ মনে করেন মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পরে ছোট ছােট যে নগরগুলাের উত্থান হয় , চন্দ্রকেতুগড় তারই একটি।পঞ্চম শতাব্দীতেই চন্দ্রকেতুগড় আস্তে আস্তে মলিন হতে শুরু করে বলে অনেকে মনে করেন।

অনেকে বলেন ,প্রাচীন রাজার নাম চন্দ্রকেতু থেকে রাজধানীর নাম ছিল চন্দ্রকেতুগড়। গত ১৫ – ৯৬ – ৫৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় চন্দ্রকেতুগড় খননের প্রয়াস।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতােষ সংগ্রহশালা এখানে উৎখনন করে পাওয়া খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের প্ৰাগমৌর্য যুগ থেকে দ্বাদশ শতকের সেন যুগ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক পর্বের নিদর্শন উন্মােচিত করে। ঢিপি খননের ফলে সুপ্রাচীন কালের বুদ্ধ মূর্তি , পােড়ামাটির ফলক , শীলমােহর , বিভিন্ন ধাতুর মুদ্রা , স্তুপ এবং নানা ধরনের পুঁথি উদ্ধার হয়েছে।উল্লেখ্য , বেড়াচাপাতে ৫০ বছর ধরে চন্দ্রকেতুগড়ের এমন সব পুরাকীর্তি সংগ্রহ করে নিজের বাড়িতে সংগ্রহশালা করেছেন এখানকার পুরাকীর্তি বিষয়ে নিবেদিত প্রাণ দিলীপকুমার মৈতে।তার বাড়ির সংগ্রহশালায় বেড়ার্চাপায় চন্দ্রকেতুগড় থেকে উদ্ধার হওয়া নর – নারীর মূর্তি , গৌতম বুদ্ধ , পােড়া মাটির ফলক , টেরাকোটার মূর্তি , লাল পাথরের বুদ্ধমূর্তি , নানা সময়ের মুদ্রা , মাটির পাত্র , হাড়ের উপর করা নকশা , মূল্যবান পাথর দেখতে দূর – দূরান্ত থেকে আজও মানুষ আসে।রাজ্য পর্যটন দফতর উদ্যোগী হলে চন্দ্রকেতুগড় ও ঢাকি অঞ্চল নিয়ে একটি পর্যটন সার্কিট গড়তে পারে।

চন্দ্রকেতুগড়ে ঢিপি আর গাছগাছালি ছাড়া কিছু অবশিষ্ট নেই । ছােট টিলার মতাে উঁচু ঢিপি। পাশে বেশ কিছু নির্মাণের ভাঙাচোরা অংশ । ইতিহাসবিদদের অনুমান , সেখানেই মাটির নীচে চাপা পড়ে রয়েছে আড়াই হাজার বছরের পুরনাে ইতিহাস । কেয়ার টেকার মহীদুল মণ্ডল সব দেখালেন। কয়েকজন জানালেন , বাড়ি তৈরি বা পুকুর কাটতে গিয়েই বেরিয়ে পড়ে অনেক স্মৃতি। সেইসব সামগ্রীর কোন খোঁজ নেই।

অন্যদিকে , চন্দ্রকেতুগড়ের খনা মিহিরের ঢিবি সংলগ্ন এলাকায় মাটির নীচে ছড়িয়ে রয়েছে বহু মূল্যবান প্রত্ন সামগ্রী।মাটি খুঁড়ে মেলে এই এলাকার প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন।তার মধ্যে রয়েছে পাল , গুপ্ত , মৌর্য , শুঙ্গ , কুষাণ যুগের পানপাত্র , হাতির শুড় , টালি , ইট , পুতুল , মিথুন  মুর্তি , নানা আকারের মাটির পাত্র , মুদ্রা এবং বিভিন্ন  দেবদেবীর মূর্তি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,কয়েক বছর আগে বেড়াচাপায় খনা – মিহিরের ঢিপি এলাকায় একটি বেসরকারি সংস্থার মােবাইল টাওয়ার এবং রাজ্য সরকারের বিদ্যুতের টাওয়ার বসানাের জন্য মাটি খুঁড়তেও বেরিয়ে আসতে থাকে নানা প্রত্নসামগ্রী। এলাকাতে হইচই পড়ে যায়। তা জানতে পেরে পুরাতত্ত্ব বিভাগের তরফে বেড়াচাপায় চন্দ্রকেতুগড় এলাকায় প্রশাসনিক নির্দেশে মাটি খোঁড়ার উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা  জারি করে বিজ্ঞপ্তি লাগানাে হয়। যদিও স্থানীয় মানুষের অভিযােগ চুরি চলছেই।একমাত্র সরকার যদি এলাকাটির প্রতি বিশেষ নজর দেন , প্রত্নতত্ত্বীয় মিউজিয়ম গড়েন , তবে যেমন চুরি বন্ধ সম্ভব হবে অন্যদিকে ঢাকি ইছামতী নিয়ে এলাকাটি ঘিরে একটি ট্যুরিস্ট সার্কিট হলে পুরাে এলাকার গুরুত্ব যেমন বাড়বে তেমনি বাংলার পর্যটন মানচিত্রটিও হবে আরেকটু গৌরবের ।

পরিশেষে বলি , যেহেতু সকালে গিয়ে চন্দ্রকেতুগড় এলাকা ঘুরে বিকেলেই ফেরা সম্ভব তাই রাতে থাকার কোন প্রয়ােজন হয় না।আর বেড়াচাপা মােড়েই মাঝামাঝি মানের খাবার হােটেল পাবেন । চাইলে বারাসতে লাঞ্চ সেরে নিতে পারেন।