• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

পরিবর্তিত বাঙালি: সেই আমি আর এই আমি

এক ক্রান্তিকালের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি,তাই বাঙালি জাতি অস্ফুটে উচ্চারণ করছে—সেই আমি আর এই আমি।

প্রতীকী ছবি

(এক)

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষের জন্মদিন প্রায় এসেই গেল। বিদ্যাসাগরের কথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে আর এক মনীষীর কথা।তিনি রবীন্দ্রনাথ।রবীন্দ্রনাথের লেখায় বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন যথাযথ। সেটি আবার নতুন করে পড়ছিলাম।পড়তে পড়তে এক জায়গায় এসে থমকে গেলাম।রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,“…বিশ্বকর্মা যেখানে চারকোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন,সেখানে হঠাৎ দু-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন।…বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন।এখানে তার স্বজাতি সােদর কেহ ছিল না।”রবীন্দ্রনাথের হিসেব এতদিনে বদলে গেছে।চার কোটি আজ কত কোটিতে দাঁড়িয়েছে তার পরিসংখ্যান থেকে বিরত থাকাই ভালাে।এখানে আমরা পরিবর্তিত বাঙালিদের কথা বলবার জন্য প্রয়াস করব।বাঙালির সংস্কৃতি,পারিবারিক জীবন, পরিবর্তিত চিন্তাধারা,আশা-আকাঙ্ক্ষা,ধর্ম,রাজনীতি,ইতিহাসচেতনতা,বৈজ্ঞানিক প্রয়াস ইত্যাদির ক্রমপরিবর্তনকে যতটুকু ধরতে পারি সে চেষ্টা করব।সবিস্তারে লিখতে গেলে তাে মহাভারত হয়ে যাবে।পরিমিত পরিসরে যতটুকু লেখা যায় ততটুকু লিখতে হবে।ড . নীহাররঞ্জন রায়ের(১৯০৩-১৯৮১)সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বাঙালির ইতিহাস( আদিপর্ব )প্রকাশিত হয়েছিল স্বাধীনতার পরে।১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে।দুরকম মত।এই বইটি নাকি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিল।অন্য মতে,সতীনাথ ভাদুড়ির ‘জাগরী’ উপন্যাসকে প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল।সতীনাথ ‘জাগরী’ লিখেছিলেন ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে।আমার মতে ‘জাগরী’ই প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিল।কিংবা একই সঙ্গে নীহাররঞ্জন এবং সতীনাথও কি রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিলেন!নীহাররঞ্জনের মহান কীর্তির প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বর্তমান লেখক এই লেখাটির উৎস থেকে যাত্রা শুরু করলেন।আমরা বাদুড়বাগানের আদি বাসিন্দা।আনুমানিক দেড়শাে বছর ওই বাদুড়বাগানে বসবাস করছি।আমাদের বাড়ি থেকে দু ‘ মিনিট হাঁটলে পৌছে যাওয়া যাবে বিদ্যাসাগরের বাড়ি।

১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে নবনির্মিত বাদুড়বাগানের বাড়িতে বিদ্যাসাগর বসবাস শুরু করেন।যেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।তাকে নিয়ে এসেছিলেন শ্রী মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত।এই মহেন্দ্রনাথ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত’র প্রণেতা।শ্ৰীম ছদ্মনামে কথামৃত লিখেছিলেন বিদ্যাসাগরের স্কুলে তিনি পড়াতেন।তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার পূর্ব পরিচিত।

এই লেখার শুরুতেই তাই মনে পড়ল ঈশ্বরচন্দ্রের কথা।সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে যিনি তার কোনও একটি কবিতায় লিখেছিলেন-“রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করােনি।এই অনিবার্য পঙক্তিটি আমাদের চিন্তিত না করে পারে না।আজ বাঙালির আত্মসমীক্ষার প্রয়ােজন আছে।

বাঙালি সংস্কৃতি বলতে গেলে তার ভেতর সাহিত্যের বড় ভূমিকা থাকে।সাহিত্যকে বর্জন করে সংস্কৃতি পূর্ণতা পায় না বর্তমান লেখকের অভিপ্রায় একটু অন্যরকম।তিনি সাহিত্যের জন্য স্বতন্ত্র অনুচ্ছেদ রাখতে চান।লেখক স্বয়ং সাহিত্য অন্তপ্রাণ বলেই হয়তাে এই ইচ্ছেটুকু রক্ষা করতে চাইছেন।

বাঙালির সংগীত পিপাসা আজকের নয়।নিধুবাবু , যদুভট্ট তাে অনেক পরের দিকে।মধ্যযুগ থেকে সাহিত্য মানেই তাে গীতির সরণি ধরে এগিয়ে যাওয়া।কিন্তু এই মুহুর্তে সাহিত্য থেকে দূরত্ব রচনা করার সংকল্পে এই লেখক অটল।অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হল,বাঙালির সংস্কৃতির কথা বলতে গেলে সাহিত্যের বেহালায় বেজে ওঠে সুর।সেই বেহালা বাজায় স্বয়ং সংস্কৃতি বাঙালির সংস্কৃতি।সংস্কৃতির হাতে ধরা আছে বেহালার ছড় কাধে এলিয়ে আছে বেহালা।

গানের কথা উঠলেই নাটকের কথা এসে যায়।আর সেই মঞ্চের যিনি রাজা তিনি স্বয়ং গিরিশচন্দ্র। পরবর্তীকালে অবশ্যই শিশিরকুমার ভাদুড়ি।অপরেশচন্দ্র মুখােপাধ্যায় তার ‘রঙ্গালয়ে ত্রিশ বৎসর ’ গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে কী লিখেছিলেন তা আমরা স্মরণ করে নিতে চাই।অপরেশচন্দ্র লিখছেন–বাঙ্গলা দেশে সে কালে কবি,হাফ-আখড়াই,তরজা প্রভৃতির সমাদর ছিল।ছড়া কাটিয়া,উতর গাহিয়া,সং সাজিয়া গালাগালি দিয়া আমােদ করিবার রীতি, রুচি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আকার পরিবর্তন করিয়া আজিও বর্তমান রহিয়াছে।শুনিতাম,কলিকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রথম আমলে বেঙ্গল থিয়েটারের সঙ্গে ন্যাশনাল থিয়েটারের এইরূপ ছড়া কাটিয়া গালাগালি চলিত।আমরা কিন্তু তখন পর্যন্ত এসব বড় একটা দেখি নাই ; এই রীতির পুনঃপ্রচলন হইল ক্লাসিকের অভ্যুদয় হইতে; অমরবাবু(অমরেন্দ্রনাথ দত্ত) থিয়েটার খােলার কিছুদিন পরে থিয়েটারের হ্যান্ডবিলকে ক্রমশ খবরের কাগজে পরিণত করিলেন।

‘গিরিশচন্দ্র তখন মিনার্ভায়,অমরবাবু গিরিশচন্দ্রকে লক্ষ করিয়া নানারূপ ছড়া কাটিয়া হ্যান্ডবিলে গালাগালি দিতে আরম্ভ করিলেন।উভয় থিয়েটারের তুলনায় ক্লাসিকই যে ভালাে, গিরিশবাবুর পরিচালিত মিনার্ভা সে কিছু না,এইরূপ কার্টুনও বাহির হইতে লাগিল।দুই-একটা নমুনা যথা-দাড়িপাল্লা আঁকিয়া তাহার একদিকে বসান হইল অমরবাবুকে। অন্যদিকে বসান হইল গিরিশচন্দ্রকে;অমরবাবুর দিক ভারী হওয়ায় নীচে নামিয়া পড়িল,গিরিশচন্দ্রের দিক হালকা হওয়ায় উপরে উঠিয়া গেল।কিংবা কোনও চিত্রে হয়তাে দড়ি লইয়া টানাটানি হইতেছে,গিরিশচন্দ্রের দল ক্লাসিকের দলকে যেন হটাইতে পারিতেছেন না।অর্বাচীনের দল এই সমস্ত কার্টুন দেখিয়া এবং ইহার অমার্জনীয় মন্তব্য পড়িয়া বেশ আমােদ উপভােগ করিত সন্দেহ নাই।’

আবার ফিরে আসা যাক গানের কথায়।এই লেখাতে এমন আসা ও যাওয়ার কথা থাকবে।বর্তমান লেখকের এটিও একটি অভিপ্রায়।

একালের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য,প্রবীণতম কবি, গানের প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা স্মরণীয় -‘গানই ছিল আমাদের কবিতা।কিন্তু আধুনিক যুগে পৌঁছে-গত শতাব্দীর আধুনিকতায় দুই ভিন্ন ধারা হলাে গানের আর কবিতার।ভিন্ন হলাে,তবু এই শতাব্দীর আধুনিকতার আগে পর্যন্ত,আমাদের প্রধান কবিরাই ছিলেন সুরের জগতের মানুষ রবীন্দ্রনাথ,দ্বিজেন্দ্রলাল,অতুলপ্রসাদ,রজনীকান্ত বা নজরুলের মতাে কবিরা।কিন্তু নজরুল থেকেই একেবারে ছিন্ন হয়ে গেল এই যােগ,তৈরি হলাে গানমুক্ত কবিতার দেশ।’

বাঙালির পারিবারিক জীবনের ছবির কথা বলতে গেলে আমাদের বার বার মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা।

বাদুড়বাগানে আমাদের বাড়ি।লেখার শুরুতেই সে কথা উল্লেখ করেছি।আমার পিতৃদেব বলতেন,“আমরা যেখানে থাকি তার চারপাশ ঘিরে কত মনীষীর বাড়িঘর।বিদ্যাসাগর, আচার্য জগদীশচন্দ্র,স্বামী বিবেকানন্দ,রবীন্দ্রনাথ,সুরেশচন্দ্র সমাজপতি আরও কত মনীষী।নিবেদিতার কথাও যদি বলি ভুল নয়।রাজা রামমােহন রায় তাে আছেনই।বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগানের বাড়ি শ্রীরামকৃষ্ণের চরণধুলােয় ধন্য।আমাদের বাড়ি স্বামীজি , নেতাজিদের চরণধুলােয় ধন্য।বাবার কথাগুলি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।সত্যিই তাে দুমিনিট হেঁটে যদি বিদ্যাসাগরের বাডি পোঁছে যাই,তবে তিন মিনিটে জগদীশচন্দ্র আর পাঁচ মিনিটে কী সাত মিনিটে রাজা রামমােহন রায়ের বাড়ি পৌঁছে যাব।

বিদ্যাসাগর বাদুড়বাগানে।আপার সার্কুলার রােডে জগদীশচন্দ্র,ওই একই রাস্তা ধরে মানিকতলার দিকে হাঁটলেই রাজা রামমােহনের বাড়ি।সিমলে আর কতদূর!সেখানে স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ি।বাগবাজারের বােসপাড়া লেনে ভগিনী নিবেদিতা থাকতেন।রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকো কিংবা নটশেখর গিরিশচন্দ্রের বাড়িও খুব দুরবর্তী নয়।শ্যামপুকুরের একটি বাড়িতে অসুস্থ শ্রীরামকৃষ্ণ বেশ কিছুদিন ছিলেন।শ্যামপুকুর স্ট্রিটের খুব কাছেই রামধন মিত্র লেন।সেখানে থাকতেন বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র সুরেশচন্দ্র সমাজপতি।

আর একালের ‘আকাশবাণীর এবং যাঁকে নিয়ে সম্প্রতি মহালয়া চলচ্চিত্রটি হল,সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রও থাকলে ওই রামধন মিত্র লেনে।

বঙ্কিমচন্দ্র শেষ জীবনে গােলদিঘির কাছাকাছি থাকতেন।কলেজ স্ট্রিটের গায়ে বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট।এই মনীষী বাঙালির গৌরব।আর বাদুড়বাগান থেকে উল্লিখিত মনীষীদের বাড়ি অদূরবর্তী বলেই আমরা গৌরব বােধ করেছি।

বাদুড়বাগানের মেস বিভিন্ন লেখকের বিভিন্ন লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে।আসবে না কেন!ওই মেসে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র কিছুদিন ছিলেন অচিন্ত্যকুমার,শরদিন্দুও ছিলেন বলে শোনা যায়।

এই প্রসঙ্গে অদূরবর্তী মির্জাপুর স্ট্রিটের ‘ফেভারিট কেবিন’-এর কথাও বলতে হয়।ওই রেস্তরায় এককালে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা আড্রড়া দিতেন।কল্লোল যুগের লেখকরাও পাথরের টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসতেন।চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলতেন কী বিপ্লবী কী লেখক সকলেই।

এইভাবে ফুটে উঠছে কলকাতার ছবি।বিশেষত উত্তর কলকাতার।সেই ছবির মধ্যে ফুটে উঠছে বাঙালির রূপ।তখন তাে তেমনভাবে দক্ষিণ কলকাতা তৈরি হয়নি।বারট্রান্ড রাসেল বলেছেন,সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হয়েছ মনের ভেতর একটা নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভেতর ডুব দেওয়া।যে যত বেশি এই জগৎ তৈরি করতে পারে,ভবযন্ত্রণা এড়াবার নামতা তার তত বেশি হয়।

বই পড়ে এই জগৎ তৈরি করা যায়।এটা বাঙালিরা জানেন।এখন প্রশ্ন হচ্ছে সাম্প্রতিক কালে ক’জন বাঙালি বই পড়েন!আমাদের পূর্ববর্তী কালে এমনকী আমাদের কালেও আমরা বই পড়তে পড়তে বড় হয়েছি।একালের দিকে তাকিয়ে প্রমাদ গুনছি।আর মনে মনে বলছি,বাঙালি কী ছিলেন,আর কী হইয়াছেন।”

এবার বাঙালি পরিবারের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখা যাক।যৌথ পরিবারের মধ্যে বড় হয়েছি।বাবা-কাকা-ঠাকুরদা-ঠাকুরমা আমাদের ঘিরে থাকতেন।আমরা চার ভাই।চারজনের চিন্তাধারার মধ্যে নিশ্চয়ই পার্থক্য ছিল।কেউ এঁকেছে,কেউ মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছে লেখায়,কেউ ফুটবল খেলেছে ,কেউ বিজ্ঞান নিয়ে বড় কিছু একটা করবে বলে স্বপ্ন দেখেছে।বড় হতে হতে ফুটবল খেলােয়াড় একদিন ঢলে যায় আধ্যাত্মিক জগতে।

আমাদের বাড়িতে দরজা বা জানলায় পর্দা ছিল না।ভাত খেতাম মেঝেতে পিড়ের ওপর বসে।কাঁসার থালা-বাটি-গেলাস।কাকার ঘরে রেডিওতে বাজত হেমন্ত মুখােপাধ্যায়,মান্না দে,শ্যামল মিত্র,সন্ধ্যা মুখােপাধ্যায়,প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান।কৃষ্ণচন্দ্র দে ’ র কীর্তন।

বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আকাশ ঢেকে যেত নানারকম ঘুড়িতে।সরস্বতী পুজোর দিনে প্রতিমার পদতলে রাখতাম বই,খাতা,কলম।দুর্গাপুজোর অষ্টমীতে উপবাস করে অঞ্জলি দিতাম।শীতকালে মা-বাবার সঙ্গে চিড়িয়াখানায় যেতাম।কখনও সার্কাসে।লালু ভুলু,মানিক,এইসব সিনেমা দেখেছি।আর একটু বড় হয়ে উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখার হাতেখড়ি।

সন্ধেবেলায় এ বাড়ি ও বাড়িতে শাঁখ বাজত।অনেক বাড়ির রান্নাঘরের কয়লার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকত গলিটা।খুব অস্পষ্টভাবে মনে পড়ে কাধে মই নিয়ে একটা লােক এসে গলির গ্যাসের আলােগুলি জ্বেলে দিয়ে যেত।অন্ধকার কাটত কম।গ্যাসের ম্লান আলাে যেন ম্রিয়মান জ্যোৎস্না।

সন্ধেবেলায় সনাতন ঘুগনি বিক্রি করতে আসত।কিংবা ‘চাই বেলফুল’বলে এক মালাকর কসুম সুরভি নিয়ে ঢুকে পড়ত আমাদের গলিতে।গ্রীষ্ম-সন্ধ্যায় কুলফি বরফওয়ালা।আর সত্যি কথা বলতে কী মাঝে মাঝে দুপুরবেলায় বিশাল বপু এক অবাঙালি গলিতে আবির্ভূত হত,যা আমাদের মনে একই সঙ্গে বিস্ময়-রােমাঞ্চ-ভয়কে জাগিয়ে তুলত।হিং,সুরমা,কিসমিস,আখরােটের ফেরিওয়ালা দীর্ঘদেহী এক কাবুলিওয়ালা।মনে হত রবীন্দ্রনাথের গল্পের পৃষ্ঠা থেকে স্বয়ং রহমত ঢুকে পড়েছে আমাদের এই বাদুড়বাগানের গলিতে।গলিটার নাম রামকৃষ্ণ দাস লেন।আর একটু বড় হয়ে তপন সিংহের কাবুলিওয়ালা দেখেছি।সেখানে সব বাঙালি।গল্প রবীন্দ্রনাথের।চিত্রনাট্য প্রেমেন্দ্র মিত্রের।পরিচালক বাঙালি।আর রহমতের ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস।

ছেলেবেলায় সন্ধেবেলায় মাঝে মাঝে বাড়ির দরজায় আরও একজন।একে দেখেও আমাদের মনে বিস্ময়-রােমাঞ্চ-ভয় জেগে উঠত।সে অবাঙালি নয়।হাতে ছােট মশালের মতাে একটা কিছু জ্বলন্ত আগুনের আলােয় তার কালাে আলখাল্লা এবং দাড়ি গোফ সেই সঙ্গে চামর দুলিয়ে পরিবারের মুশকিল দুর করার আশ্বাস দিত মুশকিল আসান।

নির্জন খাঁ খাঁ দুপুর।বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম দুটো বুড়ি পুটলি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।অদ্ভুত স্বরে বলছে,‘দাঁতের পােকা বার কো…রি।তখন তাে জানতাম না দাঁতে পােকা হয় না।আমাদের বুক কেঁপে উঠত।তখন জানতাম ওদের পুটুলির ভেতরে বনমানুষের হাড় আছে।জাদু হাড়।ওই হাড় ছুঁইয়ে ওরা ছােট ছেলেমেয়েদের বশ করে ওরা ছেলে ধরা।

কোথায় গেল সেই কলকাতার ছবি।ছুটির দিনে মা-কাকিমা এবং পিসিমারা এসে টোয়েন্টিনাইন খেলতে বসে যেতেন।বাবাদের ছিল হলিডে ক্লাব।৬ নম্বর বাড়িতে।ওখানে বাবা,শম্ভুদা,খােকনদা,গােবিন্দ কাকারা ব্রিজ খেলতেন।

পঞ্চাশ-ষাট দশকের কলকাতা।ট্রাম লাইনের ওপারে বিষ্টু ঘােযের আখড়া।যুবকরা ব্যায়াম করত।কেবল পূর্ণদা অন্য কোথায় যেন বক্সিং শিখতে যেতেন।বক্সার হয়ে তিনি রেলে চাকরি পেয়েছিলেন।

সব বদলে গেছে।ভােরবেলায় উঠে কোন মেয়ে আজকাল হারমােনিয়াম বাজিয়ে গলা সাধে!সেই বেসুরাে গলার গান আর শুনতে পাই না।

ট্রাম লাইন পেরিয়ে যে কিশাের রামমােহন লাইব্রেরিতে যাচ্ছে,সে যে আমি।ওখানকার ফ্রি রিডিং রুমে বসে গল্পের বই পড়ব।দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রবার্ট ব্লেক আর সহকারী স্মিথকে চিনেছিলাম ওই লাইব্রেরিতে বসে।অবশ্য লাইব্রেরির শ্যামবাবু বইয়ের আলমারি খুলে এগিয়ে দিয়েছিলেন দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ডিটেকটিভ বইগুলি।রামমােহন লাইব্রেরিতে চাকরি করতেন শ্যামবাবু।তিনি কোথায় থাকতেন বা তার পদবি কী ছিল সেসব আর জানা হয়নি।শ্যামবাবু ছিলেন।কবে যে জগৎ ছেড়ে বরাবরের মতাে চলে গেলেন তাও অজানা থেকে গেল।

(দুই)

রাস্তা দিয়ে একটা মেয়ে কিংবা একলা একটি ছেলে আপন মনে বিড় বিড় করে হেঁটে যাচ্ছে কেন!মাঝে মাঝে হেসেও উঠছে।পাগল নাকি!আরও একটু কাছে গেলে সব ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়।মােবাইল ফোনে কথা বলছে।হয়তাে প্রেম করছে।স্ফুরিত ওষ্ঠাধারে প্রেমের সংলাপ।বাঙালিদের কথাই বলছি।আমরা আবার ভ্যালেনটাইন ডে পালন করতে শুরু করেছি তাে!তাই মােবাইল লুকনাে থাকে।কানে গোঁজা ফোনের তার।আমাদের কিশাের কিশােরীরা ফেসবুকে মগ্ন।কৈশাের থেকে যৌবন,এমনকী উত্তর যৌবনও একই পথে এগােচ্ছে।পথ ভুল এমন বলব না।তবে ওই পথই যদি মানুষের কাছে,বিশেষত বাঙালির কাছে,সর্বস্ব হয়ে ওঠে তাহলে নিশ্চয়ই চিন্তার কারণ হয়ে উঠবে।ফেসবুক সেলফি তখন মায়াজাল হয়ে আমাদের ঘিরে দাঁড়াবে সুতরাং তা যেন না হয়।এই সতর্ক দৃষ্টি থাকা দরকার।
আবার বিদ্যাসাগরকে মনে পড়ছে।মনে না পড়ে উপায় নেই আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্তার উৎস সন্ধান করতে গিয়ে দেখছি-‘সেই কলকাতা শহরে,সংস্কৃত কলেজে একদিন সেই কলেজের যুবক অধ্যক্ষ,সংস্কৃতজ্ঞ একজন ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত,লিখিত আদেশ দিলেন-অতঃপর সংস্কৃত কলেজ সংস্কৃত ভাষায় যেভাবে ভাস্করাচার্যের লীলাবতী আর সংস্কৃত বীজগণিত পড়ানাে হয়ে আসছে,তা আর হবে,সংস্কৃত বীজগণিতের পরিবর্তে ছাত্রদের পড়তে হবে ইংরেজি বীজগণিত।’তর্কসংগ্রহ ’ আর ‘তত্ত্ব সমাসের’ পরিবর্তে পড়তে হবে মিল-এর লজিক,সংক্ষিপ্তসার নয়,আসল মুল মিল-এর লজিক লীলাবতীকে নির্বাসিত করে যিনি নিয়ে এলেন ইংরেজি অ্যালজেবরা তর্ক সংগ্রহকে বাতিল করে নিয়ে এলেন মিল আর আর্চ বিশপ হােয়েটলির লজিক,তিনি হলেন টিকিধারী সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।তখন তিনি ত্রিশ বছরের যুবক মাত্র।
বাঙালির পরিবর্তিত চিন্তাধারার সূত্রপাত রাজা রামমােহন থেকে বিদ্যাসাগর,বঙ্কিম,রবীন্দ্রনাথ এবং’ডন’ -এর সতীশচন্দ্র মুখােপাধ্যায়ের সরণি ধরে এগােতে থাকে।
বাংলা কাব্যে আধুনিকতার দ্বারােদঘাটন মাইকেল মধুসূদন দত্ত করেছিলেন।শুরু হল গণতন্ত্রের উন্মােচন।বাংলা গদ্যে অবশ্যই বিদ্যাসাগর।উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র।তারপর তাে বঙ্গসাহিত্যে সমুদ্রের মতাে বিপুলতা আনলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
তখন বাঙালির জীবন যৌথ পরিবার নামক একটি আশ্রয়ে যাপিত হচ্ছিল।যা আমি এবং আমার সমবয়সিরাও অনেকেই ভােগ করেছি শরৎচন্দ্রের জীবন যতই ছন্নছাড়া হােক না কেন , তার রচিত কাহিনিগুলির ভিতর একান্নবর্তী পরিবারের ছবি বরাবর স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে।তৎকালীন বাঙালি জীবনের মনােরম ছবি সমকালীন আর এক লেখকের লেখায় প্রতীয়মান হতে দেখি।তিনি প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায়।যিনি শরৎচন্দ্রের চেয়ে বয়সে ঠিক তিন বছরের বড়।একই সঙ্গে বাঙালির বাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে যাচ্ছিল।অরবিন্দ,দেশবন্ধু এবং আরও অনেক চরম ও নরমপন্থীদের মাধ্যমে।রাজনীতি থেকে দূরে থেকেও যিনি বাংলার রাজনীতির উৎসমুখ, তিনি স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ।
বাঙালির জীবনকে নবালােকে আলােকিত করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস।বিশিষ্ট লেখক কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীরামকৃষ্ণ দর্শনের চেহারাটা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।তিনি লিখেছেন,’পরমহংসদেব সম্বন্ধে আমার দিক থেকে বলবার মতাে বিশেষ কিছু পাই না।তার সম্বন্ধে বলবে কে? মাঝে মাঝে কিছু শোনবার আশা করেই দক্ষিণেশ্বরে যেতুম।…

…কিছুদিন পড়ে আমি স্বয়ং কেশববাবুকেই ঠাকুরের খাটের নীচে,পা পেছন দিকে করে নিবিষ্ট চিত্তে বসে তাঁর কথাই শুনতে দেখেছি তার সামনে কেশববাবুকে একটি কথাও কইতে শুনিনি।… কত ভাগ্যে এই দেবতাকে পেয়েছিলুম।মনে হচ্ছে আর প্রাণ হু হু করে ডাক ছেড়ে কাঁদতে চাচ্ছে।

মনের সে অবস্থায়,এক প্রকার অসম্বিতেই মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল—“তিনি যদি আজ থাকতেন।”ঠাকুর থাকতে পারেননি সঙ্গ নিয়েছিলেন ও দেখিয়ে দিয়েছিলেন বা জানিয়ে দিয়েছিলেন -আমি আছি,আছি — আছি।” তার সে দয়া লিখে প্রকাশের নয়– তার ভাষা নাই,অন্তত আমার কাছে।

পার্কের বেঞ্চে একা এক বৃদ্ধ ভদ্রলােক বসেছিলেন।পার্কে আর একটা বেঞ্চে আমিও একা বসে আছি। কথা বলার লােক পাই না বললে মিথ্যে বলা হবে।আসলে মনের মতাে কথা বলার লােক পাই না।বয়স্ক মানুষদের আড্ডায় যেতে পারি।বয়সের মিল রয়েছে।কিন্তু সমবয়স কি সব!মনেরও তাে মিল থাকা চাই।পেনশন,ডিএ,শেয়ার বাজার,ফিক্সড ডিপােজিটের ইন্টারেস্টের ওঠা-পড়ার পাশাপাশি প্রেসার,হার্ট,সুগার,ছানি,অনিদ্রার কতরকম আলােচনা,তর্ক-বিতর্ক তার সঙ্গে সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণা,বউমা-শাশুড়ির মন কষাকষি,যুদ্ধ বন্যা,চাষবাস,দুধ-পাউরুটি পােলট্রি ডিমের বাজার দর,তিথি নক্ষত্র।কোন মন্দিরের দেবতা অতি জাগ্রত ইত্যাদি আলােচনায় বৃদ্ধদের আডডা মশগুল থাকে।তারপর এই আলােচনার ভেতর হু-হু করে ঢুকে পড়ে হালের পলিটিকস্।এখন যে ভােটপর্ব চলছে।ওই বেঞ্চে বসা ভদ্রলােকের দশাও কি আমারই মতো!আমরা প্রায় সমবয়সী নিশ্চয়ই উনিও বাঙালি।ভাবতে ভাবতে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘আমরা’ কবিতাটা মনে পড়ল।ছত্রে ছত্রে ছন্দে ছন্দে কেবল বাঙালির জয়গান।সেই জয়গান এতটুকু অতিরঞ্জিত নয়।কবে কোন সেই ছেলেবেলায় স্কুলে ওই কবিতা পড়েছিলাম আজও প্রতিটি চরণ নির্ভুল মনে আছে।সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের তাে প্রতিটি কবিতায় ছন্দের দোলা থাকত।তাই হয়তাে এখনও মনে আছে।এই কবিতাটা সত্যেন্দ্রনাথ নাকি মােহনবাগান ক্লাবের তাবুতে বসে লিখেছিলেন।তিনি মােহনবাগানের অন্ধভক্ত ছিলেন।যেবার গােরাদের হারিয়ে মােহনবাগান প্রথম শিল্ড জয় করেছিল,সেই বিখ্যাত ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে।নগ্ন পায়ে ফুটবল খেলে এগারাে জন বাঙালি ফুটবলার সাহেবদের পর্যুদস্ত করেছিলেন।’আমরা’ কবিতাটা কবি নাকি এই বিজয় উপলক্ষে গড়ের মাঠে বসেই লিখেছিলেন তার উজ্জ্বল প্রমাণ আছে কিনা জানি না।জাতিও হতে পারে।কিন্তু বাঙালির জয়ােল্লাস সত্য।বাঙালির গুণগানের যে ছন্দোবদ্ধ প্রকাশ কবি ব্যক্ত করেছিলেন সে কথাও সত্য।

সেই আদিকাল থেকে বাঙালি পরিবর্তিত হতে হতে এগিয়ে চলেছে।বিদ্যাসাগর ইংরেজদের নিয়মানুবর্তিতা,শ্রমনিষ্ঠা,সাহসিকতাকে গ্রহণ করেছিলেন।কিন্তু তাদের ভােগ বিলাসিতা,উচ্ছলতা, শাসকের দম্ভ ও তথাকথিত উন্নাসিকতাকে বিদ্যাসাগর চরিত্রবলে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন।

বিজ্ঞানেও বাঙালি একদিন নবদিগন্ত জয় করেছিল।আজও নব নব গবেষণা,আবিষ্কার,বাঙালিকে আরও উন্নত লক্ষ্যে পৌঁছে দিচ্ছে।আচার্য জগদীশচন্দ্রের যখন মােটে আঠারাে বছর বয়স,তখন এক বাঙালি ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশন ফর দ্য কান্টিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করে বাঙালির বিজ্ঞান চেতনাকে অনেকদূর এগিয়ে দিলেন আমরা ডা.মহেন্দ্রলাল সরকারের কথা বলছি।জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র রায়,ড.মেঘনাদ সাহা,জ্ঞানচন্দ্র ঘােষ,সত্যেন বসুর কথা আমরা স্মরণ করতে পারি।বিজ্ঞানী হিসেবে জগদীশ চন্দ্রকে সর্বোচ্চ আসনটি দেওয়া আমাদের প্রধান কর্তব্য।

খেলাধুলা,ব্যায়াম,মল্লযুদ্ধ ইত্যাদি সব কিছুতেই আমাদের গৌরবের অন্ত নেই।গােষ্ঠ পাল,শিবদাস ও বিজয়দাস ভাদুড়ি,শৈলেন মান্না কে পাল,চুনী গােস্বামী,পি কে ব্যানার্জিরা ফুটবলে ঝড় তুলেছিলেন।ক্রিকেটে কার্তিক বসু,পঙ্কজ রায়,ডি এস মুখার্জি কল্যাণ মিত্র থেকে একালের সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত।বিষ্ণুচরণ ঘােষ মনােতােষ রায়,আয়রনম্যান নীলমণি দাশ,মনােহর আইচ ব্যায়ামে এবং কুত্তির ব্যাপারে গােবরবাবুর নাম করতেই হয়।বাঙালি যদি কোনওদিন কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের নাম ভুলে যায় তা অবশ্যই আমাদের পরম দুর্ভাগ্য।এর জীবন একসময় ভারতের স্বাধীনতাকামী যােদ্ধাদের প্রেরণা সঞ্চার করেছিল।বাঙালিদের মধ্যে এমন বর্ণময় জীবন সচরাচর দেখা যায় না।জন্ম নদিয়াতে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে।মৃত্যু ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে রিও-ডি-জেনিরাে নগরে।প্রত্যেক বাঙালির জানা প্রয়ােজন কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের জীবন কাহিনি।সেই কাহিনি বিচিত্র।অ্যাডভেঞ্চার,দুঃসাহসিকতা এবং জীবন সংগ্রামের এমন উপাখ্যান সচরাচর বাঙালিদের মধ্যে দেখা যায়নি।দেখা যায় না।আবার যে দেখা যাবে না, সে কথাও জোর করে বলা যায় না। সেই জীবনের অতি সংক্ষিপ্ত একটি রূপরেখা উপস্থিত করা যেতেই পারে।সুরেশচন্দ্র ছােটবেলা থেকেই জেদি ও বন্ধুর দলে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রবণতা ছিল।পিতার সঙ্গে বিবাদ করে খ্রিস্ট ধর্মগ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন।অধ্যক্ষ অ্যান্টন সাহেবের আশ্রয়ে চলে যান।পরে স্পেনসার হােটেলে সামান্য চাকরি নিয়ে চলে যান রেঙ্গুনে।সেখানে মগ দস্যুদের হাত থেকে এক মহিলাকে রক্ষা করেন।চাকরি খুঁজতে খুঁজতে আবার কলকাতায় চলে আসেন।সতেরাে বছর বয়সে এক ক্যাপ্টেনের সাহায্যে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন।সেখানে পৌছে জীবিকা অর্জনের জন্য নানা পেশা গ্রহণ করেন।ওই বয়সে রামায়ণ,অঙ্ক,জ্যোতির্বিদ্যায় কিছু জ্ঞান অর্জন করেন।ম্যাজিকও শিখেছিলেন।হঠাৎ সাপ্তাহিক বেতনে একটি সার্কাস দলে কাজ নেন।১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে হিংস্র জন্তুর খেলা দেখানােয় দক্ষ হয়ে ওঠেন।লন্ডন থেকে হামবুর্গে যান।সেখানে গাজেনবাক, জোগ কাল ইত্যাদি বিখ্যাত সার্কাস দলে খেলা দেখাতেন।অনিবার্য কারণে তাকে জার্মানি ত্যাগ করতে হয়।এরপর চলে যান আমেরিকায়।মি . উইলস – এর সার্কাসে খেলা দেখাতে শুরু করেন।পরে ব্রাজিল চিড়িয়াখানার রক্ষক নিযুক্ত হন।তিনি পর্তুগিজ,জার্মান,স্প্যানিশ ও ইটালিয় ভাষা শেখেন।চিকিৎসাশাস্ত্র শিখে এক ব্রাজিলিয় চিকিৎসকের কন্যাকে বিবাহ করেন।১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রাজিল সৈন্যদলে যােগ দিয়ে এক বছরের মধ্যেই উন্নতি করেন।সান্টাক্রুজ থেকে রিও-ডি-জেনিরােতে সামরিক হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত হন।এই সময় শল্য চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা করেন।১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে অশ্বারােহী বাহিনী ছেড়ে পদাতিক দলে যােগ দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ‘ ফাস্ট সার্জেন্ট’ হন।১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে নিথরয় শহরে ব্রাজিল নৌ-বাহিনী বিদ্রোহ করলে তিনি মাত্র পঞ্চাশ জন সৈন্য নিয়ে বিদ্রোহীদের আক্রমণ করে জয়লাভ করেন এবং কর্নেল পদে উন্নীত হন।

(তিন)

এখন প্রশ্ন হচ্ছে,বাঙালির সেই ঐতিহ্য সমান ধারায় বয়ে চলেছে কি?এককথায় হ্যাঁ কিংবা না বলা যাবে না।

একালের বাঙালির দিকে তাকাতে হবে।তারপর খুঁজে নিতে হবে উত্তর।একালের বাঙালি একেবারে বদলে গেছে।বাঙালির সংস্কৃতি,পারিবারিক জীবন,চিন্তাধারা,ধর্ম,রাজনীতি,ঐতিহাসিক চেতনা, বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড এবং স্বতন্ত্রভাবে ভাবলে সাহিত্য সৃষ্টিও।সংগীতে,নাটকে,চলচ্চিত্র নির্মাণে,খেলাধুলােয়,ব্যায়াম চর্চায় এবং প্রাত্যহিকতায় বাঙালি কত বদলে গেছে।সব যে মন্দস্রোতে বইছে তা তাে নয়।নতুন নতুন গায়ক,নতুন নতুন গায়কের দল,যাকে ব্যান্ড বলা যায়,তারা সংগীত জগতে নব প্রাণের সঞ্চার করছেন,গানের ভাষাও বদলে যাচ্ছে।হীরক দ্যুতির মতাে গানের কথাগুলি আমাদের প্রাণে সাড়া তুলছে।ধ্রুপদ গান ও বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে।সুরের অভিনব বৈচিত্র্য।

নাটকের ক্ষেত্রেও পালা বদল ঘটছে।নতুন আঙ্গিক,অভিনব উপস্থাপনা,মঞ্চের নব নব সজা এবং মৌলিকতা চোখে পড়ার মতাে কেবল বিদেশি নাটকের অনুসরণ নয়,লােকগাথা,জীবনকে স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে অবলােকন করার প্রয়াসও দর্শককে বিমুগ্ধ করছে লেখা হচ্ছে মৌলিক নাটক।

চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও বিপ্লব এসেছে।সত্যজিৎ,ঋত্বিক, মৃণাল সেন,তপন সিংহ,তরুণ মজুমদার, অজয় করকে আমরা যেমন বিস্মৃত হতে পারব না,তেমন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত,গৌতম ঘােষ,রাজা মিত্র,রাজা সেন,কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়,সৃজিত,অঞ্জন দত্তদের কাছ থেকে আমরা ভালাে ভালাে ছবি পাচ্ছি না কি!

খেলাধুলায়ও নতুন নতুন প্রতিভার আবির্ভাব ঘটছে।এতৎসত্ত্বেও লক্ষ করা যায় বাঙালির পরিবর্তন কখনও কখনও আমাদের পীড়িত করছে।

ভেঙে যাচ্ছে যৌথ পরিবারের কাঠামাে। তার পিছনে অবশাই সামাজিক অর্থনৈতিক ইত্যাদি নানারকম কারণ আছে।

সাহিত্যেও পরিবর্তন লক্ষণীয়।আর আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনকে গ্রাস করে নিচ্ছে তথাকথিত টিভি সিরিয়াল।অতি তরুণদের পােশাক পরিচ্ছদ,কথাবার্তা,চিন্তাধারা মাঝে মাঝে বাঙালির অন্ধকার ভবিষ্যতের আভাস দিচ্ছে না এমনও নয়।

এক ক্রান্তিকালের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি,তাই বাঙালি জাতি অস্ফুটে উচ্চারণ করছে—সেই আমি আর এই আমি।