বড়াে যন্ত্রণা নিয়ে শেষ হলাে আমার এই কুমায়ুন যাত্রা।এই যন্ত্রণা মনেতে,দেহতে নয়।শুরু করেছিলাম ২৭নভেম্বর ২০১৭ সকাল এর লালকুয়া এক্সপ্রেস চেপে।পরদিন দুপুরে চার ঘন্টা লেট করে পোঁছেছিলাম।স্টেশন থেকে ট্রাভেরা গাড়িতে রওনা হলাম,গাড়ি আগে থেকে বলা ছিল।২৮০০ টাকা প্রতিদিন কিন্তু ১৫০ কিমি এর মধ্যে যাত্রা করতে হবে প্রতিদিন,এর বেশি হলে আনুপাতিক হিসাবে বর্ধিত ভাড়া নেবে।২৭ কিমি পেরিয়ে সােজা কাঠগােদাম।রানীবাগ এ ফিয়েস্তা হােটেলে পৌঁছালাম,এটা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত।এখানে দুপুরে খাবার খেলাম ও নৈনিতাল এর উদ্দেশে রওনা হলাম।১ ঘন্টা ৩০ মিনিট জার্নি করে ৩২ কিমি ড্রাইভ করে নৈনিতাল লােকের উপর দাঁড়িয়ে থাকা খুব সুন্দর লােকেশন এ হােটেল শালিমার এ বিকেল ৫টাতে পৌছালাম।কথিত আছে সতীর দেহ আর দেবীর নয়ন জোড়া এসে পড়ে এই স্থানে।এবং তার ফলেই সৃষ্টি হয় নয়নাকৃতি এই বিশাল লেক।তাই এই লেকের নাম নৈনিতাল ও পাশের নয়নাদেবীর মন্দির।
জিম করবেট এর শহর নৈনিতাল।নৈনিতাল শহরে তার জন্ম হয়।ভিক্টোরিয় যুগে এখানে মূলত ইংরেজ প্রশাসকগণই এই পাহাড়ি শহরটিতে বাস করতেন।এখানকার বিভিন্ন স্থাপত্যে এর ছাপ আজও রয়ে গেছে।
লেকের উপর যেন হােটেল টা দাঁড়িয়ে আছে।ভাড়া ১২৫০ টাকা DAB।পরদিন নৈনিতালের আশপাশ তাল্লিতাল,নইনি মন্দির,কেভ গার্ডেন টিফিনটপ,ভিউ পয়েন্ট,সাত্তাল,ভীমতাল এই সব সাইট সিন করে তৃতীয় দিন ১২০ কি মি অতিক্রম করে এলাম কৌশানি,এখানে শিভয় হােটেল ১২০০ টাকা প্রতি দিন প্রতি দুজনের হিসাবে থাকলাম।কৌশানির কথা আর কি বলবাে,এখানকার সূর্যোদয় যে অতি প্রতি দুজনের হিসাবে থাকলাম।কৌশানির কথা আর কি বলবাে,এখানকার সূর্যোদয় যে অতি মনােরম তা সকলেই জানে।আমি সকাল ৫ টা নাগাদ আমার ছােট্ট ব্যাগটি পিঠে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম,আমার সঙ্গী হলাে হােটেলের রাতের চার পেয়ে প্রহরী ‘শেরু।রাস্তাঘাট সুনসান,একটা জনমানব রাস্তায় নেই,শুধু আমি আর শেরু।এর আগে গান্ধী আশ্রম থেকে সূর্যোদয় দেখেছিলাম এবার তাই ঠিক করলাম একটা নতুন জায়গা থেকে সূর্যের জেগে ওঠার মুহুর্তগুলাে ক্যামেরা বন্দি করবাে।৫.৩০ মানে পাহাড়ে অন্ধকার,ঠান্ডা বেশ ভালােই লাগছিলাে,ব্যাগে ফ্লাস্কে চা ছিল,চা খেতে খেতে ভাবছিলাম,বছর ২৫ আগে এই কৌশানি তে যখন এসেছিলাম তখন এখানে কিছুই ছিলােনা।সেদিনের সেই হারিয়ে যাওয়া কলেজের বন্ধুরা আর আমার ছােট্ট ছেলেটা তাদের কথা মনে পড়ছিলাে।ছেলেকে খুব মিস করছিলাম।ও আমার খুব ভালাে বন্ধু।এখন বড় হয়েছে,অনেক দায়িত্বের কাজ করে তাই যখন তখন এই বুড়াে বুড়ির সাথে আসতে পারেনা।বাচ্চারা ছােট বয়সে যেমন অপেক্ষায় থাকে,কখন বাবা অফিস থেকে বাড়ি আসবে,তেমনি বৃদ্ধ বয়সে বাবা মা কেও অপেক্ষায় থাকতে হয় কখন সন্তান বাড়ি ফিরবে।এ এক অদ্ভুত প্রতিমুহুর্ত।
এর মধ্যে পূর্ব আকাশ ফর্সা হলাে আর উত্তরের আকাশে একটা সদ্য নিভে যাওয়া দেশলাই কাঠির বারুদের মাথার মতাে একটু বড় আগুনের বিন্দু দেখতে পেলাম।এটাই হিমালয়ের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা ত্রিশুল,কমেট ও পঞ্চচুল্লি এর রেঞ্জ।ধীরে ধীরে সব কটা চূড়া ভেসে উঠলাে।রক্তিম হয়ে ওঠা হিমালয়ের রেঞ্জ দেখে আমি মুগ্ধ নয়নে।
মহাদেবের হাতে ধরা ত্রিশুল দেখছিলাম।
একদম চোখের সামনে,হাত ছোঁয়া দূরত্বে যেন দাড়িয়ে আছে আমাদের দিকে তাকিয়ে।একসময় কৌশানির একমাত্র আশ্রয় ছিল গান্ধি আশ্রম বা অনাসক্ত আশ্রম।এখানে কিছুটা কম খরচে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।ফোন – ০৫৯৬২২ ৫৮০২৮।এছাড়া কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগমের রেস্টহাউস।ফোন – ০৫৯৬২ ২৫৮০০৬ ।প্রাইভেট হােটেলও অনেকগুলাে আছে তবে এখনও ভােরের সূর্যোদয় দেখতে গান্ধি আশ্রমের সবাই আসে।১৯২৯ সালে মহাত্মা গান্ধি কৌশানি এসেছিলেন।এর রূপে মুগ্ধ হয়ে গান্ধীজি কৌশানিকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘দ্য সুইজারল্যান্ড অব ইন্ডিয়া’।হােটেলে ফিরলাম।স্নান ও ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম চৌকরির উদ্দেশ্যে,বাগেশ্বর হয়ে ৮৬ কিমি পেরিয়ে ৫ ঘন্টায় চৌকরি পৌছালাম।হােটেল শিখর রাজ এ উঠলাম।DAB প্রতি দিন ১২০০ টাকা।এখানে KMVN এর টুরিস্ট লজটা ভীষণ সুন্দর,লন জুড়ে ৮খানা কটেজ ও মূল লজেও অনেকগুলাে রুম আছে।ভাড়া ২৩০০ থেকে ৪০০০ টাকা ঘর প্রতি,দিন প্রতি।বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি লন চেয়ার এ বসে পকোড়া চা ও কফি নিয়ে জমিয়ে আড্ডা সাথে জমাট ঠান্ডা।আর হিমালয়ের সৌন্দর্যএর কথা কি আর বলবাে আকাশ পরিষ্কার থাকায় সন্ধ্যাতেও মনে হচ্ছিলাে কামধেনু যেন তার দুগ্ধ ধারায় হিমালয়কে স্নান করাচ্ছে।হিমালয় এ এর আগে এতাে সাদা চেহারায় পাইনি।কুমায়ুন যেন প্রকৃতির এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের কোলাজ।
পরদিন সকালে ৩৫কিমি ড্রাইভ করে দুঘন্টায় পৌছালাম পাতাল ভুবনেশ্বর।৯০ফুট গভীরে ৮২তা ধাপ পেরিয়ে পাতাল স্বর্গ।এখানে সত্যি নাকি ভগবান থাকেন।তিন ফুট সুড়ঙ্গতে কি করে মানুষ নামে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয়না।আমি ওই সুড়ঙ্গে যেতে পারিনি তবে আমাদের টিমের দুই মহিলা সাথী নেমে ছিল।সত্যি সাহসী বটে এরা।পরের দিন ভাের ভাের বেরিয়ে পড়লাম মুন্সিয়ারির উদ্দেশে।রাস্তা প্রায় ১০০ কিমি খাল ও তেজাম হয়ে পথ গিয়েছে।খুব সরু ও খারাপ রাস্তা,পথে বৃথী ওয়াটার ফস,দেখার মতাে,খুব সুন্দর।৫ ঘন্টা জানি করে বিকেল বিকেল মুন্সিয়ারি পৌছালাম।
মুন্সিয়ারির ১৮ কিমি আগে একটা চায়ের দোকানে গাড়ি থামলাে,এটা এই পথের উচ্চতম পয়েন্ট ৮৫০০ ফুট এর মতাে,এখন থেকে যেন হিমালয়ের প্রথম চুম্বন টা অনুভব করলাম।হিমালয় যেন মুন্সিয়ারির মাথার ছাতা।এখান থেকে সবথেকে কাছের যে পাঁচটি পর্বত শৃঙ্গের শ্বাসপ্রশ্বাস এর শব্দ পাওয়া যায় তার নাম,পাঞ্চচুলা।এই পাঞ্চ চুলাকে ভাের রাতে ধ্রুবতারার আলােয় দেখেছি,সকালের প্রথম সূর্যের ছটায় দেখেছি,দুপুরের হালকা কুয়াশায় ঢাকা অবস্থায় দেখেছি,গােধূলির সিঁদুরে আভায় দেখেছি তাবার সন্ধ্যার পূর্ণ চাঁদের আলােয় দেখেছি।এতাে গভীরভাবে হিমালয়কে আগে কখনও দেখিনি।
মুন্সিয়ারি কথার অর্থ হলাে বরফে ঢাকা স্থান শীতকালে মুন্সিয়ারি বরফেই ঢেকে থাকে।সারা বছর এখানে প্রচুর বিদেশি পর্যটক আসে অথছি এখানকার পাহাড়ী রাস্তাঘাট খুবই করুন দশায় রয়ে গেছে।উত্তরাখণ্ড রাজ্যে অনেক রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু প্রকৃতির রূপের ভান্ডার এই কুমায়ন পাহাড়টা যেন অবহেলিতই রয়ে গেলাে।
এবার এলাম কাসার,এটা আলমােড়ার ২০ কিমি আগে।রাত প্রায় ৯টা তে প্রায় ১৬০ কিমি ড্রাইভ করে মুন্সিয়ারি থেকে এখানে এলাম।একটা হােমস্টে তে উঠলাম,১০০০টাকা DAB রুম।রাতে বুঝিনি যে সকালে কি এক অপূর্ব ডালি সাজিয়ে রেখেছে এই কাসার।উত্তরের আকাশটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে দুধ সাদা হিমালয় যার প্রতিটা নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে আমার শরীরে।
দুপুরে লাঞ্চের পরে রওনা হয়ে মুক্তেশ্বর পৌছালাম। কাসার থেকে ৭০ কিমি পথ।৭৫০০ ফুট উপরে মুক্তেশ্বর মন্দির ৩৫০ যার বয়স।এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা মানে এক জাগতিক রূপ দর্শন।নিচ থেকে বেশ অনেকটাই চড়াই ভেঙে এই মন্দিরে পৌঁছাতে হয়।দেবাদিদেব মহেশ্বর মহাকালেশ্বর এখানে থাকবেননাতাে আর কোথায় থাকবেন।এতাে রূপ এতাে নিঃস্তব্ধতা।৬টাতে রানীবাগ এ ফিয়েস্তা হােটেলে পৌছালাম।ভাড়া ১২০০ টাকা DAB।পরদিন সকালে ৮.৪০এর সম্পর্কক্রান্তি এক্সপ্রেস ধরলাম দিল্লির উদ্দেশ্যে,এটা ট্রেন নয় যেন এক নরক গুলজার।
ওল্ড দিল্লি থেকে নিউ দিল্লি এসে কলকাতার ট্রেন ধরলাম।এবার আসছি আমার মন খারাপের কারণটা কি ছিল তা বলতে।সঞ্জু নামের ৩৮ বছরের এই যুবকটির জীবন নিয়ে একটা সিনেমার প্লট বানানাে যায়।প্রচুর বড়লােকের ছেলে ছিল সঞ্জু।বাবার মৃত্যুর পরে আত্মীয় স্বজনরা সব সম্পত্তি আত্মসাৎ করে।সঞ্জুকে ১৬ বছর বয়সে পথে নামায়।মা, এর কয়েক বছর আগে চোখ বুজেছিলেন,খুব ভালাে গাড়ি চালাতাে সঞ্জু,ওর নিজেরই ২টো গাড়ি ছিল।তাই গাড়ি চালানােটাকে জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করে।খুব ঠান্ডা মাথার ড্রাইভার এই সঞ্জু।একটাই দোষ,তা হলাে ভীষণ নেশা করতাে।দিনের বেলা ড্রাই নেশা আর রাত্রে তরল নেশায় ডুবে যেত। সঞ্জুর আসল নাম KP Shing রাওয়াত।খুব ভালাে কবিতা লেখে।ওর লেখা গান একটা বলিউড ফিল্মে টাইটেল সং হয়েছে।মুভিটার নাম young rider| জানুয়ারী মাসে মুভিটা রিলিস হয়েছে ঈশ্বরকে বলবাে সঞ্জুর প্রতি যেন উনি একটু সদয় হন।বাড়িতে স্ত্রী,এক ১৭ বছরের ছেলে ও ১০ বছরের মেয়ে, দুজনই লেখাপড়া করে।এই সঞ্জু মানুষটা বড়াে ভালাে।দোষ একটাই, ৪/৫ ঘন্টা অন্তর ড্রাই নেশা করতাে,অথচ নেশা করে অসম্ভব শান্ত ভাবে গাড়ি চালাতাে।সময়ে নেশা করতে না পারলেই অশান্ত ডাইভ করতাে।ও যখন গাড়ি থামিয়ে নেশা করতে যেত, আমি তখন ওর সাথে থাকতাম।আমি অনেক নেশাড়ু দেখেছি জীবনে কিন্তু এই সঞ্জুর মতাে নেশাড়ু এই প্রথম দেখলাম।
আমি গাঁজা ও প্রক্সিভবন ট্যাবলেটকে মদের চাট হিসাবে খেতে দেখেছি আর এখানে সঞ্জুর মুখে শুনলাম ও নাকি হেরােইন এর নেশার সাথে মদ খায়।সঞ্জু Smack ও Snort নিয়ে তারপর XXX rum খেতে পারে।হেরােইন এর নাকি অনেক রূপ ও অনেক নেশা কবার ধরণ।সাদা,ব্রাউন ও কালাে ধরনের হেরােইন হয় কেউ smack কেউ Snort কেউ সিগারেটে মিশিয়ে আবার কেউ জলে মিশিয়েও খায় ।৩৮ কেজি বডি ওজন নিয়ে সঞ্জু এই সব নেশার কাছে পরাজিত হয়নি।ও বলে ওর এখন কিং কোবরার bite টাই জিভে নেওয়া বাকি।পরিবারের প্রতি ও খুবই দায়িত্বশীল। আইনের ওপর ভরসা করেছিল,যে ওর পৈতৃক সম্পত্তি ফিরে পাবে কিন্তু টাকা ও ক্ষমতার কাছে আজ গরিবের বিচার বন্দি।মানুষ হতাশা কাটাতে কেন যে নেশা করে জানি না।এই নেশার বিষগুলাে আজ সঞ্জুর মত হতাশ কিছু যুবকের সর্বনাশ ডেকে আনছে।এরা বিয়ে করে সন্তান জন্ম দেয় কিন্তু এরা এতটাই স্বার্থপর হয়ে যায় যখন এদের নেশার প্রয়ােজন হয় । কারাে প্রতি এদের প্রকৃত দায়িত্ববােধ নেই।
রােজ সন্ধ্যায় সঞ্জু আমার কাছে কাঁদতাে আর ওর যন্ত্রণা ভরা শায়েরি শুনাতাে।অবশেষে সেই বিদায়ের দিনটা এলাে,আমরা কাঠগােদাম ফিরে এলাম,আমরা দুজনেই চুপ করে ছিলাম লাগেজ হােটেলে নামানাের পর আমি সঞ্জুকে বিদায় জানালাম।হঠাৎ ও আমাকে বাচ্চা ছেলের মতাে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলাে আমি ওকে বকা দিয়ে শান্ত হতে বললাম,ও আমায় নিয়ে বাজারে গেল আমার কিছু দরকারি জিনিস কেনার ছিল।সঞ্জু ১২ দিন পরে বাড়ি যাচ্ছে তাই নিজেও একটু বাজার করলাে ।
পরদিন কাঠগােদাম থেকে যখন দিল্লি যাচ্ছি তখন ওর ফোনে খবর এলাে আবার কাল সকালে কাঠগােদাম থেকে নতুন গ্রুপ নিয়ে আবার ১২ দিনের কুমায়ুন যাত্রা,ও বলেছিলাে কালকে হালদোয়ানি যাবে পরিবারকে নিয়ে সবার জন্য মার্কেটিং করবে,কিন্তু আর হলােনা।পেটের টানে ওকে যে আবার গাড়ির স্টিয়ারিং ধরতেই হবে প্রাণ হাতে নিয়ে।পরদিন সকাল ১১ টায় গুড মর্নিং বার্তা এলাে নৈনিতাল থেকে , প্রেরক সঞ্জু।
কাঠগােদাম থেকে সম্পর্কক্রান্তি ট্রেন এর অসহ্য যাতনা সইতে সইতে ট্রেন ওল্ড দিল্লির দিকে এগােচ্ছিল । সঞ্জুর কথাই ভাবছিলাম।কে ও আমার?কেনইবা ওর জন্যে মনটা ভারী লাগছে? অনেক টুর করেছি জীবনে,অনেক ড্রাইভার সাথে থেকেছে,তবু কেন ওর জন্য মনটা ভারি লাগছে।
একটা পাহাড়ি বিছে , যা নাকি মারাত্মক বিষাক্ত। বৃথী ফলস এর কাছে আমি যখন এক মনে ১২০০ ফুট উচু থেকে ঝরে পরা তার রূপ দেখছিলাম তখন আমার মৃত্যু অপেক্ষা করছিলাে আমার খাদিম থেকে কেনা এঙ্কেল সু -এর উপরে।চামড়া থাকাতে bite করতে পারেনি।হঠাৎ কোথা থেকে সঞ্জু এসে আমার জুতাের ওপর ওর জুতােটা চেপে ধরলো, পাহাড়ি বিচ্ছর প্রাণ গেল আর আমি সে বিচ্ছর দিকে তাকিয়ে ৮ ডিগ্রি তেও ঘাম ছিলাম।
যথা সময়েই নিউ দিল্লি ১০ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে সন্ধ্যা ৭.৪০এ শিয়ালদা দুরন্ত ছাড়লাে।আবার এক নতুন মুখ,নতুন মনের সাথে ১৭ ঘন্টার সফর শুরু হলাে।বুঝলাম ট্রেনে বাঙালিদেরই আধিপত্য বেশি।খাওয়া দাওয়া চলছে সাথে হাসি,চিৎকার,ভয়ঙ্কর রাস্তার অভিজ্ঞতার বাড়াবাড়ি বর্ণনা।হঠাৎ পাশের কুপের এক পাজামা পাঞ্জামি পরা ভদ্রলােকের কাচা পেঁয়াজ আর লঙ্কা চাইই চাই। আর পায়ে এদের স্পাের্টস সু অথবা কাপড়ের জুতাে,পরনে ভূড়ির উপর জিন্সএর প্যান্ট আর মাথায় টুপি,এটাই নাকি ভ্রমণ পিপাসু বাঙালিদের ইউনিফর্ম।কথাগুলাে শুনে খুব মর্মাহত হলাম,একজন নিজে বাঙালি হয়ে সেই বাঙালি সম্বন্ধে এমন হাসির খােরাক করছে যে তাকে দেখার ইচ্ছা হলাে ট্রেনের ওনার সহযাত্রীদের মধ্যে বেশির ভাগ বাঙালিকে দেখলাম ওনার কথায় বেশি হাসলাে বাঙালিদের সমন্ধে আরও অনেক হেয় করা কথা বললাে।খুব খারাপ লাগছিল পরিবেশটা।সকালে উঠে দেখলাম সেই বাঙালি মাথায় একটা টুপি পরে ট্রেনের করিডােরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন।মনে হচ্ছিল এখনই GRP ডেকে ওনাকে ধরিয়ে দিই।তখন সত্যি সত্যি দুজন CRP কোথা থেকে এসে হাজির,আর যায় কোথায় বাবাজি,২০০ টাকা ফাইন, নয় হাজত, শুনে ভদ্রলােক তাে অস্থির হয়ে গেল,কত কাকুতি মিনতি,ওনাকে মাফ করবার জন্য। CRP তাে ছাড়ার পাত্র নয় ওনাকে গয়া স্টেশনে নামাবেই । এবার উনি বলতে লাগলেন ট্রেন ৭ ঘন্টা লেট চলছে তাই সিগারেট খাওয়া অন্যায় নয়,এতে পুলিশ আরও রেগে গেল এবার নিরুপায় ভদ্রলােক আমাকে ধরলাে পুলিশকে বােঝানাের জন্য। আমরা দুই-চারজন পুলিশকে বললাম ইনহাে নে সিগারেট পিয়া, ইনকো জুরমানা ভরকে ছােড়দিজিয়ে।২০০ টাকা ফাইন ও সিগারেটের প্যাকেট জমা দিয়ে উনি মুক্তি পেলেন ও সারা ট্রেনের বাকি সময় ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে চললাে।
যে বিষয়টি আমায় সব থেকে আনন্দ দিয়েছিল তা হচ্ছে আমি চলে আসার পর সঞ্জু জানিয়েছিল যে ও আর নেশা করছে না।আমি ওকে বলেছিলাম যে যখনই নেশা করতে ইচ্ছা করবে তখনই তােমার সন্তানদের ছবি দেখবে আর মনে করবে যে তােমার কিছু হয়ে গেলে এদের কি হবে ’সঞ্জু লিখেছিল যে ও সন্তানদের সাথে আমার ফটো ও দেখতাে, ও নাকি আমায় ওর বাবার স্থান দিয়েছে।এই আনন্দ আমার বেশি দিন টেকেনি কারণ আজ প্রায় ৬ মাস যাবত সঞ্জুর কোনও ফোন হয়তাে এতদিনের জমে থাকা বিষ ওর ছােট্ট শরীর টাকে নিথর করে দিল কিনা । বা হয়তাে এখন আর ওই ১০ দিনের একটা সম্পর্কও কে আর মনে রাখতে চায় না। তবে ঈশ্বরকে বলবাে শেষের টাই যেন সত্যি হয় । শুধু সঞ্জ থাকুক আমার মন জুড়ে চিরকাল । পুনশ্চঃ আমার এই ভ্রমণ কাহিনি লেখার দুমাস পরে হােটেল ফিয়েস্তা থেকে জানতে পেরেছি সে সঞ্জু এখন মনােবিকাশ কেন্দ্রে ভর্তি আছে , কাউকেই চিনতে পারে না শুধু ৬ বাই ৮ ঘরের জানালা দিয়ে দূরের পাহাড়গুলাের দিকে চেয়ে থাকে আর ওর ছেলে সত্য আঠারাে পেরিয়ে এখন তার বাবার মতােই স্টিয়ারিং ধরেছে সংসারের চাকাটাকে সচল করতে । কুমায়ুন যাত্রা । আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছে , দেখিয়েছে , বুঝিয়েছে আর ভাবিয়েছে , যার কোনটা আনন্দের কোনওটা হাসির , কোনওটা বেদনার এবং কোনওটা শিক্ষারও বটে ।