• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

নিঃসঙ্গ যে মানুষটা

আসাদ খাঁর বাড়ির পুকুরপাড় অসংখ্য ফলজ-বনজ গাছপালায় সুসজ্জিত

আরিফ মজুমদার

অকল্পনীয় গতিতে কুসংস্কার ব্যাধিটির সংক্রমণ ঘটতে থাকে কোনো কোনো অঞ্চলে! আসাদ খাঁ-র একলা বাড়ি। উত্তরমুখী বাড়িটির পিছনের দিকে ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ, পূর্ব দিকে একটা বড় পুকুর, আর বাড়ির পশ্চিমে বাঁশবাগান। বাঁশবাগানের শেষের দিকে নালায় কচুরিপানায় ভরা। দিনের বেলায়ও বাঁশবাগানের ওদিক থেকে বিভিন্ন রকম শব্দ আসে— ব্যাঙ, তক্ষক, গুইসাপ, শিয়াল, বনবিড়াল, গোখরা সাপসহ বেশ কিছু বিরল প্রজাতির প্রাণীর আনাগোনা সেদিকে; কখনো কখনো রাতবিরাতে ভূতপ্রেত বা অশরীরী আত্মার ডানা ঝাপটানো আর ওড়াউড়ির মতো অদ্ভুত রকম শব্দও হয়! বাঁশবাগানের আশেপাশে বেশ কয়েকটি উইপোকার ঢিবি। শহরের কাকের মতো প্রকৃতি থেকে উইপোকার ঢিবিও বিলুপ্তপ্রায়। আসাদ খাঁর বাড়ির পুকুরপাড় অসংখ্য ফলজ-বনজ গাছপালায় সুসজ্জিত— মেহগনি, জারুল, দেবদারু, সেগুন, রেইনট্রি, কদম, কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, নিম, জামরুল, আমলকি, আম, জাম, লিচু, লেবু, জলপাই গাছসহ কয়েকটি ছোট-বড় নারিকেল গাছ বেড়ে উঠেছে। তবে নারিকেল গাছের প্রতি আসাদ খাঁর আগ্রহ একটু বেশিই।

সংসারে নানা কাজে লাগে নারিকেল। কাঁচা যেমন খাওয়া যায় নারিকেল, তেমনই তৈরি করা যায় মজার সব পিঠা-পায়েসও। আয়ুর্বেদের তত্ত্বমতে, নারিকেল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। লিভারের অসুখে ভালো কাজ দেয়। ক্যান্সারেরও ঝুঁকি কমে! তদুপরি বাড়িতে সৌর্ন্দয বাড়াতে নারিকেল গাছ বেশ সহায়ক। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই চোখে পড়ে দুই চারটি নারিকেল গাছ। যদিও প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ ছিল নারিকেল গাছের আদি জন্মস্থান। আসাদ খাঁর বাড়িতে পুকুর পাড়ে বেড়ে ওঠা নারিকেল গাছগুলোর পরিচর্যাও ঠিকঠাক মতো করানো হয়।

কিন্তু এই নারিকেল গাছ নিয়েই অচিন্ত্যনীয় একটা ঘটনা ঘটে যাবে সেটা কে জানত? প্রকৃতির খেলা বড় দুর্ভেদ্য রহস্যময়! বাড়িতে যে নারিকেল গাছের প্রতি আসাদ খার এত দরদ, সেই নারিকেল গাছ নিয়েই তিনি পড়লেন মহাবিপদে! হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় পুকুর পাড়ের একটি নারিকেল গাছ নেমে যায় ওই পুকুরের পানিতে। পুকুরের মাঝখানে একেবারে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গাছটি। মূলের সাথে থাকা মাটিসহ গাছটি পুকুরে চলে গেছে বলেই দাঁড়িয়ে আছে নারিকেল গাছটি। ঘটনার দিন রাতেই বিষয়টি আসাদ খাঁর নজরে আসে। এদিন সন্ধ্যার পর জোছনার আলোয় পুরো বাড়ি যেন দিনের মতোই আলোকিত হয়ে উঠে! চৈত্র মাসের গরমে অতিষ্ঠ হয়ে আসাদ খাঁ বাড়ির উঠানে জোছনার আলো গায়ে মেখে হাঁটছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখেন, পুকুরে পানির মধ্যে একটি নারিকেল গাছ দাঁড়িয়ে আছে! গাছটির পাতায় চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছে। বাতাসে নারিকেল গাছের পাতার নড়াচড়ার শাঁ-শাঁ শব্দও হচ্ছে!

বিষয়টি তাঁকে খুব চমকিয়ে দেয়। তিনি কি ভুল কিছু দেখছেন? ঘরে তাঁর স্ত্রী লতিফা বানুর শুকনো কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে। অসুস্থ স্ত্রীকে ডেকে নেবেন কিনা বুঝতে পারছেন না। বুকের ধড়ফড়ানি নিয়ে পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ান তিনি। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন, সত্যি সত্যিই নারিকেল গাছটি পুকুরের মাঝখানে পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে! গাছটি পানির মধ্যে চৎকার একটি দৃশ্যেরও সৃষ্টি করেছে! মহানন্দে কয়েকটা রাতপাখি নারিকেল গাছটির মধ্যে ঢুকছে আর বের হচ্ছে। যে কোনও সময় গাছটি পুকুরে ডুবে যেতে পারে ভেবে আসাদ খাঁ তাঁর স্ত্রীকে দেখানোর জন্য ডেকে নিলেন। রাতের বেলা পুকুর পাড় থেকে স্বামীর ডাক শুনে লতিফা বানুও তড়িঘড়ি করেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে নারিকেল গাছের বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁরা। কিছুক্ষণ পর দুজন ঘরে ফিরলেন। তারপর বিভিন্ন রকম চিন্তা-ভাবনায় রাত কাটে দুজনের।

পরদিন নারিকেল গাছটি নিয়ে গ্রামের লোকজনের মধ্যে কৌতুলের অন্ত নেই। নারিকেল গাছটি পুকুরের মাঝখানে গিয়ে এভাবে সোজা দাঁড়িয়ে আছে দেখে পুরো গ্রামে তোলপাড় শুরু হয়েছে। নারিকেল গাছটি দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে অতি উৎসাহী মানুষজন। বিষয়টি অলৌকিক, ভৌতিক বা অতিপ্রকৃতির খেলা বলে মনে করছে লোকজন! গ্রামে আলোড়ন সৃষ্টিকারী গাছটি দেখতে আসা মানুষের ভিড়ও সরানো যাচ্ছে না। অনেকেই রোগ-বালাই সারানোর জন্য বোতলে ওই পুকুরের পানি সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে। নিঃসন্তান দম্পতিরা সন্তারের আশায় পেটভরে ওই পুকুরের পানি পান করছে। নানা রকম অদ্ভুত কর্মকাণ্ড করছে গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষজন। নারিকেল গাছটি নিয়ে নানা গল্পের ডালপালায় বিষয়টি হয়ে গেল— টক অব দ্য ভিলেজ। বাস্তব ঘটনার সঙ্গে রং লাগিয়ে কেউ কেউ মুখরোচক গল্প রটাচ্ছে। নারিকেল গাছটি দেখতে অসংখ্য মানুষের আসা-যাওয়ার কারণে এদিকে বেড়ে গেছে অটোরিকশার ভাড়াও! অতি উৎসাহী মানুষজন দলে দলে গল্প করছে, ‘নারিকেল গাছটা পুকুরের মধ্যে পড়তে পারে কিন্তু সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া থাকল কেমনে? গাছটি পুকুরের পানিতে পইড়া গেছে কিন্ত একটুখানি চিৎ কাত হইল না? এটা নিশ্চয়ই জিন-ভূতের ব্যাপার-স্যাপার…!’ নারিকেল গাছটি সোসাল মিডিয়ায়ও ভাইরাল হয়ে গেল।

গাছটি এক নজর দেখতে অসংখ্য কৌতুহলী নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। লোকমুখে খবর পেয়ে দূরদূরান্ত থেকেও আসছে কেউ কেউ। কয়েকটি ছেলেমেয়ে টিকটিকও করছে নারিকেল গাছটি নিয়ে। গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেবও জুমার দিন নামাজের আগে বললেন, ‘ভাইয়েরা, আসাদ খাঁ সাহেবের বাড়ির পুকুরের নারিকেল গাছটা নিয়া এত আশ্চর্য হওয়ার কিচ্ছু নাই। এটা হইল গিয়া আল্লাহ্তায়ালার কুদরত! আল্লাহ্তায়ালার কুদরত আর কেরামতি সামান্য মানুষ কী কইরা বুঝব? এটা তো অতি সামান্য একটা ঘটনা! ভাইয়েরা, আল্লাহ্তায়ালার কুদরত বুঝা সহজ নাহ্! শেষ জামানায় কত্ত কিচ্ছুই ঘটবে…!’

ইমাম সাহেবের কথাগুলো শুনে শেষ জামানার আতঙ্কে অনেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই মজসিদে আদায় করার চেষ্টা করছে। কে জানে, কখন যে কেয়ামতও ঘটে যাবে? গ্রামের যে লোকটা আগে জুমার নামাজও ঠিকঠাক মতো পড়ত না, ভোরে আজান হতেই ঘুম থেকে উঠে মসজিদে চলে আসছে সেও! এদিকে, নারিকেল গাছটি নিয়ে মহাবিপদে আছেন আসাদ খাঁ। বিপত্তিতে পড়েছে আশেপাশের প্রতিবেশীরাও। প্রতিদিন ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মানুষের ভিড়ে আশেপাশের বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। অতি উৎসাহী মানুষের বাধার ভয়ে গাছটি কাটতেও সাহস পাচ্ছেন না আসাদ খাঁ! নারিকেল গাছটি কাটতে প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে গোপনে। যেভাবেই হোক দ্রুতই নারিকেল গাছটি কেটে ফেলতে চান আসাদ খাঁ। এরই মধ্যে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আলতাফ আহমেদ নারিকেল গাছের ঘটনাস্থল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরিদর্শন করে উপস্থিত লোকজনকে ডেকে জানালেন, ‘নারিকেল গাছের গোড়ার সঙ্গে মাটি লেগে থাকার কারণে মাটির সঙ্গে গাছটি দাঁড়িয়ে আছে পুকুরের মাঝখানে। এখানে অলৌকিক বা ভৌতিক কিছু নেই! এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আপনারা এটা নিয়ে গ্রামে গুজব রটাবেন না। মনে রাখবেন! গুজব রটানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ! বাড়ির মালিক চাইলে গাছটা কাটতে সহযোগিতা করবে প্রশাসন…।’

নারিকেল গাছটি কাটা হবে— এই খবরে গ্রামের অনেকে ভেতরে ভেতরে তীব্র প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। সকলে বলাবলিও শুরু করেছে, ‘নারিকেল গাছটা কাটা মোটেও ঠিক কাজ হইব না। জিন-ভূতরে রাগাইলে খবর আছে…!’ কয়েক দিনের মধ্যেই গ্রামের লোকজনের মধ্যে একটা অদ্ভুত ধারণাও জন্মে গেছে, গাছটি কাটলে হয়তো অলৌকিক কিছু ঘটবে! গ্রামে বিপদ-আপদ লাগবে! অজ্ঞাত কারণে মারা যাবে অসংখ্য মানুষজন! পরিস্থিতি এমন হলো যে, গাছটি কাটা এখন শুধু সাহসী নয় দুঃসাহসী কাজও হয়ে দাঁড়াল যেন! গাছটি কাটার কথা শুনে গ্রামের অত্যুৎসাহী লোকজনের বুকের ভেতরটা ক্ষোভে কাঁপছেও! ঠিকঠাক মতো ধর্মকর্ম পালন না করলেও আল্লাহ্তালার কুদরত, কেরামতির আর জিন-ভূতের ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহ তাদের। এমন একটা অলৌকিক ঘটনা গ্রামের লোকজন তাদের জীবনে প্রথমই দেখছে!

দিনে দিনে নারিকেল গাছটির প্রতি সকলের কেমন ভক্তিও বাড়ছে! নারিকেল গাছটি কাটা হোক— সেটা চাইছে না কেউই। এমন কী আসাদ খাঁর দুই ছেলেহারা স্ত্রী লতিফা বানুও গতকাল রাতে তাঁকে বলেছেন, ‘স্বপ্নে কেউ একজন নাকি তাকে ইশারায় জানিয়েছে— নারিকেল গাছটি কাটা হইলে ভয়ংকর বিপদ আসবে বাড়িতে…!’ সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় দুই ছেলেকে হারিয়ে অসহ্য শোকে দিনরাত কাটছে লতিফা বানুর। মৃত্যুকালে আসাদ খাঁর বড় ছেলে হাসানের বয়স হয়েছিল তেইশ আর ছোট ছেলে হোসেনের উনিশ। এক বিকালে মোটরসাইকেলে চড়ে দুই ভাই সদরের দিকে যাচ্ছিল। ট্রাকচাপায় ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হলো। পাশের গ্রামের খালেক ব্যাপারীর বড় মেয়ে কলেজপড়ুয়া মিতুর সঙ্গে আসাদ খাঁর বড় ছেলে হাসানের বিয়ের কথাবার্তাও ঠিক হয়েছিল। হাসানের হঠাৎ মৃত্যুর খবরে শোকে কেঁদেছিল মিতুও। হাসানের সঙ্গে কিছু দিনের প্রেমের সম্পর্কও নাকি ছিল মিতুর! হাসানের মৃত্যুর পর প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার বাবুলের সঙ্গে মিতুর অমতেই বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু মিতুর সেই বিয়ে ভেঙে গেল তিন মাসের মধ্যেই! স্বামীর সংসার রেখে মিতু বাপের বাড়ি চলে আসলো। অনেক বুঝিয়েও মিতুকে আর স্বামীর সংসারে পাঠানো গেলো না। মিতুর স্বামী বাবুল এসেও ফিরে গেলো। মিতুকে সঙ্গে নিতে পারলো না বাবুল। কয়েক মাস অপেক্ষা করেও কিছু হলো না। তারপর নিয়ম মতো সংসার ভেঙে গেল। বাবুল ফের বিয়ে করল। কিন্তু মিতু একাই আছে। সদরের কলেজে ইংরেজি বিভাগে অনার্স করছে। গ্রামে কয়েকটি ছেলেমেয়েকেও ইংরেজি গ্রামার প্রাইভেট পড়াচ্ছে।

গ্রামের রাস্তার পাশের গোরস্থানে হাসানের কবর। মাঝেমধ্যে গোরস্থানের পাশ দিয়ে আসার সময় মিতুর দুচোখ জলে ভরে যায়। হাসানকে কী ভুলতে পারছে না মিতু? অল্প দিনের প্রেমেও কষ্ট কম নয়! লতিফা বানুর কথা যে অবৈজ্ঞানিক আর ভিত্তিহীন সেটা বুঝেও নারিকেল গাছটি কাটা নিয়ে সত্যি সত্যিই যেন দ্বিধায় পড়েলেন আসাদ খাঁ! তিনি মনে মনে ভাবছেন, কখনো কখনো বোধহয় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের একটা অদৃশ্য সীমারেখায় আটকে যেতে হয় মানুষকে! জগত-সংসার কী অদ্ভুত আর কী রহস্যময়! তবে নারিকেল গাছটি তিনি কাটবেনই। সেটা আজ হোক আর কালই হোক। তারপর কয়েক দিন যেতেই হঠাৎ যখন এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে নারিকেল গাছটি কাত হয়ে পড়ে পুকুরে ডুবে গেল, তখন একটা মহাঝামেলা থেকেই যেন মুক্তি পেলেন আসাদ খাঁ। কিন্তু নারিকেল গাছটি পুকুরে ডুবে যাওয়ার পর থেকেই কাকতালীয়ভাবে কয়েকটি দুর্ঘটনাও ঘটতে থাকলো গ্রামে! যা নিয়ে সকলের মনে বিরাজ করছে কেমন আতঙ্ক আর ক্ষোভ! লোকজনের মনের ভেতর যন্ত্রণাদায়ক কিছু একটা বিস্ফোরিত হচ্ছে যেন! ধর্মভীরু কেউ কেউ আসন্ন কেয়ামতের ভয়ে প্রচণ্ডভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে! ঘটনার আকস্মিকতার ধাক্কায় কান্নাকাটিও শুরু হয়েছে গ্রামে।

কাতারপ্রবাসী কুদ্দসের যুবতী বউ পরকীয়া করে দূর গ্রামের এক লোকের সঙ্গে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেল! লোকজন বলাবলি শুরু করল, ‘জিন রাইগ্যা তারে উঠাইয়া নিয়া গেছে!’ দুবাইফেরত যুবক জামাল মিয়া আর্থিক সংকটে ভুগে রাতের আন্ধকারে পরনের লুঙ্গি খুলে বাড়ির আমগাছের ডালে গলায় ফাঁস দিয়ে লাশ হলো। সকাল বেলা আমগাছের ডালে জামাল মিয়ার সেই উলঙ্গ লাশ দেখে আতঙ্কে বাড়ির সবাই বলল, ‘জিনই তারে গাছের ডালে ঝুলাইয়া মারছে!’ দুই বাচ্ছার মা আলমের স্ত্রী মানসিক অস্থিরতায় ভুগে এলামেলো কথাবার্তা বলছে, কথায় কথায় রেগে যাচ্ছে, গালিগালাজও করছে। প্রতিবেশীর ধারণা, ‘তারেও জিনে আচর করছে।’

চারদিকে যেই ঘটনাই ঘটছে সব জিনের কাজ বলেই প্রচার করছে গ্রামের লোকজন! আসাদ খাঁর স্ত্রী লতিফা বানুও অজানা বিপদ আতঙ্কে ভুগতে ভুগতে নাকি দুই ছেলের শোকে শোকেই হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়লেন! স্ট্রোক করলো কি না? হাসপাতাল নিয়েও লতিফা বানুকে আর বাঁচানো গেল না। স্ত্রীর মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ আসাদ খাঁ কেমন নিস্তরঙ্গ হয়ে পড়েছেন, এক রৌদ্রতপ্ত দুপুরে অকারণে পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ালেন তিনি। একাকিত্বের উদ্বেগ আর তিক্ততায় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক ফেটে! পুকুরের পানিতে খাঁ-খাঁ রোদ পড়ছে তখন। বাড়ির চারিদিকের গাছগুলো রোদে পুড়ছে যেন! ভরদুপুরের নীল আকাশে ঘুরে ঘুরে উড়ছে একটা চিল। আসাদ খাঁর মতোই যে নিঃসঙ্গ চিলটি! কিছুক্ষণের মধ্যেই চিলটি নেমে আসে আসাদ খাঁর মাথার অল্প ওপরে। চিলটি ঘুরে ঘুরে কেমন করে ডাকছে যেন! কিন্তু আসাদ খাঁর মনে হচ্ছে তাকে যেন কেউ বলছে,‘নারিকেল গাছটি গেল কোথায়? নারিকেল গাছটি গেল কোথায়?’ বিস্ময় আর কৌতূহল নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন তিনি। ‘ভরদুপুরে আপনে কই গেলেন? ভাত খাইতে আইয়েন…।’ ঘর থেকে আসাদ খাঁর মৃত স্ত্রী তাকে ডাকছেন! আসাদ খাঁ জবাবও দিলেন, ‘আমি পুকুরঘাটে আইছি, গোসল সাইরা আইতাছি…।’ স্ত্রীর মৃত্যুশোকে মানুষটা অদ্ভুত রকম বদলে গেলেন! নিঃসঙ্গ জীবনে তিনি কি সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছেন? চিলটির দিকে তাকাতে তাকাতে তড়িঘড়ি করে পুকুরের পানির দিকে নামতে থাকেন আসাদ খাঁ! নারিকেল গাছটি পুকুরের যেখানে ডুবেছিল ঠিক সেখানে পৌঁছে, পানিতে ডুব দিয়ে তিনি কী খুঁজতেছেন? ততক্ষণে উড়তে উড়তে দূরের আকাশে হারিয়ে গেলো নিসঃঙ্গ চিলটি।