প্রায় সব বাঙালীর কাছে বাংলা ক্যালেন্ডারে বৈশাখ মাস মানে রবি মাস, ২৫শে বৈশাখ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই এই দিনটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতাম দুটো কারণে, ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সকাল ছটার আগে কলকাতায় রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে পৌঁছতে হোতো স্টেজের সামনে জায়গা পাওয়ার জন্য, বেশ কিছু নামকরা আর্টিস্টের রবীন্দ্রসঙ্গীত আর রবীন্দ্র কবিতা শোনা যেত নিখরচায় আর সন্ধ্যা বেলায় স্কুলের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠে মাইক হাতে তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে পারার সুযোগ।
গোটা বাঙালি জাতির কাছে ২৫শে বৈশাখ অথবা রবীন্দ্র জয়ন্তী এক অন্যতম সাংস্কৃতিক উৎসব, রবি মাস বলে এখন পুরো বৈশাখ মাসটা জুড়ে চলে নানা অনুষ্ঠান বাঙালি অধ্যুষিত শহরে ও গ্রামে। বিশ্বকবিকে স্মরণ করতে এই সব অঞ্চলে সারা দিনটা উৎসবের আকার নেই, সর্বত্রই সাজো সাজো রব। রবীন্দ্রনাথের মূর্তিতে মাল্যদান করে দিনের শুরু আর তারপরে সারাটা দিন ধরে মাইকে শোনা যায় নানান শিল্পীর গলায় রবীন্দ্র সঙ্গীত আর তাঁর লেখা কবিতা আবৃত্তি।
বছর চারেক আগে একদিন সন্ধ্যাবেলায় রবীন্দ্রসদন চত্বরে এক যুবককে দেখেছিলাম আপন মনে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে চলেছে, তাঁর সঙ্গে আলাপ করে জেনেছিলাম ২৫শে বৈশাখ সে এই অঞ্চলটায় সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে বিশ্বকবিকে তাঁর শ্রদ্ধা জানায়। আপনভোলা যুবকটিকে তাঁর উদাত্ত গলায় গান গাইতে দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম আবার একই সঙ্গে তাঁর প্রতি এক অদ্ভুত রকমের ভালবাসা জন্মেছিল। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে এই জায়গায় একবার এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোককে দেখেছিলাম দুই পায়ের পাতা অবধি ঝুলে থাকা এক সাদা পাঞ্জাবী পড়ে হাতে আঁকা কবিগুরুর স্কেচ আর কবিতার বই বিক্রি করতে, মজার লেগেছিল তাঁর পাঞ্জাবীর পিঠ আর বুক জুড়ে কালো কালিতে রবীন্দ্রনাথের মুখের ছবি আর তাঁর লেখা কিছু জনপ্রিয় গানের কথা। আজকাল তো অনেক যুবক আর যুবতীদের দেখি রঙিন পাঞ্জাবীতে লেখা রবীন্দ্রনাথের গান আর কবিতার লাইন, একই রকমভাবে মেয়েদের শাড়ির পাড়ে রবীন্দ্রনাথের মুখের ছবি আর শাড়ির জমিতে প্রেম ও পুজা পর্যায়ের গানের কলি।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে যেখানেই বাঙালিদের বসবাস সেখানেই রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করা হয় তাঁর জন্মদিনে আর তাঁর রচিত গান গেয়ে, কবিতা পাঠ করে, নৃত্যানুষ্ঠান আর রবীন্দ্রনাট্যাভিনয় পরিবেশন করে। বিদেশে বসবাসকারী বাঙালিরা সাধারণত ২৫শে বৈশাখের আগে কোন এক শনি বা রবিবার ছুটির দিনটায় কবিগুরুর জন্মতিথি পালন করেন, যেখানে ছোটছোট ছেলেমেয়েরা গীতিনাট্য পরিবেশন করেন প্রায় মাস খানেক নিয়মিত রিহার্সালের করার পর আর বড়রা রবীন্দ্রসঙ্গীত, তাঁর লেখা কোন গল্পের অংশ শ্রুতিনাটক আর কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। তাঁদের কাছে বৈশাখ মাসের বেশির ভাগ সময়টাই কবিগুরুকে নিয়ে কেটে যায়, তাঁকে স্মরণ করে, তাঁর মননে আর স্মৃতিচারণায়।
২৫শে বৈশাখের দিন অনেকে আবার দলবেঁধে রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলি সারা দিন ঘুরে বেড়িয়ে দেখতে পছন্দ করেন। পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রধান অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে কলকাতায় রবিঠাকুরের জন্মস্থান জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ভোরবেলা থেকেই প্রচুর জনসমাগম হয়, রাজ্যের বিভিন্ন জেলেগুলি থেকে অনেকেই সপরিবারে এখানে আসেন তাঁদের প্রিয় কবির জন্মভিটেটা নিজেদের চোখে দেখে নিতে।
মনেপড়ে স্কুলের স্কাউটিং গ্রুপের সদস্য হিসাবে আমাদের দু’বছর সকালবেলা থেকেই ডিউটি পড়েছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে, দর্শনার্থীদের বারবার অনুরোধ করে তাঁদের লাইন দিয়ে নিয়ম শৃঙ্খলা বজায় রেখে ঠাকুরঘরে ঢোকার জন্য। ঘরটির মেঝেতে সুন্দর করে আলপনা আঁকা আর ঠিক মাঝখানে প্রায় দেড় দু’ফুট লম্বা মাটীরঘট রজনীগন্ধা ফুলের ষ্টিক আর গোড়ে ফুলের মালা দিয়ে সাজান। ঘরের মাঝে এই আলপনা, মাটীর ঘট আর ফুলের পাশে মানুষের লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ছবিটি প্রায় সব খবরের কাগজে পরের দিন দেখা যেত। ঠাকুর পরিবারের প্রাচীন এই বাড়িটির প্রাঙ্গণে এইদিন সকাল থেকেই বিশিষ্ট গায়ক গায়িকারা রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন আর নবীন শিল্পীরা আশা করে থাকেন তাঁদের নাম যদি শিল্পী তালিকায় থাকে, গান বা কবিতা পাঠে অংশগ্রহণ করার জন্য। কবিগুরুর জন্মদিনের সারা দিনের এই অনুষ্ঠানটি কলকাতা দূরদর্শন সরাসরি সম্প্রচার করেন, যারা ঠাকুরবাড়িতে সশরীরে উপস্থিত হতে পারেন না তারা বাড়িতে বসে এই অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
ঠাকুরবাড়িতে ঢোকার রাস্তার দুইধারে যেন মেলা বসে যায়, লাইন দিয়ে দোকানে সাজানো কবিগুরুর নানান ছবি, কোনটা ফ্রেমে বাঁধানো বা শুধুই পোস্টার, বিভন্ন ধরনের আর সাইজের তাঁর মূর্তি, নানান শিল্পীদের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট, অনেকেই এইদিন আর এই স্থানটিকে স্মরণীয় করে নিতে নিজেদের পছন্দ মত জিনিসপত্র তাঁদের ঝুলিতে ভরে নিচ্ছেন।
কলকাতা থেকে কিছু দূরে ছোট শহর শান্তিনিকেতনে অনেকেই বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনা গিয়ে পৌঁছান ২৫শে বৈশাখ বিশ্বকবির জন্মদিনের অনুষ্ঠান দেখতে, শান্তিনিকেতন জুড়ে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর অসামান্য কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাজ যা অনেকের কাছেই সাহিত্য ও সংস্কৃতির অপূর্ব এক মেলবন্ধন। বিদেশ থেকেও পর্যটকেরা এসে ভিড় জমান নোবেল বিজয়ী কবির নিজ হাতে তৈরি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দেখার জন্য।রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের অনেকটা সময় শান্তিনিকেতনের আশ্রমে কাটিয়েছিলেন, শান্তিনিকেতনের সবথেকে বড় অনুষ্ঠান বসন্তোৎসব তবে এখানেও বেশ ঘটা করেই কবির জন্মদিন পালন করা হয়। এখানে কবির ব্যবহার করা কিছু জিনিসপত্র মিউজিয়ামে সংগ্রহ করে সযত্নে রাখা আছে যা দেখবার জন্য দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে থাকে। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়ও খুব ধূমধাম করে শান্তিনিকেতনে তাঁর জন্মদিন পালন করা হতো।
বাংলাদেশের নানা জায়গাতেও ছোটবড় নানান অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনটি পালন করা হয়, প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কবিকে স্মরণ করা হয়ে থাকে। রেডিও আর টেলিভিসান থেকে প্রচার করা হয় শিল্পীদের গানবাজনা, কবিতাপাঠ আর নাটকের অংশ। এই দিনে সকল পত্রিকা তাদের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে থাকেন আর ঢাকা এবং চট্টগ্রামে স্থানীয় অধিবাসীরা রবীন্দ্র মেলার আয়োজন করে থাকেন।
বাংলাদেশের কুষ্ঠিয়া জেলায় শিলাইদহের কুঠিবাড়ি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক স্মৃতি বিজড়িত স্থান, কবি তাঁর যৌবন কালের এক উল্লেখযোগ্য সময় এখানে কাটিয়েছেন, শিলাইদহ কুঠি বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। কুঠিবাড়িতে বসে কবি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি আর গীতাঞ্জলী কাব্যের অনুবাদের কাজও শুরু করেছিলেন। আর এই জায়গাটির বিশেষত্ব আরও বেড়ে গিয়েছিল এই কারণে যে এখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা কোরতে এসেছিলেন আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, প্রমথ চৌধুরীর মতো লোকজনেরা।
রবীন্দ্রনাথ লেখা কয়েকটা লাইন আজকের দিনে মনে পড়ে গেল, তিনি বলেছিলেন “আমি হিন্দু” “আমি মুসলমান” একথা শুনতে শুনতে কান ঝালা পালা হয়ে গেল। কিন্তু “আমি মানুষ” একথা কাহাকেও বলতে শুনিনা। যারা মানুষ নয়, তারা হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক, তাদের দিয়ে জগতের কোন লাভ নেই।
(লেখক ক্যানবেরা বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার)