সিদ্ধার্থ থেকে গৌতম বুদ্ধ

প্রতীকী ছবি(Getty Images)

সিদ্ধার্থ বা গৌতম বুদ্ধ ছােট থেকেই উদাসীন , পিতার অগাধ সম্পত্তি ও রাজকীয় জীবন তাঁর জীবনকে কোনওভাবেই রেখাপাত করেনি।তিনি যখন ষােল বছর বয়সে পদার্পণ করেন,তাঁর পিতা গােপা নামে এক রাজকুমারীর সঙ্গে সিদ্ধার্থর বিবাহ দেন। পরবর্তীকালে তাঁদের একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে।কিন্তু সংসারের ভােগবিলাসের প্রতি তিনি একেবারেই উদাসীন ছিলেন।সমস্ত কিছু থেকে বিরত থেকে তাঁর মনে একটি ভাবনা সবসময় তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে তা হল কেন মানুষের জীবনে এত দুঃখকষ্ট।শৈশব থেকে মানুষ কত কষ্টের মধ্যে বৃদ্ধ অবস্থায় যায় তারপর জরা বা মৃত্যু তাকে গ্রাস করে।এর থেকে বাঁচার উপায় কী?কীভাবে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে?এই বৈরাগ্যের কারণেই স্ত্রী নবজাত পুত্র ও রাজপ্রাসাদের ভােগবিলাস পরিত্যাগ করে তিনি সত্য ও জ্ঞানের সন্ধানে বাহির হন এবং উন্নত জীবনের পথের সন্ধানের জন্য অস্থির হইয়া ওঠেন।

গৃহত্যাগ করবার পর কিছুদিন তিনি বৈশালী ও রাজগৃহে উপযুক্ত শিক্ষকের নিকট শাস্ত্র অধ্যয়নে বিশেষ ব্রতী হন,কিন্তু জগতের রহস্য সম্পর্কে কিছুই জ্ঞাত হতে পারলেন না,পরিশেষে গয়ার নিকট উরুবিল্ব নামক স্থানে ধ্যানে নিমগ্ন হন এবং এই স্থানেই একদিন তিনি বােধি বা দিব্যজ্ঞান লাভ করেন।অতঃপর তিনি ‘বুদ্ধ'(পরমজ্ঞানী ) বা তথাগত ( যিনি সত্যের সন্ধান পেয়েছেন ) নামে পরিচিত হন। পরমজ্ঞান লাভ করে বারানসীর উপকূলের সারনাথে গিয়ে তিনি তাঁর নতুন ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন।এর পর প্রায় ৪৫ বৎসরকাল মগধ কৌশল প্রভৃতি পূর্ব  ভারতের নানা স্থানে ধর্মপ্রচার করেন।সারনাথে পঞ্চভিক্ষু নামে পরিচিত তাঁর অনুচরের নিকট তিনি সর্বপ্রথম উপদেশ বিতরণ করেন যা ধর্মচক্র প্রবর্তন নামে খ্যাত।গৌতম বুদ্ধের বৈপ্লবিক মতাদর্শ মানুষকে নতুন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে।বুদ্ধ এমন এক জীবনপথের সন্ধান দেন যেখানে মানুষ সহজ ও সরল জীবন যাপন করতে পারে। তাঁর পরিকল্পিত জীবনপথে আচার অনুষ্ঠানের বাহুল্য ছিল না।ব্রাহ্মণদের নিপীড়ন ছিল না,মানুষের ভােগ , সুখ , দুঃখ প্রভৃতি নির্ভর করত মানুষেরই কর্মপদ্ধতির উপর।বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের পবিত্র জীবনযাত্রার আদর্শও এই ধর্মকে  জনপ্রিয় করে তুলতে সাহায্য করে।সম্রাট বিম্বিসার , অশােক , কনিষ্ক , হর্ষবর্ধন প্রভৃতির রাজকীয় পৃষ্ঠপােষকতা এই ধর্মমত প্রসারে বিশেষ সহায়ক হয়।

বুদ্ধ ছিলেন বাস্তবধর্মী সংস্কারক।মানবজাতি জাগতিক দুঃখকষ্ট থেকে যাতে মুক্তি পায় তার পথনির্দেশ করাই ছিল বুদ্ধের একান্ত কামনা।তিনি মনে করতেন যে , মানুষের মৃত্যুর পর তার আত্মা পুনরায় দেহলাভ করে।এই নবজন্মের পর তাকে গত জন্মের কর্মফল ভােগ করতে হয়।কর্মফল ও তার পরিণাম ‘দুঃখ’ সম্পর্কে গৌতম বুদ্ধ চারটি সত্য উপলব্ধি করেন।যা পরে আর্যসত্য নামে অভিহিত হয়।যথা – (১) সংসারে দুঃখকষ্ট রয়েছে,(২)এই দুঃখকষ্টের কারণও আছে ,(৩)মানুষের দুঃখকষ্ট নিরােধের উপায় হল তৃতীয় সত্য, (৪)দুঃখকষ্ট অবসান করার সত্যপথ জানতে হবে।


বুদ্ধের মতে জন্মই দুঃখের কারণ।তাঁর মতে কামনা বাসনা,আসঙ্গলিপ্সা,তৃষ্ণা, আসক্তি প্রভৃতি প্রবৃত্তি থেকেই দুঃখকষ্টের আবির্ভাব হয়।এদের অবসানকল্পে বুদ্ধ অষ্টপন্থা বা অষ্টাঙ্গিক মার্গের নির্দেশ দিয়েছেন।সেগুলি হল – (১)সৎ বাক্য ,(২) সৎ কার্য,(৩)সৎ জীবন,(৪)সৎ চেষ্টা,(৫)সৎ চেতনা,(৬)সৎ চিন্তা,(৭)সৎ সংকল্প এবং (৮) সৎ দর্শন।এই আটটি পন্থাই নির্বাণলাভের চরম পথ-এগুলির দ্বারাই মানুষের মনে যথার্থ শান্তি আসতে পারে।বৌদ্ধধর্মের মধ্যে কতকগুলি নৈতিক উপদেশও আছে। এগুলি ‘পঞ্চশীল’ নামে অভিহিত।যথা-হিংসা,ব্যভিচার,মদ্যপান,মিথ্যাভাষণ ও পরস্বাপহরণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ।

বৌদ্ধধর্ম মূলত কোন এক নতুন ধর্ম নয়।এ ধর্ম মানুষকে পবিত্র জীবনধারণ করতে নির্দেশ দিয়েছে।এগুলি শিষ্যদের দেওয়া গুরুর নৈতিক উপদেশ।যথার্থ বিশ্বাস,পবিত্র জীবনযাপন ও সৎ কার্য ইত্যাদি।সকল ধর্মেরই মূল কথা।বুদ্ধের ধর্মমতে আবার অনুষ্ঠানের বিশেষত্ব কিছুই নেই।এতে ব্যয়বহুল যাগ-যজ্ঞ প্রভৃতির প্রাধান্য নেই। বলা চলে নতুন ধর্মের প্রবর্তক হওয়ার চেয়ে তিনি ছিলেন সংস্কারক।তিনি প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় আড়ম্বরের বিরুদ্ধে জোরদার প্রতিবাদ করেছিলেন।হিন্দুধর্মের ত্রুটি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার হিন্দুধর্মকে ত্যাগ করেননি। বৌদ্ধধর্মের উপর ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব যথেষ্টভাবে বিদ্যমান।উপনিষদের কর্মবাদও এর মধ্যে স্থানলাভ করেছে।

অবশেষে একথা বলা অনস্বীকার্য যে,এই মহামানবের অভূতপূর্ব প্রয়াস সে সময়কালে সমাজের সৎ ও বিবেকবান মানুষেরা সার্বিক হতাশা মানসিক শান্তি ও মুক্তিলাভের আশায় গৌতম বুদ্ধের প্রতি আকৃষ্ট হন ও তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করেন।