বাঁচিয়ে তুলুন কর্মাটাঁড়ের ‘বিদ্যাসাগর লাইব্রেরী’

কর্মাটাঁড়। বিদ্যাসাগরের জীবন ও নামের সঙ্গে জুড়ে থাকা এক গ্রাম। তখন ছিল বিহারের মধ্যে। আর এখন ওই গ্রামখানি ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত। গ্রাম-গ্রাম ভাব থাকলেও কর্মাটাঁড়কে আজ আর ঠিক গ্রাম বলা চলে না। কর্মাটাঁড় রেলওয়ে স্টেশনকে ঘিরে বর্তমানে মফস্বল শহরের আদল নিয়েছে গ্রামটি। বদলে গিয়েছে স্টেশনের নামটিও। যা ছিল কর্মাটাঁড়, তা হয়েছে বিদ্যাসাগর। এই স্টেশনের পশ্চিম পারে বিদ্যাসাগরের নন্দনকানন। বাগান ঘেরা বাড়ি। স্টেশন থেকে মিনিট দুয়েকের পথ। ১৮৭৪ সালে দশ বিঘা জমির উপরে ১১ কামরার একখানা একতলা বাড়ি কিনেছিলেন বিদ্যাসাগর। মাঝেমাঝে সেখানে গিয়ে থাকতেন তিনি। এই কর্মাটাঁড়কে ঘিরে গবেষকদের লেখনীর সাহায্যে সৃষ্টি হয়েছে ‘কুলি বিদ্যাসাগর’ কিংবা ‘জেলে বিদ্যাসাগর’-এর মতো গল্পকাহিনীর।

করুণাসাগর ইন্দ্র মিত্র জানিয়েছেন, কুলি সন্ধানরত এক বাঙালি ডাক্তারের ব্যাগ কুলির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় স্টেশনের বাহির পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। বিরাট কোনো ব্যাপার নয়। এ কাহিনী সত্যও হতে পারে কিংবা মিথ্যা। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। গল্পটির তাৎপর্য অনেকখানি। ছোট্ট গল্প, কিন্তু শিক্ষা বৃহৎ। নিজের কাজ নিজে করো কিংবা নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। বিদ্যাসাগরের চারিত্র-মাহাত্ম্য কীর্তনের ক্ষেত্রে সমগ্র বাঙালি সমাজ গল্পটিকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু নিজ নিজ জীবনে গ্রহণ করেছে কিনা সেকথা একমাত্র বাঙালি সমাজই জানে। না-করলে কেন করেনি, বা করতে পারল না; তার জবাব একমাত্র বাঙালিই দিতে পারবে। তবে সে বাঙালির সন্ধান পাওয়া ভারি শক্ত। এর কারণটি হয়তো লুকিয়ে রয়েছে আমাদের মানসিকতার ভিতরে। আমরা শিক্ষার কথা শুনতে চাই, শিক্ষা দিতে চাই, কিন্তু কারো কাছ থেকে শিক্ষা নিতে চাই না। তাতে নিজেদেরকে বড্ড ছোটো মনে হয়।

এরপর কর্মাটাঁড়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিভাবে ‘ঈশ্বর জেলে’ হয়ে উঠলেন সে-কাহিনীও ভারি চমকপ্রদ। মাছে-ভাতে বাঙালি। মাছ না-পেলে বাঙালির চলে না। অথচ কর্মাটাঁড়ে বসবাসকারী তখনকার বাঙালিরা দিনের পর দিন মাছ পাচ্ছেন না। বিষয়টি বিদ্যাসাগরকে জানালেন তাঁরা। বিদ্যাসাগর খোঁজখবর নিয়ে জানলেন যে, মাছ নিয়ে জেলেকে পয়সা দেয় না বাঙালিরা। এই কারণেই মাছও পায় না তারা। বিদ্যাসাগর সমস্যাটার সমাধান করলেন এক অদ্ভুত কায়দায়। তিনি নিজেই জেলেদের কাছ থেকে প্রচুর মাছ কিনে সেই মাছ বাঙালিদের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিতে লাগলেন। করুণাসাগর ইন্দ্র মিত্রের লেখায় তিনি হয়ে উঠলেন ‘ঈশ্বর জেলে’।
কর্মাটাঁড়-কেন্দ্রিক এবং বাঙালি-সম্পর্কিত দুটি গল্পেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাহাত্ম্য কীর্তিত হল বটে, কিন্তু একই সঙ্গে বাঙালিদেরকে হেয় করে তাদেরকে ছ্যাঁচড়ায় রূপান্তরিত করা হল। তবুও কর্মাটাঁড়ের বাঙালিরা বিদ্যাসাগরকে ভুললেন না। এখানেই বাঙালির গৌরব। এখানেই বাঙালি চরিত্রের অনিঃশেষ মহিমা।


প্রবাসী বাঙালিরা তাঁকে যে ভুললেন না শুধু তাই নয়, বিস্মৃতির অতল গর্ভ থেকে তুলে এনে তাঁর স্মৃতি তর্পণ করলেন। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর, না–মৃত্যু নয়, বিদ্যাসাগরের মতো মানুষদের মৃত্যু হয় না। তিরোভাব- তিরোধানও নয়। হয় জীবনাবসান। কারণ অদৃশ্য হয়েও তাঁরা আরও বেশি দৃশ্যমান হয়ে ওঠেন। বিদ্যাসাগরকেও দেখতে পেলেন কর্মাটাঁড়ের বাঙালিরা। চর্মচক্ষুর দেখা নয়, তার চেয়ে আরও বড়ো দর্শনাঙ্গ মর্মের চোখ দিয়ে দেখলেন তাঁরা। বলে উঠলেন— আমরা তোমাকে ভুলিনি বিদ্যাসাগর, কর্মাটাঁড় তোমাকে ভোলেনি। এটা যে কেবল মনভোলানো কথা নয়, তার নিদর্শনও রাখলেন তাঁরা। সেই অভিজ্ঞানটির নাম ‘বিদ্যাসাগর লাইব্রেরী’। বিদ্যাসাগরের জীবনাবসানের তিন যুগ পরে কর্মাটাঁড়-নিবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হল বিদ্যাসাগরের নামাঙ্কিত গ্রন্থাগার। সেটা ১৯২৮ সাল। কর্মাটাঁড় স্টেশনের পূর্ব পারে করোঁ রোডের দক্ষিণ কোলে গড়ে উঠল লাইব্রেরি। স্টেশন থেকে হাঁটা পথে মাত্র মিনিট পাঁচেকের দূরত্ব। ১৯৩১ সালে এই লাইব্রেরি ভবনেই স্থাপিত হল ‘অবৈতনিক নবগৌর বিদ্যালয়’। ১৯৪৫ সালে ভবনটির দোতালায় গড়ে উঠল ‘বিদ্যাসাগর হলঘর’।

এই ভবনেই একদিন শোনা যেত বহু মানুষের কোলাহল, আর এখন তা হয়ে পড়েছে নির্জন-নির্গ্রন্থ মহল। বন্ধ হয়ে গিয়েছে লাইব্রেরী ও বিদ্যালয়। খসে পড়েছে প্লাস্টার, বেরিয়ে পড়েছে ইটের পাঁজর। সর্বাঙ্গে জীর্ণতার ছাপ। নিচ তলার ঘরে কেউ গরু বাঁধে, দেয়ালে ঘুটে দেয়। তবুও ভাঙাচোরা পাঁচিল আর আগাছার ভিতরে ‘বিদ্যাসাগর লাইব্রেরী’ নামাঙ্কিত ফলক বুকে নিয়ে ভবনটি আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু ক্রমশ বাঙালি-শূন্য হয়ে পড়া কর্মাটাঁড়ে যত্ন ও দেখভালের অভাবে তার সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। তবে এখনো সময় রয়েছে। এখনো বাঁচানো সম্ভব কর্মাটাঁড়ের ‘বিদ্যাসাগর লাইব্রেরী’।

একদিন কর্মাটাঁড়ের যে-সমস্ত বালক-বালিকা ‘ঈশ্বর জেলে’-র দেওয়া মাছ খেয়ে বড় হয়েছিল, তারাই হয়তো পরিণত বয়সে ‘বিদ্যাসাগর লাইব্রেরী’ প্রতিষ্ঠা করে তাদের মৎস্য-ঋণ শোধ করেছিল। সমগ্র বাঙালি সমাজ সে-ঋণে ঋণী নয়। কিন্তু বিদ্যাসাগরের কাছে তাদেরও রয়েছে অপরিমেয় ঋণ। তাই বিদ্যাসাগর অনুরাগীদের কাছে আবেদন, কর্মাটাঁড়ে যান, লাইব্রেরীটা দেখুন, সাহায্যের হাত বাড়ান, উদ্যোগ নিন, বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ‘বিদ্যাসাগর লাইব্রেরী’কে বাঁচান।